4:09 pm , August 16, 2023
নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ বরিশালে ডেঙ্গু আক্রান্ত এক বৃদ্ধর মৃত্যু হয়েছে। বরিশাল শেরই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয় বলে বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. শ্যামল কৃষ্ণ মন্ডল জানিয়েছে। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর বৃদ্ধি পাওয়ায় গত ১৫ দিন ধরে বিভিন্ন ধরনের স্যালাইনের সংকট দেখা দিয়েছে। ফার্মেসীতে পাওয়ায় যাচ্ছে না স্যালাইন। দুই একটি পাওয়া গেলেও দাম বেশি নেয়ার অভিযোগ করেছেন রোগীর স্বজনরা। হাসপাতালে প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সামান্য স্যালাইন সরবরাহ রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। মঙ্গলবার বরিশাল শেরই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাওয়া বৃদ্ধ হলেন মমিনুল ইসলাম (৮০)। সে নগরীর সাগরদী এলাকার বাসিন্দা। এ নিয়ে বরিশাল বিভাগে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ২৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে বরিশাল শেরই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৭ জনের মৃত্যু হয়। এছাড়া ভোলায় ৪ জন, পিরোজপুর ও বরগুনায় দুইজন করে মারা গেছে। বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য দপ্তর জানিয়েছে, গত ২৪ ঘন্টায় বরিশাল বিভাগের দুই মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ৬ জেলা সদর হাসপাতালসহ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নতুন করে ২৩৮ জন নতুন রোগী ভর্তি হয়েছেন। গত ১ জানুয়ারী থেকে বুধবার বেলা ১২ টা পর্যন্ত বিভাগের হাসপাতালগুলোতে ১০ হাজার ১৮৫ জন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়। এর মধ্যে ৯ হাজার ১৯০ জন সুস্থ হয়েছে। বর্তমানে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ৯৭০ জন। এর মধ্যে মারা গেছে ২৫ জন।
স্যালাইন সংকট ঃ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকায় বরিশাল নগরীর বিভিন্ন ফার্মেসীতে স্যালাইন সংকট দেখা দিয়েছে। বরিশাল শেরই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চাহিদার তুলনায় খুব সামান্য স্যালাইন সরবরাহ করা হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
বরিশাল শেরই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে অন্তত ১০টি ফার্মেসী ঘুরে জানা গেছে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তদের জন্য প্রথমে ইনফিউশন (এসএস) স্যালাইন দিতে হয়। সেই স্যালাইন নেই। নরমাল স্যালাইন হিসেবে পরিচিত এ স্যালাইনের কোন সরবরাহ নেই বলে জানালেন রাহাত মেডিকেল হলের কর্মচারী রানা। তিনি বলেন, একটু সময় অপেক্ষা করেন। দেখবেন কতজন স্যালাইন নিতে আসে।
ফার্মেসীতে দশ মিনিট সময় অবস্থানের মধ্যে চারজন ক্রেতা হন্যে হয়ে এসে জানতে চাইলেন ভাই নরমাল স্যালাইন আছে কিনা। সকলকে নেই জানালে রোগীর স্বজনরা হতাশ হয়ে অন্য দোকানের উদ্দেশ্যে ছুটে গেছেন।
