পরিবর্তনের একান্ত স্বাক্ষাতকার : আবুল বাসার সেরনিয়াবাত ॥ সংস্কৃতি চর্চা মানুষকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে পরিবর্তনের একান্ত স্বাক্ষাতকার : আবুল বাসার সেরনিয়াবাত ॥ সংস্কৃতি চর্চা মানুষকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে - ajkerparibartan.com
পরিবর্তনের একান্ত স্বাক্ষাতকার : আবুল বাসার সেরনিয়াবাত ॥ সংস্কৃতি চর্চা মানুষকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে

3:43 pm , March 6, 2019

সাঈদ পান্থ ॥ ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের ঘূর্ণিঝড়, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ, পঁচাত্তরের বঙ্গবন্ধু হত্যা এবং বিবিধ ঘটনা আমার মনজগতে গভীর আবেগ এবং পাশাপাশি প্রচ্ছন্ন বিষাদের জন্ম দেয়। যার প্রতিচ্ছবি আমার কবিতায় রয়েছে। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে ঘর থেকে রাজপথে বের হয়ে আসি। ভোলায় লাখ লাখ লোকের মৃত্যু আমার কিশোর মনে গভীর রেখাপাত করে। প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে জীবন মৃত্যু ও ধ্বংসলীলার যে সম্পর্ক রয়েছে তা হাড়ে হাড়ে টের পাই। সত্তরের নির্বাচনে টিনের চোঙ্গা নিয়ে মাঠে নেমে পরি। তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা, মেঘনা, যমুনা ; জেগেছে জেগেছে, বাঙালি জেগেছে ; তিতুমীরের বাংলা, জেগেছে জেগেছে ; ক্ষুদিরামের বাংলা, জেগেছে জেগেছে ; সূর্য সেনের বাংলা, জেগেছে জেগেছে; জাগো জাগো, বাঙালি জাগো। এসব শ্লোগান আত্মপরিচয় এবং দেশাত্মবোধে এতই উদ্বুদ্ধ করেছিল যে, তা দশ জনম কবি হবার জন্য যথেষ্ট। একাত্তরের যুদ্ধের বিভীষিকা, হত্যা, অগ্নিকান্ড, পানিতে ভেসে যাওয়া অসংখ্য লাশ, ধর্ষণ, লুণ্ঠন এবং সর্বোপরি বড় ভাই, শহীদ মহসিন সম্মুখ যুদ্ধে নিহত হওয়া, একমাত্র ছোট বোন রাশিদা যুদ্ধের বলি হওয়া, আমার মনোজগতে গভীর বিষাদ, বিক্ষোভ ও দ্রোহের জন্ম দেয়। চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ জানিয়ে দেয় যে, স্বাধীন হলেও আমরা বুভুক্ষার কাছে কত অসহায়। বুভুক্ষু মানুষের করুণ মৃত্যু যুদ্ধের বিভৎসতাকেও ম্লান করে দেয়। পঁচাত্তরের বঙ্গবন্ধু হত্যা ও পরাজিত শত্রুদের উত্থান আমাকে দ্রোহী চেতনার বিকল্প হিসেবে কবি করে তোলে। মঙ্গলবার দৈনিক আজকের পরিবর্তনকে দেয়া একান্ত স্বাক্ষাতকারে কবি আবুল বাসার সেরনিয়াবাদ এ সব কথা বলেন। তিনি শুধু কবি নন একাধারে সাংবাদিক, ব্যাংকার, রাজনৈতিক, সমাজসেবক ও সংস্কৃতিজন। আবুল বাসার সেরনিয়াবাদ বলেন, একজন ব্যাংকার হিসেবে আমার পেশাটি চ্যালেঞ্জিং এবং ব্যস্ততায় ভরা। একটি সরকারি ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক হিসেবে আমার দায়িত্ব ও কর্তব্য অনেক। আবার লেখালেখির ক্ষেত্রে সময় দেয়া এবং সু-স্থির মনোনিবেশ থাকা একান্ত জরুরী। মাঝে মাঝে এই দুই স্বত্ত্বার দৈরথ অনিবার্য হয়ে ওঠে। এ কারণেই লেখালেখিতে আমার যে অবস্থান থাকা উচিৎ ছিল তার থেকে আমি অনেকটা পেছনে। আমার বহু ভাল লেখা প্রকাশ হওয়া সত্ত্বেও সময় দিতে না পারা এবং প্রচারের অভাবে তা দেশব্যাপী প্রভাব ফেলতে পারেনি। অথচ সে লেখাগুলো পাঠকের মনোজগতে প্রভাব ফেলার মত লেখা ছিল। অপেক্ষায় আছি সেই কৃষকের মত, যে বলেছিল, ‘সে রাজা হলে সমস্ত ভাত গুড় দিয়ে খাবে’। আমিও অবসরে গেলে দিন রাত লিখব। কবি আবুল বাসার সেরনিয়াবাদ আরো