6:22 pm , June 6, 2018

রুবেল খান ॥ নগরীর অন্যতম বানিজ্যিক এলাকা চকবাজার, গীর্জা মহল্লা ও কাটপট্টি, পদ্মাবতী। এই এলাকাকে ঘিরেই গঠিত বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের ৯নং ওয়ার্ড। বানিজ্যিক এলাকা ভিত্তিক এই ওয়ার্ডের জনপ্রতিনিধিরাও ব্যবসায়ী। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের ব্যবসায়ীক প্রতিযোগিতা ছাপিয়ে গিয়ে ভোটের লড়াইতে গড়িয়েছে। ইতিপূর্বে ওয়ার্ডটিতে সাধারণ কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন তারা সকলেই ব্যবসায়ী। এমনকি এবারের নির্বাচনেও যারা প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারাও চকবাজার, গীর্জা মহল্লা সহ বিভিন্ন এলাকার ব্যবসায়ী। এদিকে ওয়ার্ডটিতে শহর কেন্দ্রীক বসবাসকারী ভোটারদের নিয়ে তেমন দুশ্চিন্তা নেই প্রার্থীদের। তাদের দুশ্চিন্তার প্রধান কারন হয়ে দাড়িয়েছে ওয়ার্ডের অন্তর্গত রসুলপুর চরের সুবিধা বঞ্ছিত বিশাল জনগোষ্টি ও তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার। কেননা নির্বাচনে কোন প্রতিদ্বন্দ্বীর জয়-পরাজয় নির্ভর করে রসুলপুর চরের ভোটারদের উপর।
সরেজমিনে জানাগেছে, বাণিজ্যিক এলাকা ৯নং ওয়ার্ডের মধ্যেই অবস্থিত দেশের দুটি বৃহত্তর রাজনৈতিক সংগঠন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র দলীয় কার্যালয়। বিগত ২০০৩ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ওয়ার্ডটিতে জনপ্রতিনিধিত্ব করছেন বিএনপি ঘরানার দুই ব্যবসায়ী। এর মধ্যে ২০০৩ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত নির্বাচিত ওয়ার্ড কাউন্সিলর ছিলেন সৈয়দ জামাল হোসেন নোমান। এরপর ২০১৩ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত নির্বাচিত কাউন্সিলর হিসেবে জনপ্রতিনিধিত্ব করছেন বিএনপি ঘরানার অপর ব্যবসায়ী মো. হারুন অর রশিদ।
সর্বশেষ ২০১৩ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে প্রায় পাঁচশত ভোটের ব্যবধানে মহানগর বিএনপি’র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও কাটপট্টি রোডের বাসিন্দা সৈয়দ জামাল হোসেন নোমানকে পরাজিত করে প্রথমবারের মত কাউন্সিলর নির্বাচিত হন হারুন অর রশিদ। আসন্ন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনেও দ্বিতীয় দফায় প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রস্তুতি নিয়েছেন বর্তমান এই কাউন্সিলর। তবে গত প্রায় পাঁচ বছর বর্তমান কাউন্সিলরের দায়িত্ব পালন ও উন্নয়ন নিয়ে নানান অভিযোগ রয়েছে সাবেক কাউন্সিলর এবং ওয়ার্ডের সুবিধা বঞ্চিত ওয়ার্ডবাসীর।
সৈয়দ জামাল হোসেন নোমান বলেন, ৯নং ওয়ার্ডে ইতিপূর্বে যে উন্নয়ন হয়েছে তার সিংহভাগ তার আমলেই হয়েছে। কিন্তু নতুন যে কাউন্সিলর হয়েছেন তিনি সেই উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখেননি। বিশেষ করে ওয়ার্ডের অন্তর্গত রসুলপুর চর এলাকাবাসীর উন্নয়নে তিনি কতুটুকু ভূমিকা রেখেছেন তার স্বাক্ষী ওয়ার্ডবাসী।
তিনি বলেন, সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন করেছি। কাটপট্টির সাথে প্যারারা রোড ও গীর্জা মহল্লার যোগাযোগ সহজ করার লক্ষ্যে বাইপাস সড়ক করা হয়েছে। ওই সময় বাইপাস সড়কটিতে ছোট যান চলাচলের জন্য ড্রেনেজ ব্যবস্থা থাকা ও রাস্তা করার পরিকল্পনা ছিলো। কিন্তু বর্তমান কাউন্সিলর ক্ষমতা গ্রহন করে সেই পরিকল্পনা ভেস্তে দিয়েছেন। তিনি সড়কের সামনেই দোকান বসিয়ে ওই শাখা সড়কটি মানুষের চলাচলের অনুপযোগী করে ফেলেছেন।