এর মধ্যে বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলা থেকে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগী নিয়ে স্যালাইন কিনতে আসা মো. হোসেন জানান, বন্ধুর স্ত্রী অঞ্জনা ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত। তাকে নিয়ে হাসপাতালে এনে ভর্তি করার পর স্যালাইন নিতে পাঠিয়েছেন। কারন হাসপাতালে ওই স্যালাইন নেই। কিন্তু বিভিন্ন দোকান ঘরে স্যালাইন পাচ্ছেন তিনি।
ফার্মেসীর কর্মচারী রানা বলেন, বর্তমানে নরমাল স্যালাইন (এনএস), এইচএস, ডিএনএস ও ০.৫ ডিএ প্রয়োজন। এর মধ্যে নরমাল স্যালাইন সংকট হয়েছে। তিনি জানান, তাদের আজ মাত্র এক কেস সরবরাহ করা হয়েছে। দোকান খোলার পর মুহুর্তের মধ্যে সেই স্যালাইন বিক্রি হয়েছে।
রানা বলেন, নরমাল স্যালাইনের দাম ৯০ টাকা। শুনেছি অনেকে বেশি দামেও বিক্রি করে। তিনশ চারশ টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে বলে শুনেছেন তিনি।
এরমধ্যে ক্লান্ত ও হতাশ অবস্থায় ছুটে এসে নরমাল স্যালাইন চাওয় রোগীর স্বজন উজ্জল বলেন, এখন পর্যন্ত চারটি ফার্মেসীতে গিয়েছি। কিন্তু স্যালাইন পাচ্ছি না। কোথা গেলে পাবো বলতে পারেন। কোথায় পাবেন সেই উত্তর দোকানের কেউ দিতে পারেনি। অপর কর্মচারী সাকিব বলেন, শুনেছি কিছু ফার্মেসী ঢাকা থেকে স্যালাইন এনে বিক্রি করে। তাই একটু বেশি দামে বিক্রি করতে হয়। তিনি জানান, নরমাল স্যালাইন উৎপাদন করে পপুলার, অপসোনিন, বে´িমকো, ওরিয়ন ও একমি। কিন্তু তারা সরবরাহ কম করছে। কি কারনে করছে জানি না।
বরিশাল শেরই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে, মেডিসিন ভবনের নিচতলা থেকে চারতলায় হাটার মতো অবস্থা নেই। যে যেখানে একটু স্থান পেয়েছে, সেখানে বিছানা পেতে শুয়ে আছেন। ভবনের দ্বিতীয় তলার একটি ইউনিটের সেবিকা নিপা বিশ্বাস বলেন, প্রতিদিন একজন রোগীকে একটি করে নরমাল স্যালাইন দেয়া যায়। কিন্তু একেকজনের প্রতিদিন চারটি করে প্রয়োজন। সেটা কিভাবে দেয়া যাবে। গত কয়েকদিন ধরে নরমাল স্যালাইনের তো কোন সরবরাহ ছিলো না। আজ (বুধবার) ১৫টির মধ্যে পেয়েছি। তার ইউনিটের বর্তমানে ৯২ জন চিকিৎসাধীন রয়েছেন। ১৫ টি দিয়ে কিভাবে চিকিৎসা সেবা দেয়া সম্ভব প্রশ্ন করে সেবিকা বলেন, অনেক গরীর রোগী আছে। তাদের কোন ঔষধ কেনার সামর্থ্য নেই। তাদের জন্য তো কিছু রেখে দিতে হয়।
বরিশাল সদর হাসপাতালের সামনে নুবা ড্রাগ হাউজের মালিক সোহেল বলেন, গত ১৫ দিন ধরে নরমাল স্যালাইন নেই। কোথাও পাওয়া যায় না। হাসপাতালেও সরবরাহ নেই।
এ বিষয়ে বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. শ্যামল কৃষ্ণ মন্ডল বলেন, বেসরকারীভাবে হয়তো সমস্যা হতে পারে। কিন্তু সরকারী হাসপাতালে সমস্যা থাকার কথা নয়। রোগী বাড়ার কারনে হয়তো একটু সমস্যা হতে পারে। আমরা চাহিদা পাঠিয়েছি। সমস্যা থাকবে না।
পরিচালক আরো বলেন, প্রত্যেক হাসপাতালে বলে দিয়েছি। ডেঙ্গু আক্রান্তদের চিকিৎসায় কোন ঘাটতি যেন না থাকে। তাদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