বলেন, সমসাময়িক সময়ে যারা লিখছেন তাদের মেধা এবং প্রজ্ঞার প্রতি আমার আত্মবিশ্বাস রয়েছে। ভবিষ্যৎ বর্তমানের চেয়ে আরও উজ্জ্বল, আরও মানসম্পন্ন হবে। আমি মনেকরি, বরিশালের লেখকদের দেশের গন্ডি পেরিয়ে বাইরেও আলো ছড়াবার যোগ্যতা রয়েছে। যদি তারা নিজেদের যোগ্যতার সর্বোত্তম ব্যবহার করেন। তিনি বলেন, বরিশালে আমার সমবয়সীদের মধ্যে যারা লিখতেন তাদের কেউ এখন আর লিখছেন না। তবে সমসাময়িক সময়ে যারা লিখতেন তাদের মধ্যে কবি মোশতাক আল মেহেদী, তপংকর চক্রবর্তী, নাজমুল হোসেন আকাশ, ফয়জুল হাকিম, আসমা চৌধুরী, সুদীপ্তা ঘোষ, মিলন আহমদ ফারাবী প্রমুখ এখনও যথেষ্ট লিখছেন এবং তাদের লেখা পড়ে উদ্দীপ্ত হই। জিয়া সাইদ, লালা ভাই, সেলিম শাহআলম, খসরু শাহ, সোয়েব আহম্মেদ, মামুন নেছার য়াহমাদ এবং আরও অনেকের কথা মনে পড়ে। আবুল বাসার বলেন, “শোকার্ত কবিতাগুচ্ছ” কাব্যটি আসলে “অনির্বাণ দ্রোহী আগুন” এই নামে ছাপা হওয়ার কথা ছিল। যাই হোক বিশেষ কারণে “শোকার্ত কবিতাগুচ্ছ” নামে ছাপা হয়েছে। সত্তর এবং আশির দশকে দেশীয় স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন এবং দেশের বাইরে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তার দোসরদের ষড়যন্ত্র, অত্যাচার, নির্যাতন এবং এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার মুক্তিকামী মানুষের অনির্বাণ আন্দোলন এ লেখার রসদ জুগিয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকার কবি বেঞ্জামিন মলয়ঁসি, জিম্বাবুয়ের কবি ও বিপ¬বী অগাস্টিনো নেটো, নিকারাগুয়ার কবি আর্নেস্তো কার্দেনাল, চিলির নোবেল বিজয়ী কবি পাবলো নেরুদা এবং তুরষ্কের কবি নাজিম হিকমত প্রমুখ এবং আফ্রো-এশীয় লেখক ইউনিয়নের বাংলাদেশের সভাপতি কবি মোহাম্মদ রফিক, প্রয়াত কবি রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ, অগণিত নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষ এবং সর্বোপরি আমার আদর্শিক চিন্তা এ লেখার পেছনে প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। চিন্তার মৌলিকত্ব, শব্দের ব্যবহার এবং নিজস্ব বোধের জগৎ আমি অন্যদের থেকে আলাদাভাবে নির্মাণ করতে চেয়েছি। তবে তাতে কোন স্বাতন্ত্র সৃষ্টি হয়েছে কিনা তা পাঠক/সমালোচক রায় দিবেন।
আগৈলঝাড়া (তদানীন্তন গৌরনদী) উপজেলায় আব্দুল বারিক সেরনিয়াবাদ ও রহিমা খাতুন এর পরিবারে আবুল বাসার সেরনিয়াবাদ ১৯৬১ সালের ২০ এপ্রিল জন্ম গ্রহন করেন। আবুল বাসার সেরনিয়াবাদ ও জেসমিন আফরোজ মুন্নীর এক মেয়ে মাশরেকা জেসমিন মৌরি ও ছেলে মুবাশ্বির সেরনিয়াবাত সুদীপ্তকে নিয়ে তার পারিবারিক জীবন। তিনি ব্যাংকার-অগ্রণী ব্যাংক বরিশাল, পটুয়াখালী, বরগুনা, ভোলা ও ঢাকায় ব্যবস্থাপকসহ বিভিন্ন পদে চাকুরি করেছেন। বর্তমানে বরিশাল সার্কেলের মহাব্যবস্থাপক হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করছেন।
স্কুলের দেয়াল পত্রিকা থেকে শুরু হয় সাংবাদিকতা। বিএম কলেজে ছাত্র ইউনিয়নের দেয়াল পত্রিকা ‘জয়ধ্বনি’ এবং হিসাববিজ্ঞান বিভাগের দেয়াল পত্রিকা ‘কস্তুরী’। বরিশাল থেকে প্রকাশিত লিটল ম্যাগাজিন ‘অগ্রণী’ এবং ‘জয়ধ্বনি’, বরগুনা থেকে প্রকাশিত ‘উপকূল’, পটুয়াখালী থেকে প্রকাশিত ‘পটুয়া’ ও সদ্য প্রকাশিত ‘জলাঙ্গী’ এবং রবীন্দ্রনাথের শার্ধশততম জন্মবর্ষের প্রকাশনা ‘রবীন্দ্র স্মারক’ এর সম্পাদনা এবং ‘জীবনানন্দ’, ‘চেতনা’, ‘আলোকিত সাম্য’ ইত্যাদির