বৈশাখিনী-’৭১ এর বৈশাখী ঝড় বৈশাখিনী-’৭১ এর বৈশাখী ঝড় - ajkerparibartan.com
বৈশাখিনী-’৭১ এর বৈশাখী ঝড়

3:33 pm , December 15, 2018

১৯৭১-আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাল। ৩০ লাখ শহীদের রক্ত আর ২ লাখ নারীর অপমানের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতা। একদিকে সমষ্টিগতভাবে স্বাধীনতা আমাদের কাছে পরম প্রাপ্তির সূর্যালোক, অন্যদিকে এ অর্জনের জন্য আমাদের অনেককেই নিতে হয়েছে ক্লেদাক্ত পঙ্কিল অন্ধকারের আস্বাদন। যার অভিঘাত এখনো শেষ হয়ে যায়নি। কবে যে শেষ হবে তাও অনিশ্চিত। বৈশাখিনী নাটকের মেসেজ অনুযায়ী শতাব্দীর পর শতাব্দী। বরিশালের অন্যতম গ্রুপ থিয়েটার সংগঠন শব্দাবলীর নবতম প্রযোজনা বৈশাখিনী-এক স্বচ্ছ আয়নার উপর বাঙালির আত্মনিমগ্নতার প্রতিবিম্বিত চিত্র। তাদের নিজেদের গড়া স্টুডিও থিয়েটারে প্রযোজনাটি দেখতে দেখতে কখনো গা শিউরে ওঠে, কখনো কণ্ঠ বাষ্পরুদ্ধ হয় আবার কখনো বা আত্মধিক্কারে বিবেক রি রি করে ওঠে। তবুও বাকশূন্য আত্মসম্মোহিত দৃষ্টিতে তা দেখে যেতে হয়, কারণ এ যে বাঙালিরই জীবননাট্য। চার নারাীর পরষ্পরার আখ্যানচক্র এ নাটক। নূরজাহান একজন মুক্তিযোদ্ধার কন্যা, কিন্তু বিয়ে হয় পাকিস্তানীদের পদলেহী খান বাহাদুরের সাথে। যিনি মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধ শক্তির সাথে যোগসাজসে বাঙালির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে মেতে থাকে। বিধির বিধান, মুক্তিযুদ্ধকালে তার মুক্তমনা কন্যা শাহজাদীকে পাকিস্তানী সেনারা ধরে নিয়ে যায়। প্রেমিক বাহার কাপুরুষোচিত আত্মসমর্পন করে নদীতে ঝাঁপ দেয়। দীর্ঘ নয় মাস শাহজাদী মিলিটারি ক্যাম্পে অবর্ণনীয় শারিরীক/মানসিক নির্যাতন ভোগ করে যখন স্বাধীন মাটিতে পা রাখেন তখন তাকে আশ্রয় দেবার মতো কেউ নেই। মা নূরজাহানের ঐকান্তিক ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও জন্মদাতা বাবার কারণে কোলে টেনে নেয়া সম্ভব হয়নি। সুযোগসন্ধানী বাহার তখন প্রবাসে। নিয়তির টানে উপায়হীন শাহজাদী চলে আসেন রাজশাহীর হিজলতলা এবং সেখানেই আস্তানা গাড়েন। সম্বল এনজিওর দেয়া একখানা সেলাই মেশিন। একদা তার গর্ভে অঙ্কুরিত হওয়া যুদ্ধশিশু জেসমিনের জন্ম হয়। অত:পর একটি সেলাই মেশিনকে অবলম্বন করে মা-মেয়ের জীবনযুদ্ধ শুরু হয়। কালান্তরে জেসমিনের সাথে যে পাপাচারী পুরুষের সম্পর্ক হয় তার অবৈধ ঔরষে জন্ম নেয় রুমু। রুমু এখন পূর্ণযৌবনা-রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। সে মা এবং নানীর জীবনে ঘটে যাওয়া সকল ঘটনঅঘটনের একমাত্র সাক্ষী। নানীর সাথে তার ঐকমত্য হয় যে তারা কোন অবস্থাতেই খান বাহাদুরের কাছে ফিরে যাবে না। কিন্ত রুমুর মা জেসমিনের লোভ হয় নানী নূরজাহানের সাথে দেখা করবার। তাকে নানার সম্পত্তির ব্যাপারে আরও প্রলুদ্ধ করে রুমুর প্রেমিক সাকিব। যখন জেসমিনের সাথে তার নানীর সাক্ষাৎ হয় তখন নূরজাহান মৃত্যুশয্যায়। জেসমিনের সাথে তার নানা খান বাহাদুরেরও
