2:59 pm , April 12, 2025

আরিফ আহমেদ, বিশেষ প্রতিবেদক ॥ গত প্রায় ত্রিশ বছর ধরে চরকাউয়া খেয়াঘাট থেকে চাঁদমারি এবং চাঁদমারি থেকে ত্রিশ গোডাউন সংযোগ সেতু হচ্ছে, হবে করে শেষ পর্যন্ত অসমাপ্তই থেকে গেছে সব কাজ। এই সংযোগ ব্রীজ ও শহর রক্ষা বাঁধের উপর ওয়াকওয়ে ও সাইকেলিং সড়ক নির্মাণের প্রতিশ্রুতি ছিলো নির্বাচনী অঙ্গীকার। তারপরও এ নিয়ে এলাকাবাসী ও কীর্তনখোলা নদী তীরবর্তী সৌন্দর্য্য উপভোগকারী দর্শনার্থীদের শত অনুরোধ, অভিযোগ বারবার উপেক্ষিত হয়েছে অদৃশ্য কোনো আদেশে। বরিশাল সিটি করপোরেশনের আওতাধীন ১০ ও ১১ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দারা জানান, বরিশালের অভ্যন্তরীণ সাতটি খালের সংযোগ কীর্তনখোলা নদীতে। যে কারণে নদী তীরবর্তী এই চরকাউয়া খেয়াঘাট থেকে চাঁদমারি এবং ত্রিশ গোডাউন যেতে একসময় বাঁশের সাঁকো নির্ভর পারাপার ছিলো এখানে। প্রয়াত মেয়র শওকত হোসেন হিরণ এখানে ব্রীজ তৈরির প্রতিশ্রুতি দেওয়ার কিছুদিন পর মৃত্যুবরণ করেন। সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ এসে চাঁদমারিতে ব্রীজ তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করে অর্ধেক কাজ শেষ করে অসমাপ্ত অবস্থায় ফেলে রেখেছেন। এখন এটি না ঘরকা, না ঘাটকা। ২০২০ সাল থেকে এটি এভাবেই পড়ে আছে বলে জানান স্থানীয় বাসিন্দারা।
সরেজমিনে ১২ এপ্রিল শনিবার বিকালে বরিশালের চাঁদমারি খেয়াঘাট এলাকায় অসমাপ্ত ব্রীজটি পার হতে গিয়ে একজন মহিলা দর্শনার্থী পড়ে গিয়ে আহত হন। ব্রীজের দু’প্রান্তেই সংযোগ ঢালাই অসমাপ্ত অবস্থায় থাকায় এলাকাবাসী নিজস্ব উদ্যোগে দুটো চিকন পিলার বসিয়ে চলাচল করেন। এপারে ১০ নং ওয়ার্ডের চাঁদমারি খেয়াঘাট। ওপারে ১১ ও ১২ নং ওয়ার্ডের চাঁদমারি মাদ্রাসা ও ত্রিশ গোডাউন এলাকা। ওপারে বেড়িবাঁধে অসংখ্য মানুষের নদীর সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে আসার দৃশ্য।
জানাগেছে, বরিশালের নদী তীরবর্তী শহররক্ষা বাঁধ ধরে প্রায় সাত কিলোমিটার এলাকায় রয়েছে চমৎকার পর্যটন সম্ভাবনা। কীর্তনখোলা নদী বেষ্টিত বরিশালের সৌন্দর্য্য এর চিত্র রয়েছে নদী তীরবর্তী বেলতলা খেয়াঘাট থেকে ডিসিঘাট হয়ে পায়েচলা পথে মুক্তিযোদ্ধা পার্কের ভিতর দিয়ে কেডিসি, চাঁদমারি খেয়াঘাট হয়ে ওপারে ত্রিশ গোডাউন থেকে গ্যাসটারবাইন এলাকা পর্যন্ত। পুরো পথটিই পর্যটন জোন হতে পারে বলে জানালেন নগর চিন্তাবিদদের অনেকেই। যদিও কেডিসি থেকে চাঁদমারি এবং ত্রিশ গোডাউন থেকে গ্যাসটারবাইন এলাকায় শহররক্ষা বাঁধ না থাকায় সৌন্দর্য্য পিপাসু মানুষের বেশ ভোগান্তি পোহাতে হয় হাটু কাদাজলে মাখামাখি অবস্থা হয়ে। আবার মুক্তিযোদ্ধা পার্কের ভিতর দিয়ে