প্রকাশনা সহযোগী এবং সাপ্তাহিক একতা, সাপ্তাহিক কাগজ, মাসিক আনন্দলিখন এর জেলা প্রতিনিধি এবং দৈনিক সংবাদ ও দৈনিক আজকের কাগজে খন্ডকালীন সাংবাদিকতা করেছেন। রাজনৈতিক জীবনে স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে ১৯৮০ সন পর্যন্ত বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কর্মী। ছাত্রলীগ দ্বিখন্ডিত হয়ে জাতীয় ছাত্রলীগ গঠনের প্রাক্কালে সমাজতন্ত্রের প্রশ্নে মতপার্থক্যের কারণে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নে যোগদান। ছাত্র ইউনিয়ন বিএম কলেজ কমিটির সাংস্কৃতিক সম্পাদক, জহুরুল হক হল কমিটির সাংস্কৃতিক সম্পাদক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির সাংস্কৃতিক সম্পাদক। বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন, বরিশাল জেলা কমিটির দপ্তর সম্পাদক। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, বরিশাল জেলা কমিটির সরকারি কর্মচারী ইউনিটের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বরিশাল উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী থেকে কাজ শুরু করেন। বরিশাল জেলা সংসদে কোষাধ্যক্ষ (দুইবার) এবং সহ-সভাপতি, পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলা সংসদের সহ-সভাপতি, বাউফল উপজেলা শাখা ও ভোলা জেলা সংসদের সভাপতি এবং বরিশাল বিভাগীয় কমিটি ও জাতীয় পরিষদ সদস্য রয়েছেন। ছায়াঘেরা খেলাঘর ও জাগৃহী খেলাঘর আসর বরিশাল’র সদস্য, বাউফল তেঁতুলিয়া খেলাঘর আসরের সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় কবিতা পরিষদের সহ-সম্পাদক, দখিনা খেলাঘর আসর’র সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। কবি আবুল বাসার সেরনিয়াবাদের প্রকাশিত ও প্রকাশিতব্য গ্রন্থসমূহ হচ্ছে বিকলাঙ্গ বোধ (১৯৮৫), বুকের মধ্যে উজানী নাও (১৯৯৬), বাসন্তী তোমাকে আজো (১৯৯৮), মোহন্ত কবিতাগুচ্ছ (১৯৯৮০), শোকার্ত কবিতাগুচ্ছ (২০০২), পাঁচ পাতার অরণ্য (যৌথ-২০০৬), স্বরচিত সন্ন্যাসে (২০১৩), দুঃখবতী হৃদয় শিয়রে (২০১৩), কবিতা সমগ্র-১ (২০১৩), রিক্তকরা ডাকগুলো (প্রকাশিতব্য), চার প্রহরের দিনকাল (যৌথ, ২০০৯), স্বপ্নমন্ত গল্পকথা (২০১২)।
তিনি এ জীবনে বিভিন্ন সংগঠন থেকে অনেকগুলো পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে পূবালী ব্যাংক পুরস্কার (১৯৮৫), দক্ষিণ বাংলা সাহিত্য পদক (২০০২), জীবনানন্দ দাশ সাহিত্য পদক (২০০৩), বঙ্গবন্ধু স্মৃতিপদক (২০১০), কবিতা পরিষদ, বরিশাল এর সম্মাননা ও পদক (২০১০), মহাত্মা গান্ধী স্বর্ণ পদক (২০১০), পটুয়াখালী জার্নালিস্ট ডেভেলপমেন্ট ট্রাস্ট কর্তৃক নাগরিক সংবর্ধনা ও পদক (২০১০), মাদার তেরেসা স্বর্ণপদক(২০১৩), আব্রাহাম লিংকন স্মারক সম্মাননা(২০১৩),মাদার তেরেসা স্মারক সম্মননা(২০১৩),কবি নজরুল স্মৃতি পদক(২০১৩), মাওলানা ভাসানী গোল্ড এওয়ার্ড(২০১৩) সহ আরো অনেক পুরস্কার ও সম্মাননায় ভুষিত হয়েছেন নিভৃতচারী এই কবি।

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন    
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী মিরাজ মাহমুদ
 
বার্তা ও বানিজ্যিক কার্যালয়ঃ কুশলা হাউজ, ১৩৮ বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সড়ক,
সদর রোড (শহীদ মিনারের বিপরীতে), বরিশাল-৮২০০।
© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
Developed by NEXTZEN-IT