4:08 pm , March 5, 2024
বিশেষ প্রতিবেদক ॥ প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করেই প্রায় ১২ লাখ টন খাদ্য উদ্বৃত্ত বরিশাল কৃাষ অঞ্চলে ফসল আবাদ ও উৎপাদনে নানা বৈচিত্র কৃষকদের সাথে আর্থÑসামাজিক ব্যবস্থায়ও ইতিবাচক পরিবর্তন আনছে। তবে এখনো প্রকৃতির রুদ্ররোষের বিরুদ্ধে নিরন্তর লড়াই করেই এ অঞ্চলের কৃষিযোদ্ধাদের জীবন কাটে। অতীতে বরিশাল অঞ্চলে কৃষি ব্যবস্থা বলতে শুধু ধান’কে বোঝালেও কালের বিবর্তনে সেখানে গম, ভুট্টা, ডাল সহ নানা দানাদার খাদ্য ফসল সহ তরমুজ ও সূর্যমুখীর মত অপ্রচলিত রসালো ও তেল জাতীয় ফসল স্থান করে নিচ্ছে। ফলে কৃষিতে নানা বৈচিত্রের মত কৃষকের ভাগ্যেরও ক্রমে পরিবর্তন ঘটছে। বিশে^র শতাধিক দেশে বাংলাদেশের যে কৃষিপণ্য রপ্তানী হচ্ছে, সেখানে বরিশালের অবদানও অপরিসীম। এ অঞ্চলে শুধু দানাদার খাদ্য উৎপাদনের পরিমান এখন প্রায় ৫০ লাখ টন।
‘বরিশালের বালাম চাল’এর খ্যাতী এ উপমহাদেশ জুড়েই ছিল অনেকের মুখে। নানা প্রবন্ধ ও কবিতা সহ শিল্পীর গানেও এ কথা উঠে এসেছে বার বার। সেই বরিশালের কৃষি ব্যবস্থায় নানা ফল ও ফসল উৎপাদনেও বৈচিত্র এসেছে। এমনকি ‘মাচান পদ্ধতি’ এবং ‘সারজন পদ্ধতি’ সহ নানা আধুনিক লাগসই প্রযুক্তিতে বরিশাল অঞ্চলে শাক-সবজি সহ বিভিন্ন শীতকালীন সবজির চারা বীজ সারা দেশে বিক্রী হচ্ছে। প্রায় ১৮ লাখ টন চাল উৎপদনের লক্ষ্য নিয়ে ৩ লাখ ৭০ হাজার হেক্টরে বোরো আবাদও প্রায় শেষের পথে। বিদায়ী ‘খরিপ-২’ মৌসুমে তিন দফার প্রাকৃতিক দুর্যোগ কাটিয়ে প্রায় ২৩ লাখ টন আমন চাল ঘরে তুলতে সক্ষম হয়েছেন বরিশালের কৃষিযোদ্ধারা। দেশে উৎপাদিত আউশের প্রায় ৬০ ভাগের উৎপাদন এ অঞ্চলে।
সারা দেশে উৎপাদিত মুগ ডালের ৮০ ভাগ ও খেশারী ডালের ৪০ ভাগ এ অঞ্চলে আবাদ ও উৎপাদন হচ্ছে। মিষ্টি আলুর প্রায় ৬০ ভাগই আবাদ ও উৎপাদন হচ্ছে বরিশাল অঞ্চলে। এমনকি গম আবাদেও বরিশাল কৃষি অঞ্চল ক্রমে সৃমদ্ধ হচ্ছে। সারা দেশে আবাদকৃত তরমুজের ৮০ ভাগেরও বেশী আবাদ ও উৎপাদন হচ্ছে বরিশাল অঞ্চলে। গত রবি মৌসুমে দেশে আবাদকৃত ৭৫ হাজার হেক্টরের ৬৪ হাজার হেক্টর তরমুজের আবাদ হয় বরিশাল কৃষি অঞ্চলে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্ত-ডিএই’র মতে, গত বছর প্রায় ৩০ লাখ টনের মত তরমুজের উৎপাদন হয় শুধু বরিশালেই।
কৃষি উৎপাদনের ‘বাংলাদেশ কৃষি গবেষনা ইনস্টিটিউট-বারি’ উন্নতজাতের ডাল ফসল ও তেল ফসল সহ বিভিন্ন ধরনের উচ্চ ফলনশীর জাত উদ্ভাবন করেছে। এমনকি ‘বারি আমÑ১১’ নামের বারমাসী নতুন জাতের আম-উদ্ভাবন করেছে কৃষি গবেষনা ইনস্টিটিউট। যার আবাদ ও উৎপাদনও ক্রমশ বাড়ছে বরিশালে। ফলে আগামী ৫ বছরের মধ্যে বরিশালের ১২ মাসী আম সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনার কথা বলছেন কৃষিবীদরা।