কেডিসি অংশে আসতে অসংখ্য বস্তিঘর ও অবৈধ দোকানপাটের কারণে বাধাগ্রস্ত হতে হয়। যে কারণে চাঁদমারি থেকে ত্রিশ গোডাউন অংশকে ঘীরেই প্রতিদিন হাজারো মানুষের উপস্থিতি চোখে পড়ে। এখানে সবচেয়ে বড় সমস্যা ব্যবহার অনুপযোগী দুটি ব্রীজ। একটি ডিসিঘাটের কাঠের পুল, অন্যটি চাঁদমারি খেয়াঘাট ব্রীজটি। অহরহ এখানে ঘটছে দুর্ঘটনা। তবুও উদাসীন সংশ্লিষ্ট প্রশাসন। চাঁদমারি খেয়াঘাট থেকে খুব সহজেই ব্রীজ পার হয়ে চলে যাওয়া যায় ত্রিশ গোডাউন এলাকায়। মানুষের যাতায়াত যদিও বন্ধ নেই। তবে ব্রীজটি পার হতে যেয়ে বেশ কয়েকজন শিশু, নারী ও বৃদ্ধ আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন বলে জানালেন স্থানীয় বাসিন্দারা। বরিশাল সিটি করপোরেশনের ১০ ও ১১ নং ওয়ার্ডের সীমানায় সংযোগ সেতু এই ব্রীজটি ঝুলে আছে সাগরদি খালের উপর। ভাটারখালের উপরও রয়েছে একটি কাঠের পুল। সম্প্রতি কোষ্টগার্ড কর্তৃপক্ষ নিজস্ব উদ্যোগে ভাঙা ব্রীজটি মেরামত করে নিয়েছেন বলে জানা গেছে। তবুও সেটি একসাথে বহুজন চলাচল উপযোগী নয়। নদী পাড়ের মুক্ত বাতাসে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য উপভোগে আসা দর্শনার্থীদের ভিড় আরো বাড়তে পারে এ পথের এই ব্রীজ দুটো সংস্কার করা হলে। কিন্তু সমস্যা হলো বেরিবাঁধ বা শহররক্ষা বাঁধ জেলা প্রশাসনের হলেও নগর উন্নয়ন পুরোপুরি সিটি করপোরেশনের হাতে। দুটো ব্রীজের ব্যবস্থাপনা সিটি করপোরেশনের বলে জানালেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী জাবেদ ইকবাল। তিনি বলেন, শহররক্ষা বাঁধের সংস্কার কাজ চলমান রয়েছে। ৫ কিলোমিটার এলাকা সংস্কার করা হচ্ছে। খুব শীঘ্রই ডিসিঘাট থেকে কেডিসি ও চাঁদমারি খেয়াঘাট বাঁধ সংস্কার করা হবে। তবে ব্রীজ বা পুল এগুলো সিটি করপোরেশনের কাজ।
চাঁদমারিতে ২০১৯ সালে কোটি টাকা খরচ করে একটি ব্রীজ তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা অসমাপ্ত অবস্থায় পড়ে আছে বিগত প্রায় সাত বছর ধরে। ব্রীজটি ব্যবহার করতে এলাকাবাসী তাই নিজস্ব উদ্যোগে দু-পাশে মই বসিয়ে চলাচল করেন। তারা বলেন, ব্রীজটি সাবেক মেয়র প্রয়াত শওকত হোসেন হিরণ তৈরি শুরু করেছিলেন। সাবেক মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ এটির নির্মাণ শেষ করেন ২০১৯ সালে। আজ পর্যন্ত ব্রীজের দুপাশের সংযোগ তৈরি হয়নি। আমরা স্থানীয়ভাবে বাঁশ ও খুটি ব্যবহার করে স্লাব বানিয়ে নিয়েছি পারাপারের জন্য। এটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। ইতিমধ্যে ব্রীজে উঠতে গিয়ে পা পিছলে আহত হয়েছেন বেশ কয়েকজন পথচারী। তাদের উদ্ধার করে স্থানীয় দোকানদার ও নৌকার মাঝিরা। স্থানীয়রা আরো জানান, এই জায়গায় গত একবছরে অনেকগুলো এক্সিডেন্ট হয়েছে। কয়দিন আগেও এক ছাত্রীর হাত ভেঙেছে। আজও একজন দর্শনার্থী মহিলা পড়ে গিয়ে মারাত্মক জখম হয়েছেন।
