3:18 pm , January 7, 2025
বিশেষ প্রতিবেদক ॥ শের ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে জরুরী ভিত্তিতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও টেকনিশিয়ান প্রয়োজন। গত ১৫ বছর ধরে এ দাবি জানিয়ে আসছে বরিশালের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সুশীল সমাজ এবং হাসপাতাল প্রশাসনও। ইতিপূর্বে এ নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে, হয়েছে বৈঠক। কিন্তু ঢাকা থেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বরিশালের জন্য পাঠানো হলেও তাদের কেউ কেউ আজ পর্যন্ত এসে পৌঁছায়নি আবার কেউ কেউ এসে ষড়যন্ত্রের মুখে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছেন।
সবচেয়ে বড় অভিযোগ হলো সরকারের কোটি কোটি টাকার অত্যাধুনিক মেশিন নষ্ট হয়ে পড়ে থাকছে বছরের পর বছর। ইচ্ছে করেই নাকি বিশেষ সুবিধার আশায় এগুলো নষ্ট করে ফেলে রাখা হয়। চক্ষু বিভাগের জন্য নিয়ে আসা মেশিনটি কোনো দিন ব্যবহারই হয়নি। কারণ এটি চালাতে সক্ষম লোকবল এখানে নেই। তাহলে এটি নষ্ট না ভালো কি করে বুঝা যাবে? এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে গত ৭ জানুয়ারী বরিশালের সুশীল সমাজের প্রতিনিধি কাজী মিজানুর রহমান এর সাথে মতবিনিময় করেছেন শের ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (শেবাচিম) পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মশিউল মুনীর। তিনি নিজেও তখন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও টেকনিশিয়ান জরুরী প্রয়োজন বলে স্বীকার করেন। এসময় কাজী মিজানুর রহমান তার একটি উন্নয়ন প্রতিবেদন হাসপাতাল পরিচালকের হাতে তুলে দেন। মূলত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের বদৌলতে এই প্রতিবেদনটি নজরে আসায় পরিচালক মশিউল মুনীর সুশীল সমাজের প্রতিনিধি কাজী মিজানের সাথে মতবিনিময় করার আগ্রহ প্রকাশ করেন।
কাজী মিজানুর রহমান শের ই বাংলা হাসপাতাল ও সরকারি জেনারেল হাসপাতালে উন্নত সেবা নিশ্চিত করতে ২২টি প্রস্তাবনা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম সরকারি হাসপাতাল শের-ই-বাংলা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় ও জেনারেল হাসপাতাল বহু বছর ধরে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে ব্যর্থ হয়েছে। দুটি হাসপাতালেরই প্রায় একই সমস্যা। বিশেষায়িত চিকিৎসা নেই, একটু জটিল রোগী হলেই ঢাকায় রেফার করার প্রবনতা দেখা যায়। যন্ত্রপাতি, চিকিৎসা সরঞ্জামাদি বেশিরভাগই নষ্ট থাকে, কোন কোন যন্ত্র নির্দিষ্ট সময়ে চালু না করায় প্যাকেটেই মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়। অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থা ভঙ্গুর। ডাক্তার, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকসহ প্রয়োজনীয় সংখ্যক দক্ষ জনবলের অভাব প্রকট। ১০০০ বেডের হাসপাতালে ২৫০০ থেকে ৩০০০ রোগী ভর্তি থাকে। অপরিচ্ছন্নতার অভিযোগ বর্তমান পরিচালকের হস্তক্ষেপে কিছুটা সহনীয় হলেও দালাল ও ওষুধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধিদের উৎপাত এখনো অসহনীয়।
এই অচলাবস্থা থেকে উত্তরনের জন্য এবং দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের স্বল্প খরচে, মানসম্মত চিকিৎসা সেবা পাওয়ার অধিকার সমুন্নত রাখতে বরিশালের হাসপাতাল দুটির স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও প্রশাসককে কঠিন হতে হবে। এজন্য প্রয়োজনে দলমত নির্বিশেষে নাগরিক সংলাপ ও সহযোগিতা নিয়ে বহু বছরের অনিয়ম ও পুঞ্জিভূত সমস্যার সমাধান করতে হবে। হাসপাতাল দুটির ব্যবস্থাপনাতেই ত্রুটি রয়েছে দাবী করে কাজী মিজানুর রহমান বলেন, এই প্রতিবেদনটি মূলত সরকারের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হাতে পৌঁছে দিতে তৈরি করা হয়েছিল। শেবাচিম পরিচালকের আগ্রহের কারণে এটি তার হাতে তুলে দেয়া হয়েছে।