তাছাড়া রসুলপুর চর কলোনীর মানুষের যাতায়াত সুবিধার জন্য একটি ব্রিজ নির্মানের পরিকল্পনা ছিলো। সে অনুযায়ী ওই ব্রিজটির অনুকুলে প্রকল্প গ্রহন এমনকি ৮৬ লাখ টাকা বরাদ্দও হয়েছিলো। কিন্তু ক্ষমতা বদলের পরে ব্রিজ নির্মান প্রকল্প আর আলোর মুখ দেখেনি। কাউন্সিলরের অসহযোগিতার কারনেই রসুলপুরবাসীর দুর্ভোগ লাঘব হয়নি। এখনো নৌকা পারাপারের মাধ্যমেই বেশিরভাগ বসবাসকারীদের নগরীতে আসা যাওয়া করতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, ২০১৩ সালের নির্বাচনেও আমার বিজয় নিশ্চিত ছিলো। কিন্তু ষড়যন্ত্রের স্বীকার ও জেলে যাওয়ায় ওই নির্বাচনে হেরে গেছেন। এবার প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিষয়ে সৈয়দ জামাল হোসেন নোমান বলেন, এখনো আমার কোন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। তবে প্রস্তুতি রয়েছে। পরিস্থিতির উপর প্রার্থী হওয়ার বিষয়টি নির্ভর করবে বলে জানিয়েছেন তিনি। অবশ্য সৈয়দ জামাল হোসেন নোমান প্রার্থী না হলে পরিবারের পক্ষে তার ছোট ভাই সৈয়দ হুমায়ুন কবির লিংকু’র নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানিয়েছে একাধিক সূত্র। অবশ্য তেমন করে কিছু ভেবে দেখেননি বলে দাবী করেছেন লিংকু।
এদিকে সরেজমিন পরিদর্শনকালে বর্তমান কাউন্সিলর মো. হারুন অর রশিদ’র সম্পর্কে ভোটাররা দাবী করেছেন, সে সবসময় এলাকাবাসীর পাশে ছিলেন। বিশেষ করে সুবিধাবঞ্চিত রসুলপুর চর কলোনীতে তিনি বেশি সময় দিয়েছেন। এলাকার মানুষের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক উন্নয়নেও কাজ করছেন। ওই ওয়ার্ডের অভ্যন্তরীন যোগাযোগ ব্যবস্থারও উন্নয়ন করেছেন। অবশ্য রসুলপুর চর কলোনীর কিছু অংশের অভিযোগের অন্ত নেই হারুন অর রশিদের বিরুদ্ধে। বিশেষ করে রসুলপুর চরে ভূমিহীনদের জন্য বরাদ্দের খাস জমি বন্টনের নামে বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। তবে কিছু লোকদের অপরিকল্পিত কার্যক্রম ও খামখেয়ালীপনার কারনে অন্ধকারে দিন কাটাতে হয়েছে রসুলপুরবাসীর।
এলাকার একাধিক সূত্র জানিয়েছে, বিগত কাউন্সিলরের আমলে রসুলপুরে বিদ্যুৎ সংযোগের ব্যবস্থা হয়। পরবর্তীতে নতুন কাউন্সিলরের লোক হিসেবে পরিচিত কবির ঢালী একটি মাত্র মিটার এর মাধ্যমে রসুলপুরের প্রায় ১২শ’ পরিবারে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়। বিনিময়ে প্রতিটি পরিবার থেকে ৫/৭ শত টাকা করে আদায় করেন তিনি। যার পুরোটাই চলে যায় কাউন্সিলরের সহযোগী কবির ঢালির পকেটে। যার ফলে বকেয়া বিদ্যুৎ বিলের পাহাড় জমায় বিদ্যুৎ বিভাগ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। সেখানে কিছুদিন মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ’র সহযোগিতায় বিদ্যুৎ এর আলো ফিরে পায় সুবিধাবঞ্চিত রসুলপুরবাসি।
নির্বাচন সহ বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয় বর্তমান কাউন্সিলর মো. হারুন অর রশিদ এর সাথে। দু’দিন ধরে তার নাম্বারের ফোন করা হলেও তিনি তা রিসিভ করেননি। দু’দিন পরে গতকাল বুধবার বিকালে কল ব্যাক করলেও সময়ের অজুহাত দেখিয়ে কথা পরে কথা বলবেন বলে মুঠোফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেন। কিন্তু পরবর্তীতে তার সাথে আর যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। অবশ্য তার স্ত্রী জানিয়েছেন, নির্বাচনের পর থেকেই হারুন অর রশিদ ভোটারদের যথেষ্ট সময় দিয়েছেন। তাদের পাশে থাকার চেষ্টা করেছেন। এলাকাবাসির উন্নয়ন এমনকি রসুলপুরবাসির যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন করে দিয়েছেন। তাই জনগন তাকে পুনরায় কাউন্সিলর হিসেবে যাচ্ছেন। যে কারনে হারুন অর রশিদ পুনরায় নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন তার স্ত্রী।
