দক্ষিণাঞ্চলের কৃষি-মৎস্য সহ সুস্থ মানবসভ্যতা বিপর্যয়ের মুখে দক্ষিণাঞ্চলের কৃষি-মৎস্য সহ সুস্থ মানবসভ্যতা বিপর্যয়ের মুখে - ajkerparibartan.com
দক্ষিণাঞ্চলের কৃষি-মৎস্য সহ সুস্থ মানবসভ্যতা বিপর্যয়ের মুখে

4:16 pm , April 22, 2024

নাব্যতা সংকট ও লবনাক্ততার সাথে নদ-নদীর ভয়াবহ ভাঙন

বিশেষ প্রতিবেদক ॥  সীমান্তের ওপারে অভিন্ন নদী সমূহের প্রবাহ নিয়ন্ত্রনের সাথে জলবায়ু পরিবর্তনে বৃষ্টির অভাবে সাগরের জোয়ার ক্রমাগত উজানে উঠে আসায় দক্ষিণাঞ্চলে গত কয়েক বছর লবনাক্ততার মাত্রা ক্রমাগত বৃদ্ধির সাথে নাব্যতা সংকটও প্রকট আকার ধারন করছে। এ অঞ্চলের ছোট বড় ১৩২টি নদ-নদীতে লবানক্ততার মাত্রা বৃদ্ধির সাথে নাব্যতা সংকটে নৌ-যোগাযোগ ও মৎস্য সম্পদ হুমকির মুখে বলে পানি উন্নয়ন বোর্ড, মৃত্তিকা সম্পদ ইনস্টিটিউট, মৎস্য গবেষনা ইনস্টিটিউট ও বিআইডব্লিউটিএ’র একাধিক সূত্র জানিয়েছে। অপরদিকে সীমান্তের ওপারে অব্যাহত প্রবাহ নিয়ন্ত্রনে নদ-নদী সমূহে পলি জমে ধারন ক্ষমতা হ্রাসের ফলে বর্ষা মৌসুমে উজানের ঢলের পানি সাগরে প্রবাহের সময় বাড়ছে ভাঙনের তীব্রতাও। সুষ্ঠু প্রবাহের অভাবে ইলিশের বিচরনস্থলের পরিবর্তন ঘটছে। এমনকি নদ-নদীর প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়া সহ নাব্যতা সংকটের সাথে চলমান তাপ প্রবাহে নদ-নদীর পানির উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে ইলিশ ক্রমাগত গভীর সমুদ্রে চলে যাচ্ছে। অথচ সারা দেশে উৎপাদিত ও সহনীয় আহরিত ইলিশের ৭০ ভাগই বরিশাল অঞ্চলের।
শুষ্ক মৌসুমে উজানে প্রবাহ নিয়ন্ত্রনে মেঘনা, তেতুলিয়া, আড়িয়াল খাঁ, বলেশ^র ও বুড়িশ^র সহ বরিশাল অঞ্চলের ছোট-বড় ১৩২টি নদ-নদীই নাব্যতা সংকটে ধুকছে। জানুয়ারী থেকে মে মাসের শেষভাগ পর্যন্ত শুষ্ক মৌসুমের সর্বাধিক ঝুঁকিপূর্ণ সময়ে অনেক বড় নদীতেও নৌযান চলাচল করছে গভীরতা মেপে। বরিশাল-চাঁদপুর-ঢাকা,বরিশাল-ইলিশা-লক্ষ্মীপুর-চট্টগ্রাম নৌপথ ছাড়াও বরিশাল-মোংলা-খুলনা নৌপথের গাবখান ও ঘাশিয়াখালী চ্যানেলগুলোর নাব্যতা সংকট অভ্যন্তরীণ ও আন্তঃদেশীয় নৌযোগাযোগে প্রতিনিয়ত সংকট সৃষ্টি করছে।
তবে পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় নৌপথে যাত্রী পরিবহন কমে যাওয়ায় বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমের দৃষ্টি অন্যত্র সরে গেছে বলে মনে করছেন নদী বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে কোন মহাসড়ক ও সেতু কখনো নৌ-পথের গুরুত্বকে হ্রাস করতে পারে না। কারণ এখনো নৌপথে পরিবহন ব্যায় সড়ক পথের অর্ধেকেরও কম এবং নিরাপদ। পাশপাশি নৌপথের সংরক্ষন ও উন্নয়ন সড়ক পথের চেয়ে অনেকটাই সাশ্রয়ী। উপরন্তু নদী দেশের কৃষি, পরিবেশ, জনস্বাস্থ্য ও জলবায়ু রক্ষায় অনেকটাই হ্রদ স্পন্দনের কাজ করে বলে পানি ও পরিবেশবীদদের দাবী।