কাজী মিজান বলেন, দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত এ ব্যর্থতা থেকে রাতারাতি উত্তরনের সম্ভাবনা প্রায় অসম্ভব। স্বল্প, মধ্যম এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে হাসপাতাল দুটির সেবার মান বৃদ্ধির পরিকল্পনা নেয়ার বিকল্প নেই। আমাদের দাবীর মুখে সেনাবাহিনী থেকে পরিচালক আমরা পেয়েছি। এবার তার হাত ও কাজকে শক্তিশালী করতে নি¤েœাক্ত প্রস্তাবনা বিবেচনা করা যেতে পারে।
প্রস্তাবনাগুলো হলো : পরিচালক এর অফিস সময়সূচি অন্য সরকারি দপ্তরের ন্যায় ৯টা-৫টা করা হলে সেবা প্রত্যাশীদের অনেক দুর্ভোগ কমে আসবে। পুরো হাসপাতাল সিসি ক্যামেরার আওতাভুক্ত করা প্রয়োজন। সুশৃঙ্খল বাহিনীর প্রশিক্ষিত জনবলের সমন্বয়ে কন্ট্রোল রুম স্থাপন করা হলে যাবতীয় তদারকি বিশেষত সকল প্রকার টেষ্ট, ওষুধ বিতরণ, খাদ্য প্রস্তুত, অবাঞ্ছিত প্রবেশ রোধ নিশ্চিতসহ সর্বত্র শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। বিক্রয় প্রতিনিধিদের হাসপাতাল কম্পাউন্ডে প্রবেশ একেবারে নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন। এদের কারনে ডাক্তারদের প্রচুর সময় অপচয় হয়, রোগী সেবা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হন। এছাড়াও এদের বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের অভিযোগ আছে। ওষুধ প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলোকে হাসপাতালে প্রতিনিধি প্রেরণ না করার জন্য অনুরোধ জানানো যেতে পারে। হাসপাতালের ভিতর ও বাইরের পরিচ্ছন্নতা সমান হতে হবে। আমরা ঝকঝকে তকতকে পরিবেশ চাই। কোন সুস্থ মানুষের পক্ষে হাসপাতালের ওয়াশরুম ব্যবহার অসম্ভব। ওয়াশরুম সার্বক্ষণিক পরিচ্ছন্ন রাখতে কঠোর তদারকির বিকল্প নাই। সুইপারদের কঠোর নজরদারিতে রাখতে হবে। পেশাদার সুইপারদের নিয়োগে অগ্রাধিকার দেয়া আবশ্যক।
অভিযোগ আছে সরকার নিয়োজিত আয়া, সুইপাররা নিজেরা কোন কাজ করে না। ঠিকা ভিত্তিতে তারা নিজেরা লোক দিয়ে কাজ করায়। এদের দৌরাত্ম, আচরণ অসহনীয়। অনেকের টাকা-পয়সা, মোবাইল ইত্যাদি চুরি হয়।
একাধিক এটেন্ডেট হাসপাতালে প্রবেশ, অবস্থান এবং রাত্রিযাপনের কারনে অপরিচ্ছন্নতা এবং নিরাপত্তার অভাব ঘটে। রাতে বারান্দা মনে হয় সরাইখানা। এ বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ পরিবেশকে স্বাভাবিক-সহনীয় রাখতে সহায়তা করবে।
অন্তত ৪টি নতুন এম্বুলেন্স দ্রুত সংগ্রহের উদ্যোগ নেয়া জরুরি। সেটা সরকারিভাবে বা ধর্ণাঢ্য ব্যক্তিদের অনুদানে হতে পারে। পাশাপাশি বেসরকারি এম্বুলেন্সগুলো হাসপাতাল কম্পাউন্ডের বাইরে রাখার কঠোর নির্দেশ প্রয়োজন। বিপদের সময় মানুষের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে যোগসাজশে এরা রোগিকে অমানবিকভাবে সর্বশান্ত করার একাধিক অভিযোগ রয়েছে।
বেসরকারি এম্বুলেন্স এর যোগাযোগ নম্বর একাধিক দর্শনীয় স্থানে টানানো থাকবে। ডিজিটাল পদ্ধতিতে প্রচার করার সুযোগ নিতে পারে।
ইতিপূর্বে ভারত থেকে উপহারপ্রাপ্ত লাইফ সাপোর্ট এম্বুলেন্স এর ব্যবহার সুফল থেকে বরিশালবাসী বঞ্চিত রয়েছে। এর ব্যবহার নিশ্চিত করতে (জনবল এবং সরঞ্জামাদি) প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ মুমূর্ষু রোগিদের সেবা প্রদানের মান বাড়াতে সহায়ক হবে।
৩য় এবং ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারীদের নিয়মিত বাধ্যতামূলকভাবে নির্দিষ্ট পোষাক পরে আসবে হবে। এটা খুবই জরুরী।
হাসপাতালে সকল পরীক্ষা যাতে নির্ভুলভাবে, কম সময়ে, স্বল্প খরচে, হয়রানিমুক্তভাবে হতে পারে সেই পদক্ষেপ নেয়া এবং এজন্য প্রয়োজনে টিকিট মূল্য বৃদ্ধি করে ১০ টাকার পরিবর্তে ২০ টাকা হতে পারে। এজন্য জনমত জরিপ করে বরিশালের সাধারণ মানুষের সহমত পাওয়া গেছে।