এদিকে এবারের নির্বাচনে ৯নং ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রস্তুতি নিয়েছেন ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান মাসুম ভূইয়া। যিনি ২০০৮ সালে ওই ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। একজন ভালো ফুটবলার হিসেবে সু-পরিচিত মাসুম ভূইয়া পেশায় বই লাইব্রেরীর ব্যবসা করেন। তবে নির্বাচনে দলীয় সমর্থন পাওয়ার বিষয়ে তার বাঁধা হয়ে দাড়াতে পারে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এর পদটি। অবশ্য মোস্তাফিজুর রহমান মাসুম ভূইয়া জানিয়েছেন, নির্বাচন করতে হলে যেসব সিদ্ধান্ত এবং নিয়ম রয়েছে তা মান্য করেই নির্বাচনে অংশগ্রহন করবেন তিনি। তবে সেটা দলের উপর নির্ভর করবে।
এই ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আরো একজনের নাম জানাগেছে। তিনি হলেন ফলপট্টি এলাকার আবাসিক হোটেল ব্যবসায়ী খাজা নজরুল। হোটেল পার্ক এর মালিক ও আওয়ামী লীগের নিবেদিত প্রান হিসেবে পরিচিত খাজা নজরুল হাজী শুক্কুর মিয়ার ছেলে। যিনি স্বাধীনতা পরবর্তী বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মন্ত্রি মর্যাদার আলহাজ্ব আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ-এমপি’র অনুসারী হিসেবে রাজনীতি করেছেন। স্বাধীনতা যুদ্ধ পরবর্তী বরিশাল পৌরসভার কমিশনারও ছিলেন।
ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র জানায়, মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি’র অনুসারী ছিলেন বর্তমান ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান মাসুম ভূইয়া। যে কারনে হিরনের মৃত্যুর পর পরই নিস্ক্রিয় হয়ে যান মাসুম। দীর্ঘ তিন বছর রাজনীতে পদচারনা ছিলো না তার। সেই মুহুর্তে ওয়ার্ড আ’লীগের হাল ধরেন খাজা নজরুল। দলের প্রচার-প্রচারনা ও বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে তিনি আ’লীগ এর কার্যক্রমের জানান দেন। যে কারনে এবারের নির্বাচনে ওয়ার্ড আ’লীগের বিশাল সমর্থক গোষ্টি তাকে কাউন্সিলর পদের প্রার্থী হিসেবেও দেখতে চান। তবে নির্বাচন ও প্রার্থী হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হতে খাজা নজরুল এর সাথে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
এর বাইরে ৯নং ওয়ার্ডে প্রার্থী হিসেবে নাম শোনা যাচ্ছে শামীম ভূইয়া নামের অপর এক ব্যবসায়ীর। যিনি পদ্মাবতী এলাকার বাসিন্দা। তবে বিষয়টি নিশ্চিত হতে বিএনপি ঘরানার এই ব্যক্তির সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তার নাম্বারটি বন্ধ পাওয়া যায়।
এছাড়া ৯নং ওয়ার্ডে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এর হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার কথা রয়েছে স্থানীয় বাসিন্দা শিল্পপতি আলহাজ্ব মো. মনোয়ার জাহান মাসুম ভূইয়ার। তিনি ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ মডেল উত্তর থানা কমিটির নির্বাহী সদস্য। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এর পক্ষে ওয়ার্ডে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য দলীয় ভাবে তাকে সমর্থন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মহানগর ইসলামী আন্দোলনের দপ্তর সম্পাদক।
এছাড়া বামপন্থি রাজনৈতিক সংগঠন কমিউনিস্ট পার্টি থেকেও ৯নং ওয়ার্ডে প্রার্থী মনোনিত করা হয়েছে। দলের হয়ে এই ওয়ার্ডে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন সম্পা দাস। যিনি ছাত্র ইউনিয়ন বরিশাল জেলা কমিটির সম্পাদক।