4:03 pm , October 6, 2024
বুধবার বোধন পুজায় ঘটবে জাগরণ
আরিফ আহমেদ, বিশেষ প্রতিবেদক ॥ পুজোর বাকী আর মাত্র একদিন। মাটির প্রলেপের সব কাজ শেষ হয়েছে আরো আগে। চলছে রং তুলির কারুকার্য। রবিবার সকাল থেকে বরিশাল নগরীর ৪৫টি পুজাম-পেই সর্বশেষ রং তুলির আঁচড় কাটতে দেখা গেছে প্রতিমা তৈরির শিল্পীদের। রংয়ের এই কাজের পাশাপাশি শাড়ি গহনায় ক্রমশ ফুটে উঠেছে দুর্গা প্রতিমার অপরুপ রূপ। আগামী ৯ অক্টোবর বুধবার বোধন পুজোর মধ্য দিয়ে জাগরণ হবে হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে শক্তিময়ী দেবী দুর্গার। এবার এই প্রতিমার আসা-যাওয়া সাজানো হয়েছে পালকী ও গজা বা হাতিতে। মহাষষ্ঠী বা বোধন পুজোর মধ্য দিয়ে এই বছর দেবী পালকিতে করে মর্ত্যে আসবেন ও দশমীতে হাতিতে সওয়ার হয়ে বিদায় নেবেন। এর আগে গত ২ অক্টোবর বুধবার ভোর সাড়ে ৫টায় মহালয়া অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে বরিশালে। দুর্গাপুজা উপলক্ষে জেলার ৬০২টি ও নগরীতে ৪৫টি পুজাম-প প্রস্তুত করা হয়েছে। বরিশালের জেলা প্রশাসক দেলোয়ার হোসাইনসহ পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকতারা এসব পুজাম-প পরিদর্শন করে নিরাপত্তা নিশ্চিতে সার্বক্ষণিক পাহারাদার নিযুক্ত করেছেন বলে জানা গেছে। এই পুজার উৎপত্তি বা সূচনা সম্পর্কে ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, হিন্দু সম্প্রদায় তথা বর্তমান সনাতনী ধর্মাবলম্বীদের এই সর্ববৃহৎ দুর্গাপুজা কবে, কখন, কোথায় প্রথম শুরু হয়েছিল-তা নিয়ে ভারতীয় ঐতিহাসিকদের মধ্যে নানা মতভেদ রয়েছে। ভারতের দ্রাবিড় সভ্যতায় মাতৃতান্ত্রিক দ্রাবিড় জাতির মধ্যে মাতৃদেবীর পুজার প্রচলন ছিল। আর্য্য সভ্যতায় প্রাধান্য ছিল দেবতাদের। অনার্য্য সভ্যতায় প্রাধান্য ছিল দেবীদের, তারা পুজিত হতেন আদ্যাশক্তির প্রতীক রুপে। মাতৃতান্ত্রিক পরিবারের গঠন, দায়িত্ববোধ ও উর্বরতা শক্তির সমন্বয়ের কথা বিবেচনা করে অনার্য্য সমাজে গড়ে উঠে মাতৃপ্রধান দেবী সংস্কৃতির ধারণা।
ভারতে অবশ্য মাতৃরুপে দেবী সংস্কৃতির ধারণা অতি প্রাচীন। ইতিহাস থেকে প্রমাণ পাওয়া যায়, প্রায় ২২শ বছর পূর্বে ভারতে প্যালিওলিথিক জনগোষ্ঠি থেকেই দেবী পুজা প্রচলিত শুরু হয়েছিল। হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো সভ্যতা তথা সিন্ধু সভ্যতায় এসে তা আরো গ্রহণযোগ্য, আধুনিক ও বিস্তৃত হয়। মাতৃপ্রধান পরিবারের মা-ই প্রধান শক্তি। তার নেতৃত্বে সংসার পরিচালিত হয়, তার নেতৃত্বে শত্রুনাশ হয়। এই মত অনুসারে দেবী হলেন, শক্তির রূপ, তিনি পরমব্রহ্ম। শাস্ত্রমতে, কালী বিশ্বসৃষ্টির আদি কারণ। অন্যান্য দেব দেবী মানুষের মঙ্গলার্থে তার বিভিন্ন রুপে প্রকাশ মাত্র।