দেখা হয়-তিনি এখন স্বাধীন দেশের প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিত্ব। জেসমিন বরিশালে এসেই জানতে পারেন যে তার নানা-নানীর বাক্যালাপ দীর্ঘকাল বন্ধ। মৃত্যুপথযাত্রী নানীর সাথে তার কথোপকথনের এক মুহূর্তে নূরজাহান শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন। নাটক বৈশাখিনীর এখানেই পর্দা নামে।
এ নাটক শুধু আমাদের অস্তিত্বের প্রতিবিধানই নয়, নয় নিছক বীরাঙ্গনা কাব্য-এ আমাদের মতো পশ্চাৎপদ সমাজে নিয়ত লড়াই করে যাওয়া নারীর জীবনসংগ্রামের প্রতিলিপি-নারীমুক্তির আর্তধ্বনী। সংলাপের মধ্যে ডুবে যেতে যেতে নিজেকে তা থেকে আলাদা করা দু:সাধ্য। নাটকটি যথার্থভাবেই উৎসর্গ করা হয়েছে সদ্য প্রয়াত বীর প্রতীক তারামন বিবিকে। সেইসাথে ৭১ এর সংঘঠিত যুদ্ধাপরাধের জন্য পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিচার চাওয়া হয়েছে, নাটকের মূল কথা এখানটায়ই।
এটি শব্দাবলী প্রযোজনা ৬৬, স্টুডিও থিয়েটার প্রযোজনা ২৭। প্রযোজনা অধিকর্তা সাহান আরা বেগম । এরেনা ফরম্যাটে রূপায়িত বৈশাখিনী নাটকের মূল গল্প চন্দন সেন, নবনাট্যায়ন ড: মাহফুজা হিলালী। নির্দেশক সৈয়দ দুলাল, যিনি শব্দাবলীর কর্ণধারও বটে, তিনি এ নাটকের নির্দেশনা দিয়ে নিজের নামের প্রতি সুবিচার করেছেন। মোট আটটি চরিত্রে অভিনয় করা চার অভিনেত্রী তন্দ্রা, সোনিয়া, মনি এবং সুরভী তাদের স্ব স্ব ক্ষেত্রে সাবলীল-এককথায় অনবদ্য। নাটকের মূল শক্তি এখানেই। মঞ্চ আলো ও শিল্প নির্দেশনায় আমিনুর রহমান মুকুল তার মেধার যথাযত ব্যবহার করেছেন। সুর ও সংগীত পরিচালনায় ইয়াসমিন আলী। নাটকের আবহের সাথে শিল্প সন্মত হয়েছে। পোষাক পরিকল্পনা এত চমৎকার না হলে চারটি মেয়ের পক্ষে এত সহজে চারটি পুরুষ চরিত্র করা সম্ভব ছিলোনা। সংলাপনির্ভর নাটকে কিছু উচ্চারণ কানে বাজে, যা সংশোধনযোগ্য। সবশেষে বলা যায়, সমস্ত মনন দিয়ে দর্শকদের নাটকটি দেখতে হবে। কারণ এ শুধু শব্দাবলীর মঞ্চায়ন না-আমাদের অস্তিত্বের সংবেদনশীল বাস্তবতা। সন্দেহ নেই, নাটক দেখে দর্শক নড়েচড়ে বসবেন।
[শ্যামল সেন : নাট্যকার ও সংগঠক]

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন    
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী মিরাজ মাহমুদ
 
বার্তা ও বানিজ্যিক কার্যালয়ঃ কুশলা হাউজ, ১৩৮ বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সড়ক,
সদর রোড (শহীদ মিনারের বিপরীতে), বরিশাল-৮২০০।
© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
Developed by NEXTZEN-IT