আটঘরÑকুড়িয়ানা সহ ভিমরুলী এলাকার প্রায় ১০ হাজার হেক্টর জমিতে প্রতিবছর অন্তত ৩০ হাজার টন পেয়ারা এখন দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে পাশর্^বর্তী দেশের পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরাতেও যাচ্ছে। বরিশালের অমড়া’র সুখ্যাতিও দীর্ঘদিনের। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যেও ‘বরিশালের আমড়া’ বাজার করে নিয়েছে।
সাম্প্রতিককালে দেশের বিভিন্ন এলাকায় সুমিষ্ট মাল্টার চাষ ও উৎপাদন হতে শুরু করেছে। যার চারা-কলম সরবরাহ হচ্ছে বরিশালের বানরীপাড়া ও নেছারাবাদ থেকে। এমনকি সদ্য সমাপ্ত মৌসুমে বরিশালে প্রায় ১০ হাজার টন মাল্টার উৎপাদন হয়েছে। সাম্প্রতিককালে বরিশাল অঞ্চলে সীমিত আকারে স্ট্রবেরী’ এবং ‘ক্যাপসিকাম’এর সফল আবাদের আশাব্যঞ্জক সম্প্রসারণ ঘটছে।
চলতি রবি মৌসুমে দক্ষিণাঞ্চলে প্রায় সাড়ে ৮ লাখ হেক্টর জমিতে ডাল, তেলবীজ ও মসলা জাতীয় ফসল সহ বিভিন্ন ধরনের রবি ফসল আবাদের লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছেন কৃষিযোদ্ধারা। চলতি রবি মৌসুমে বরিশাল অঞ্চলে প্রায় ৭৫ হাজার হেক্টরে প্রায় ১৫ লাখ টন শীতকালীন শাক-সবজি উৎপাদন হচ্ছে। এছাড়া ৬০ হাজার হেক্টরে ১.৬০ লাখ টন গম, ১৪ হাজার হেক্টরে মিষ্টি আলু, ১০ হাজার হেক্টরে গোল আলু, ১২ হাজার হেক্টরে ভুট্টা, আড়াই হাাজার হেক্টরে আখ, সাড়ে ৬ হাজার হেক্টরে শশা-ক্ষিরাই ও মর্মা ছাড়াও প্রায় দেড় হাজার হেক্টরে ফুট আবাদের লক্ষ্য অর্র্জনে কাজ শুরু করেছেন দক্ষিণাঞ্চলের কৃষি যোদ্ধারা।
এমনকি বরিশাল অঞ্চলে এবার প্রায় ৪৮ হাজার হেক্টরে মসলা জাতীয় ফসলেরও আবাদ হচ্ছে। যার মধ্যে মরিচই আবাদ হচ্ছে প্রায় ৪২ হাজার হেক্টরে। সারা দেশে আবাদ ও উৎপাদনের ৩৫ ভাগ পেয়াজের উৎপাদন বরিশাল কৃষি অঞ্চলে। পাশাপাশি রসুন ছাড়াও ধনিয়া,আদা,কালোজিরা ও হলুদেরও আবাদ হচ্ছে বলে জানা গেছে। তবে ‘বারি’ উদ্ভাবিত পেয়াজ ও রসুন সহ অন্য সব ধরনের ফসলের উচ্চ ফলনশীল বীজ ব্যবহার সহ আবাদ সম্প্রসারণের সুযোগকে যথাযথভাবে কাজে লাগানোর তাগিদ দিয়েছেন মাঠ পর্যায়ের কৃষিবীদরা।
একই সাথে ‘বাংলাদেশ কৃষি গবেষনা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত উন্নত জাত ও উচ্চ ফলনশীল সব ধরনের ফসলের বীজ ব্যবহারের মাধ্যমে বরিশাল কৃষি অঞ্চলে কৃষি পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধির সুযোগকেও কাজে লাগানোর পরামর্র্শ দিয়েছেন কৃষিবীদরা। এ লক্ষে ডিএই’র জেলা থেকে মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের দায়িত্ব পালনে সমন্বিত ও আন্তরিকতাপূর্ণ কর্মকান্ডের বিকল্প নেই বলেও মনে করছেন মাঠ পর্যায়ের কৃষিবীদরা।