১০ ও ১১ নং ওয়ার্ডের জনগণ এবং নদী পাড়ে ঘুরতে আসা দর্শনার্থীদের সুবিধার জন্য এই ব্রীজটির কাজ সমাপ্ত করা খুবই জরুরী বলে জানান ১০ নং ওয়ার্ডের বাসীন্দা আব্দুল খালেক হাওলাদার। তিনি বলেন, ব্রীজের ওপারে বস্তি এলাকা ও ত্রিশ গোডাউনের নদী তীরবর্তী সীমানা ধরে প্রায় এক কিলোমিটার পথ চমৎকার ভ্রমণ উপযোগী করে গড়ে তোলার পরও এ পাড়ের গুদারাঘাট, ইসলামিয়া হাসপাতাল ও কেডিসি অংশটি যেন ইচ্ছেকৃত চরম অবহেলার শিকার। কেডিসি থেকে মুক্তিযোদ্ধা পার্কের বেড়িবাঁধ অংশে যাতায়াত সুবিধা নিশ্চিত করার দাবী জানান তিনি।
স্থানীয় ব্যবসায়ী মনু মিয়া বলেন, চরকাউয়া খেয়াঘাট থেকে মুক্তিযোদ্ধা পার্ক পর্যন্ত এবং চাঁদমারি খেয়াঘাটের ওপার থেকে ত্রিশ গোডাউন ও বধ্যভূমি এলাকায় প্রয়াত মেয়র শওকত হোসেন হিরণ সৌন্দর্য্যবর্ধন কাজ করেছেন। মুক্তিযোদ্ধা পার্কটি তিনিই তৈরি করেন। এরপর থেকে এই এলাকার উন্নয়নে খুব একটা ভূমিকা দেখায়নি কেউ।
স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, মুক্তিযোদ্ধা পার্ক সীমানা পার হলেই দেখা যাবে হেরিংবন সড়ক রয়েছে কেডিসি পর্যন্ত। তবে বস্তি এলাকার লোকেরা নদী পাড়ে দোকানপাট তুলে হাঁটাচলার পথ প্রায় বন্ধ করে রেখেছে। কেডিসি পর্যন্ত আসতে অনেক কষ্ট পোহাতে হয়। কেডিসি থেকে চাঁদমারি খেয়াঘাট আসতে হবে ঘুর পথে। সরাসরি রাস্তা তৈরি হবার কথা এখনো আশ্বাসে আটকে আছে বলে জানান তিনি ।
ডিসিঘাট ও চাঁদমারি খেয়াঘাট ব্রীজ দুটি দ্রুত সম্পন্ন করার তাগিদ দিয়ে নগর চিন্তাবিদ কাজী মিজানুর রহমান বলেন, একটি ব্রীজ দীর্ঘদিন অসম্পূর্ন অবস্থায় পড়ে আছে। সেটি আবার মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। জনগনের সহজ যোগাযোগ পথ বাস্তবায়িত না হওয়ায় মানুষ চলাচলে কষ্ট পাচ্ছে। এছাড়াও এই পথের আশেপাশে নদীর পাড় ক্রমাগতভাবে ভাঙ্গছে। দ্রুত এপ্রোচ অংশ নির্মান সহ ওই অংশের নদীর তীরে বাঁধ নির্মাণ করা খুবই জরুরী। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় সেতু হতে বেলতলা পর্যন্ত ৭ কিলোমিটার নদী তীরবর্তী এলাকা দখলমুক্ত করে নদীর পাড়ে হাঁটার উপযুক্ত করে উম্মুক্ত করার দাবী জানান কাজী মিজানুর রহমান।
নদীরক্ষা আন্দোলনের নেতা রফিকুল আলম বলেন, ব্রীজটি সম্ভবত প্রয়াত মেয়র শওকত হোসেন হিরণ করেছিলেন। ওখানে নদী রক্ষা বাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল। পরবর্তীতে আর কেউ ওখানে কোনো উন্নয়নের চেষ্টা করেনি। বর্তমান সিটি করপোরেশনের প্রশাসক আশা করি এ বিষয়ে দৃষ্টি দেবেন।