3:03 pm , July 17, 2019
নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ বিন¤্র শ্রদ্ধা আর অজ¯্র ভালোবাসায় বিদায় জানানো হলো সকলের প্রিয় মুখ বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক সার্জেন্ট এসএম গোলাম কিবরিয়া মিকেলকে। গতকাল বুধবার দুপুরে নিজ গ্রাম পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলার সুবিধপুরে তৃতীয় নামাজেজানাযা শেষে দাদা ও দাদীর কবরের পাশেই চীর নিদ্রায় শায়িত করা হয় তাকে। এসময় গ্রামের বাড়িতে পরিবার, পরিজন এবং প্রতিবেশিদের মধ্যে সৃষ্টি হয় এক হৃদয় বিদারক পরিবেশ।
এর আগে কাভার্ড ভ্যানের চাপায় নিহত সার্জেন্ট কিবরিয়ার মৃতদেহ নিয়ে আসা হয় তার সর্বশেষ কর্মস্থল বরিশাল নগরীতে। তার মৃতদেহ গ্রহনের অপেক্ষায় গভির রাত থেকেই নগরীর গড়িয়ার পারে অবস্থান নেন নগর পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও সহকর্মী সার্জেন্টরা। রাতভর অপেক্ষা করে ভোর সাড়ে ৪টা ২০ মিনিটে কিবরিয়াকে বহনকারী লাশবাহী এ্যাম্বুলেন্স নিয়ে পুলিশ লাইন্সে পৌছান তারা। এখানে আশা মাত্রই কান্নার শব্দে ভাড়ি হয়ে ওঠে আকাশ-বাতাস। স্বজন হারানোর বিলাপ স্তব্দ করে দেয় গোটা পরিবেশ। শেষ বারের মত সহকর্মির মৃত মুখানী দেখতে ছুটে আসেন পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা থেকে শুরু করে কনস্টেবল পর্যন্ত। শুধু পুলিশ বাহিনীর সদস্যরাই নয়, নগরীর বিভিন্ন এলাকা থেকে নানা ধর্ম-বর্ণের মানুষগুলোও ছুটে আসেন তাদের প্রিয় মানুষ সার্জেন্ট কিবরিয়ার মৃত্যু সংবাদ শুনে।
এদিকে নগরীর পুলিশ লাইন্স মাঠে সকাল ৮টায় কিবরিয়া মিকেল এর দ্বিতীয় নামাজে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। যাতে অংশ নেন বরিশাল মেট্রোপিলন পুলিশ কমিশনার মো. শাহাবুদ্দিন খান, পুলিশ সুপার মো. সাইফুল ইসলাম, উপ-পুলিশ কমিশনার (সদর দপ্তর) হাবিবুর রহমান খান, উপ-পুলিশ কমিশনার (নগর বিশেষ শাখা) আবু সালেহ মো. রায়হান সহ জেলা ও মেট্রোপলিটন পুলিশ সহ সাধারণ নগরবাসি।
জানায নামাজ পরবর্তী সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে পুলিশ কমিশনার মো. শাহাবুদ্দিন খান-বিপিএম (বার) বলেন, সার্জেন্ট কিবরিয়া সবার প্রিয় মানুষ ছিলো। নিষ্ঠাবান ও দায়িত্বপরায়ন ছিলো সে। আমরা জনগণের নিরাপত্তায় থাকি। নিরাপদ সড়কের জন্য কাজ করি। বিউটিরত অবস্থায় ঘাতকের আঘাতে কিবরিয়ার মৃত্যু হয়েছে। আমাদেরও ঘাত-অপঘাতে মৃত্যু হতে পারে। তার পরও ঝঝুকির মধ্যে দিয়ে জণগনের নিরাপত্তায় কাজ করে যেতে হবে। হয়তো এই ঝুঁকির মধ্যে আমাদের আরো কোন সদস্যের জীবন চলে যেতে পারে। তবে কিবরিয়া অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।
এদিকে দ্বিতীয় জানাযা নামাজ সার্জেন্ট কিবরিয়াকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়। পুলিশ কমিশনার ছাড়াও নগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ সহ অন্যান্য বিভাগের পক্ষ থেকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন এবং পরবর্তিতে পুলিশ লাইন্সএ তাকে রাষ্ট্রিয় সম্মাননা গার্ড অব অনার ও স্বশস্ত্র সালাম প্রদর্শন করা হয়। দাফনের জন্য কিবরিয়ার মৃতদেহ তার নিজ গ্রামের বাড়ি মির্জাগঞ্জের সুবিধখালী ইউনিয়নের পূর্ব সুবিদখালী গ্রামের উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়া হয়।