মহাভারত অনুসারে, দুর্গা বিবেচিত হন কালী শক্তির আরেক রুপে। পুরাণ মতে, দুর্গাপুজার ইতিহাস আছে কিন্ত ভক্তদের কাছে সেই ইতিহাস প্রামানিক নয়, বিশ্বাসের। উপমহাদেশের পশ্চিমাঞ্চলে সিন্ধু ও বেলুচিস্তানে শিবকে দিয়ে যে হিন্দুধর্মের যাত্রা শুরু হয়েছিল পূর্বাঞ্চলে। বিশেষ করে বাংলায় দুর্গা ও কালীকে দিয়ে সে ধর্মযাত্রার সমাপ্ত হয়। এরপর সম্ভবত আর কোন অলৌকিক দেবতার জন্ম হয়নি। প্রাচীন বাঙালিরা ছিল অবৈদিক আর অনার্য্য। তারা সুপ্রাচীন কাল থেকেই বহু লৌকিক-অলৌকিক দেবদেবীর পুজা অর্চনা করতো। প্রাচীনকালে দুর্গাপুজা শস্য পুজারুপে বিরাজমান ছিল। পার্বতী-উমা ছিল শস্যপুজার দেবী। পার্বতী-উমা দুর্গারই ভিন্ন ভিন্ন নাম। উমাকে বলা হয় হিমালয়-দুহিতা। যার বাহন সিংহ। সিংহবাহিনী পর্বতকন্যা উমা-পার্বতীই ভারতবর্ষের শক্তি দেবীর প্রাচীন রুপ। এই সিংহবাহিনী পর্বতকন্যা উমা-পার্বতীর সঙ্গে শস্য পুজার ধারা মিশে এক মহাদেবীর সৃষ্টি হয়েছে, তিনিই দুর্গা।
হরপ্পা সভ্যতার ঊষা নামে এক মাতৃকাদেবীর নাম উল্লেখ করেছেন গবেষক ডি ডি কোসাম্বি। গবেষক সুকুমার সেন মনে করেন, ঊষা দেবীর উপাসনা শরৎকালে হত। সেক্ষেত্রে এই শারদীয়া মাতৃকা উপাসনা উপমহাদেশে অন্তত সাড়ে চার হাজার বছর ধরে প্রচলিত বলা যায়। তবে এটাও সত্য, হাজার হাজার বছর ধরে মাতৃকা দেবীপ্রধান এই ভারতে শরৎকালে অনেক দেবীর পুজা হত।
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে আছে, দুর্গাপুজার প্রথম প্রবর্তক শ্রীকৃষ্ণ, তিনি বৈকুন্ঠের আদি বৃন্দাবনের মহারাস ম-লে প্রথম পুজা করেন, এরপর মধু ও কৈটভ নামে দুই অসুরের ভয়ে দ্বিতীয় বার দুর্গাপুজা করেন। স্বয়ং ব্রহ্মা আর ত্রিপুর নামে এক অসুরের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে তৃতীয়বার দুর্গা পুজার আয়োজন করেন মহাদেব। দুর্বাসা মুনির অভিশাপে লক্ষ্মীকে হারিয়ে ইন্দ্র যে পুজার আয়োজন করেছিলেন, সেটি ছিল চতুর্থ দুর্গাপুজা। এরপর থেকেই পৃথিবীতে মুনিঋষি, সিদ্ধপুরুষ, দেবতা ও মানুষেরা নানা দেশে নানা সময়ে দুর্গাপুজা করে আসছে।