পুরাতন এবং ঝুঁকিপূর্ণ লিফট প্রতিস্থাপন বিবেচনার দাবি সকলের। চিকিৎসা সংক্রান্ত সরঞ্জামাদি স্থানীয়ভাবে মেরামতে সক্ষম জনবলের পদ সৃষ্টি করে নিয়োগ প্রদান করা হলে অনেক ভোগান্তি থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে।
একই ঠিকাদার সিন্ডিকেট দীর্ঘদিন যাবৎ ইডিসিএল বহির্ভূত ওষুধ, ডায়েট সরবরাহ করে আসছে মর্মে অভিযোগ রয়েছে। খাবারের মান অত্যন্ত নি¤œ পর্যায়ের। তদুপরি এই খাবার বাইরেও বিক্রির অভিযোগ রয়েছে। দরিদ্র রোগী সরকারি বরাদ্দ অনুযায়ী সঠিক মান এবং পরিমাণ মত খাবার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, যা খুবই দুর্ভাগ্যজনক।
রোগীদের কক্ষের ফ্যান, লাইট এবং এসি নবায়ন, সংস্কার এবং নতুন ট্রলি ক্রয় জরুরি। গণপূর্ত মেডিকেল উপবিভাগ সেবা প্রদানে প্রোএক্টিভ হলে অনেক দূরাবস্থা এড়ানো সম্ভব।
প্রফেসর, বিশেষজ্ঞ ডাক্তার এবং টেকনিশিয়ান এর সকল শুন্যপদ পূরণ করা না হলে মানসম্মত সেবা দেয়া অসম্ভব।
মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় নিজেদের সক্ষমতা অর্জন করা দরকার। বর্তমানে দৈনন্দিন সকল বর্জ্য সিটি কর্পোরেশন উম্মুক্ত স্থানে ডাম্পিং করায় এবং প্রক্রিয়াজাত করণের ব্যবস্থা না থাকায় জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের ঝুঁকি বাড়ছে।
শিশু হাসপাতাল, ক্যান্সার, হৃদরোগ, কিডনি হাসপাতাল, এবং জেনারেল হাসপাতালের ভবন নির্মাণ কাজের অগ্রগতি হতাশাজনক। এই কাজে গতি আনা খুবই জরুরী। বিলম্বে সরকারের ব্যয় বাড়বে এবং মানুষ সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। নির্মান সমাপ্তির সাথে সাথে যাতে দ্রত প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি এবং জনবল নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু করা যায় সেটাও নজরে রাখলে জনগন উপকৃত হবে।
ইন্টার্ন ডাক্তারদের সাথে তাদের কর্ম এবং বাসস্থান সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে আলোচনা চিকিৎসা সেবায় মান বৃদ্ধির সহায়ক হতে পারে। জেনারেল হাসপাতালে বিনামূল্যের এন্টিরেবিস ভ্যাক্সিন নিয়মিত পাওয়া যায় না। বাইরে থেকে চড়া দামে (এক ভায়েল ৫০০ টাকা) কিনে আনতে হয়। এতে অধিকার বঞ্চিত গরীব রোগীরা খুবই বিপদে পড়েন এবং অনেকের জীবন ঝুঁকির সম্মুখীন হয়। কর্তৃপক্ষকে দায়িত্ববান ও প্রোএক্টিভ হতে হবে। সচেতন রোগী এ বিষয়ে জানতে চাইলে কর্তৃপক্ষ দায়সারা জবাব দেন।
হাসপাতালে আগত রোগী এবং তাদের স্বজনদের সাথে ভাল ব্যবহার প্রত্যাশিত কিন্তু এক্ষেত্রে যথেষ্ট ঘাটতি আছে । বিভিন্ন অজুহাতে কর্মবিরতি এই পেশাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
সকল প্রকার দালাল, ভিখিরি এবং হকারদের হাসপাতালে প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করে চিকিৎসার পরিবেশ ফিরিয়ে আনার বিকল্প নাই। এক বা একাধিক মানসম্মত রেস্টুরেন্ট স্থাপনের বিষয় বিবেচনার দাবি রাখে।
হাসপাতাল সমাজসেবা কার্যক্রমকে আন্তরিকতার সাথে আরও গতিশীল করতে পারলে দরিদ্র, অসহায় রোগীদের বাঁচার স্বপ্ন একটু দীর্ঘায়িত হতে পারে।
সর্বোপরি সাধারন মানুষের প্রত্যাশা, গেজেট অনুসারে ব্যবস্থাপনা কমিটির সভা নিয়মিত অনুষ্ঠিত হবে এবং কার্যবিবরণী, অগ্রগতি সকলে অবহিত হতে পারবে।
কাজী মিজানুর রহমান এর এই প্রস্তাবনার প্রায় সবগুলোর সাথে সহমত পোষণ করেছেন বিগ্রেডিয়ার জেনারেল মশিউল মুনীর। তিনি বলেন, আগামীকাল ঢাকায় যাবো। সেখানে স্বাস্থ্য বিভাগের সাথে আমি এ নিয়ে কথা বলবো। তবে সবার আগে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও টেকনিশিয়ান সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করছি। এটি সম্পন্ন হলেই বরিশালের সুশীল সমাজের পরামর্শ ও মতামত নিতে তাদের সাথে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করা হবে।