বরিশাল থেকে তাকে শেষ বিদায় জানাতে গিয়ে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন তার স্ত্রী ট্রাফিক সার্জেন্ট মৌসুমী আক্তার। বিয়ের মাত্র তিন বছর না যেতেই স্বামীকে হারিয়ে বিধোবার সাজ যেন মেনে নিতে পারছেন না তিনি। স্বামীর স্মৃতিচারণ করে বুক ফাটা আর্তনাদ তার হৃদয়কে ভাড়ি করে তোলে। তাদের দুই বছরের শিশু ওহি কিছু বুঝে না উঠলেও মায়ের কান্না আর বিলাপ দেখে সেও কেঁদে ফেলে অঝরে। যে দৃশ্য পুলিশ লাইন্সএ উপস্থিত প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে নাড়া দেয়। অঝরে কাঁদতে থাকেন তারা। মৌসুমী ও শিশু ওহি’র কান্না দেখে চোখের পানি আটকে রাখতে পারেননি স্বয়ং পুলিশ কমিশনার মো. শাহাবুদ্দিন খান সহ পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। তার মধ্যে দিয়েই চীর বিদায় জানাতে হয়েছে সার্জেন্ট কিবরিয়াকে।
এদিকে দ্বিতীয় জানাযা শেষে গোলাম কিবরিয়া মিকেল এর মৃতদেহ তার নিজ গ্রামের বাড়ি মির্জাগঞ্জের সুবিদখালী নিয়ে যায় তার সহকর্মীরা। পরে সুবিধখালী সরকারি রয় পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে তার কিবরিয়ার তৃতীয় জানাযা নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। জানাযা শেষে সুবিধখালী সরদার বাড়ির পারিবারিক কবরস্থানে দাদা-দাদীর কবরের পাশেই তাকে চিরনিদ্রায় শায়িত নন কিবরিয়া। এর আগে গত মঙ্গলবার বাদ আসর রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে শহীদ শিরু মিয়া মিলনায়তনে কিবরিয়ার প্রথম নামাজে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। এর পর সড়ক পথে মৃতদেহ বরিশালে নিয়ে আসা হয়।
জানাগেছে, ২ বোন ও ৩ ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় কিবরিয়া মিকেল মির্জাগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান যুগ্ম আহ্বায়ক ইউনুস আলী সরদারের ছেলে। পারিবারিক ভাবেই আওয়ামী লীগ ঘরানার কিবরিয়া মিকেল স্কুল জীবনের শুরুটা নিজ এলাকায় পড় করেন। তবে মাধ্যমিকের শুরু হয় পটুয়াখালী সরকারি জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে। সেখান থেকে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেন তিনি। পাশাপাশি ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথেও সম্পৃক্ততা ছিলো তার।
এদিকে ছোট বেলা থেকেই স্বপ্ন ছিলো পুলিশ বিভাগে চাকরী করার। সেই স্বপ্ন পুরন হয় ২০১৫ সালে। ওই সময় তিনি বাংলাদেশ পুলিশের সার্জেন্টের চাকুরীতে যোগদান করেন। তিন বছর পূর্বে ব্যাচমেট ট্রাফিক সার্জেন্ট মৌসুমী আক্তারকে বিয়ে করেন তিনি। তিন বছরের দাম্পত্ত জীবনে তাদের ওহি নামের দুই বছরের পুত্র সন্তান রয়েছে। যোগদানের পর থেকেই বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন কিবরিয়া মিকেল। সেই দায়িত্ব পালন করতে গিয়েই গত ১৫ জুলাই বরিশাল বিশ^বিদ্যালয় এলাকায় যমুনা গ্রুপের কাভার্ডভ্যানের চাপায় গুরুতর আহত হন তিনি। উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নিয়ে গেলে ১৬ জুলাই সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষনা করেন।