শারদীয়া দুর্গাপুজাকে অকালবোধন” বলা হয়। কালিকা পুরাণ ও বৃহদ্ধর্ম পুরাণ অনুসারে, রাম ও রাবণের যুদ্ধের সময় শরৎকালে দুর্গাকে পুজা করা হয়েছিল। হিন্দুশাস্ত্র অনুসারে, শরৎকালে দেবতারা ঘুমিয়ে থাকেন। তাই এই সময়টি তাদের পুজা যথাযথ সময় নয়। অকালের পুজা বলে তাই এই পুজার নাম হয় “অকালবোধন”। এই দুই পুরাণ অনুসারে, রামকে সাহায্য করার জন্য ব্রহ্মা দুর্গার বোধন ও পুজা করিয়েছিলেন। কৃত্তিবাস ওঝা তার রামায়ণে লিখেছেন, রাম স্বয়ং দুর্গার বোধন ও পুজা করেছিলেন। তবে রামায়ণের প্রকৃত রচয়িতা বাল্মীকি মুনি রামায়ণে রামচন্দ্রকৃত দুর্গাপুজার কোনো উল্লেখ করেননি। উপরন্তু রামায়ণের অন্যান্য অনুবাদেও এর কোনো উল্লেখ পাওয়া যায়না। তবে এই প্রচলিত তথ্য অনুসারে স্মৃতিশাস্ত্রসমূহে শরৎকালে দুর্গাপুজার বিধান দেওয়া হয়েছে। হংসনারায়ণ ভট্টাচার্যের মতে, …অকালবোধন শরতে বৈদিক যজ্ঞের আধুনিক রূপায়ণ ছাড়া আর কিছুই না।”
এরই ধারাবাহিকতায় হিন্দু অঞ্চল ভারতের সাথে মিল রেখে বাংলাদেশের সনাতনী ধর্মাবলম্বীদের দুর্গাপুজার যাবতীয় অনুষ্ঠানাদি পালিত হয়ে আসছে। চলতি বছরও প্রতিমা গড়ার কাজ শেষ হলে উলুধ্বনি, কাসর, ঘণ্টা, ঢাকঢোল বাজিয়ে আগামী মঙ্গলবার শুক্লাপঞ্চমী এবং বুধবার ষষ্ঠীপুজা। এ দিন ষষ্ঠীতে শুরু হবে দেবী দুর্গার বোধন। বৃহস্পতিবার সপ্তমী, শুক্রবার অষ্টমী, শনিবার নবমী ও একই তারিখে দশমী পুজা ও প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হবে সনাতনী ধর্মাবলম্বীদের বৃহৎ এই অনুষ্ঠান।
এসময় প্রতিটি দিনই দেব-দেবীর পুজার জন্য রয়েছে বিভিন্ন ধরনের প্রসাদের ব্যবস্থা। এখন পর্যন্ত পুজার প্রস্তুতিতে জেলার বাকেরগঞ্জের শ্যামপুরে একটি ষড়যন্ত্রমুলক ঘটনা ছাড়া আর কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি বলে জানিয়েছেন বরিশালের পুলিশ প্রশাসন।
ইতিমধ্যেই বরিশাল নগরীর গুরুত্বপূর্ণ মন্দিরগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ইসলামি আন্দোলন, জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপির নেতৃবৃন্দ সচেতন অবস্থানের ডাক দিয়েছেন। পুলিশের পক্ষ থেকেও কঠোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। শারদীয় দুর্গা উৎসবকে কেন্দ্র করে চমৎকার আলোকসজ্জা করা হয়েছে অষ্ট?কোনা মঠ, জগন্নাথ ম?ন্দির, শংকর মঠ, কাটপ?ট্রি চার্চওয়ার্ড ও পাষানময়ী কা?লিমাতার মন্দিরসহ সামনের সড়কে। মুলত স্থায়ী ও অস্থায়ী সব মন্দিরের ভিতরে বাহিরে এই আলোকসজ্জা করা হয়েছে বলে জানালেন পূজা উদযাপন কমিটির সভাপতি ভানু লাল দে। এসময় সাবেক সদস্য সচিব সাংবাদিক তম্ময় তপু জানান, জেলায় মোট ৬০২টি পূজাম-প রয়েছে এর মধ্যে নগরীতে ৪৫টি ম-পে শারদীয় উৎসব আয়োজন চলছে। বুধবার বোধন পূজা দিয়ে দুর্গোৎসব শুরু হবে এবং ১২ অক্টোবর দশমীতে সমাপ্তি ঘটবে বলে জানান তিনি।