ডেঙ্গু সচেতনায় জেলা প্রশাসনের প্রচারনা ঃ ডেঙ্গুসহ অন্যান্য মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধে গণসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে সর্বসাধারণের মাঝে লিফলেট বিতরণ করেছে বরিশাল জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা। বুধবার বরিশালের জেলা প্রশাসনের আয়োজনে নগরীর অশ্বিনী কুমার হল চত্বরে লিফলেট বিতরণ ও পথসভা করা হয়।বরিশাল জেলা প্রশাসক শহিদুল ইসলামের নেতৃত্বে লিফলেট বিতরণে উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোঃ সোহেল মারুফ, সিনিয়র সহকারী কমিশনার মোঃ মহিন উদ্দিন, সহকারী কমিশনার মো. জাবেদ হোসেন চৌধুরী, দেবযানী কর, রয়া ত্রিপুরা ও ফাইজা বীসরাত হোসেন প্রমুখ।এ সময় বরিশালের জেলা প্রশাসক বলেন, দেশের অন্যান্য স্থানের ন্যায় বরিশালেও এবারে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি। আর এটি মোকাবেলায় আমাদের সকলের প্রয়োজন সচেতন হওয়া। যাতে ডেঙ্গুসহ সকল মশার বংশ বিস্তার রোধে সকল মানুষ এগিয়ে আসে। এজন্য সরকার ও স্বাস্থ্য বিভাগের যে বার্তা রয়েছে সেটিই আমরা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে লিফলেট আকারে সাধারণ মানুষের মাঝে বিতরণ করলাম। পাশাপাশি সকলকে সচেতন করার জন্য নাগরিকদের সাথে আমরা কথাও বলেছি।তিনি বলেন, সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে, ঘরবাড়ি ও আঙ্গিনা সবাইকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। মশার বংশ বিস্তার যাতে না ঘটে সেদিকে লক্ষ রেখে সবাইকে কাজ করতে হবে। আমরা জনসমাগমপূর্ণ এলাকাসহ বিদ্যালয়গুলোতে প্রচারণা চালাচ্ছি, এছাড়া নগরজুড়ে মাইকিংও করা হচ্ছে। এছাড়া সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানসহ স্থানীয় সরকারে প্রতিটি দপ্তরকে এ বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।জ্বর হলেই সবাইকে চিকিৎসকের স্মরনাপন্য হওয়ার আহবান জানিয়ে তিনি বলেন, জ্বর হলে কোনভাবে অবহেলা নয়, চিকিৎসকের শরনাপন্ন হোন। এতে সঠিক চিকিৎসায় আরোগ্য দ্রুত আরোগ্য লাভ করা যায়।সচেতনতা বার্তায় বলা হয়েছে, ডেঙ্গু একটি ভাইরাসজনিত রোগ যা এডিস মশার মাধ্যমে ছড়ায়। এই মশা সাধারণতঃ ভোরবেলা ও সন্ধ্যার পূর্বে কামড়ায়। সাধারণ চিকিৎসাতেই ডেঙ্গু জ্বর সেরে যায়, তবে ডেঙ্গু শক সিনড্রোম এবং হেমোরেজিক ডেঙ্গু জ্বর মারাত্মক হতে পারে। বর্ষার সময় সাধারণত এ রোগের প্রকোপ বাড়ে। এডিস মশার বংশ বৃদ্ধি রোধের মাধ্যমে ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধ করা যায়। আপনার ঘরে এবং আশেপাশে যে কোন জায়গায় পানি জমতে না দেয়া। ফলে এডিস মশার লার্ভা জন্মাতে পারবে না। ব্যবহৃত পাত্রের গায়ে লেগে থাকা মশার ডিম অপসারণে পাত্রটি ব্লিচিং পাউডার দিয়ে ঘষে পরিষ্কার করতে হবে। ফুলের টব, প্লাস্টিকের পাত্র, পরিত্যক্ত টায়ার, প্লাস্টিকের ড্রাম,মাটির পাত্র, বালতি, টিনের কৌটা, ডাবের খোসা/নারিকেলের মালা, কন্টেইনার, মটকা, ব্যাটারী শেল ইত্যাদিতে এডিস মশা ডিম পড়ে। কাজেই এগুলো বর্জ্য হিসেবে ব্যবস্থা নেয়া। ব্যবহৃত পানির পাত্র ধ্বংস অথবা উল্টে রাখতে হবে যাতে পানি না জমে। দিনে অথবা রাতে ঘুমানোর সময় অবশ্যই মশারী ব্যবহার করুন।