একাধিক নদী গবেষনা প্রতিষ্ঠানের মতে, সীমান্তের ওপার হয়ে অভিন্ন ৫৪টি নদ-নদীর যে পানি সাগরে পতিত হয়, তার ৭৮%-ই মেঘনা, তেতুলিয়া,বুড়িশ^র ও বলেশ^র সহ দক্ষিণাঞ্চলের ১৩২টি নদ-নদী বহন করে থাকে। কিন্তু প্রতি বছরই উজানে প্রবাহ নিয়ন্ত্রন সহ যথাযথ সংরক্ষন ও উন্নয়নের অভাবে নদ-নদী সমূহ শুষ্ক মৌসুমে ক্রমাগত ভরাট হয়ে ধারন ক্ষমতা হ্রাসের ফলে বর্ষাকালে ভাঙনের তীব্রতা বাড়ছে। অথচ গত ১৫ বছরে দেশের নদ-নদীর ভাঙন রোধে এযাবতকালের সর্বাধিক নদী শাসন রোধ প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে। সর্বাধিক নদী শাসন প্রকল্প এখনো চলমান।
শুধু দক্ষিণাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় গত কয়েক বছরে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকারও বেশী ব্যায়ে ১৫টি নদী শাসন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। যার বেশীরভাগই বাস্তবায়নাধীন। ইতোমধ্যে কয়েকটি ভাঙন রোধ প্রকল্প শেষ হয়েছে বলেও পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে। কিন্তু এরপরেও অতি জনগুরুত্বপূর্ণ কিছু এলাকার ভাঙন রোধে এখন পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন। কুয়াকাটা পর্যটন কেন্দ্র সহ সমুদ্র সৈকত রক্ষায় একটি প্রকল্প প্রস্তাবনা সাড়ে ৫শ কোটি থেকে সাড়ে ৭শ কোটি হয়ে সাড়ে ১১শ কোটি টাকায় উন্নীত হবার পরে পুনরায় সাড়ে ৭শ কোটিতে নামিয়ে আনা হলেও তা পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের ফাইলের জ্যামে আটকে আছে।
ভাঙন রোধে নদী তীর রক্ষা ও ড্রেজিং-এর সময়োচিত পদক্ষেপের অভাবে দক্ষিণাঞ্চলের কোটি মানুষের আশীর্বাদ ১৩২টি নদ-নদী এখন অনেকটাই দুঃখে পরিনত হচ্ছে। এমনকি গত কয়েক বছর ধরে শুষ্ক মৌসুমে দক্ষিণাঞ্চলের নদ-নদীর প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার নৌপথের প্রায় ৫শ কিলোমিটারে নাব্যতা সংকট ভয়াবহ ঝুঁকি সৃষ্টি করছে। একই কারণে প্রায় ৩ লাখ টন মাছ উদ্বৃত্ত দক্ষিণাঞ্চলের বিপুল মৎস্য সম্পদের ভবিষ্যতও  ঝুঁকির মুখে।
অপরদিকে নদী ভাঙন এখনো সারা দেশের মত দক্ষিণাঞ্চলের ভয়াবহ অভিশাপ হয়েই আছে। বর্ষা মৌসুমে প্রায় ৫ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ দক্ষিণাঞ্চলের ১৩২টি নদ-নদীর ভয়াবহ ভাঙনে সকাল বেলার আমীরকে সন্ধ্যায় ফকির বানাচ্ছে।
এমনকি শুষ্ক মৌসুমে সীমান্তের ওপারে বিবেকহীন প্রবাহ নিয়ন্ত্রনে নদ-নদী বহুল দক্ষিণাঞ্চলেরও প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার নৌপথে নাব্যতা সংকট ক্রমগত ঝুঁকি বৃদ্ধি করছে। একই সাথে সাগরের লবানাক্ত পানি ১শ কিলোমিটার উজানে বরিশাল ছাড়িয়ে আরো ৫০ কিলোমিটার উত্তরে চাঁদপুরের ভাটিতে হিজলার মেঘনা পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে গত কয়েক বছর ধরে।
দক্ষিণাঞ্চলের নদÑনদীর ওপরই দেশের ৩টি সমুদ্র বন্দর সহ সারা দেশের সাথে নৌ যোগাযোগ নির্ভরশীল। এমনকি পায়রা সমুদ্র বন্দরটি সম্পূর্ণভাবেই দক্ষিণাঞ্চলের নদ-নদী নির্ভর। মেঘনা সহ বড় কয়েকটি নদ-নদীর নাব্যতা সংকটে পায়রা ও মোংলা বন্দর সহ দক্ষিণাঞ্চলের সাথে চাঁদপুর হয়ে ঢাকা ছাড়াও উত্তরবঙ্গের এবং চট্টগ্রামের নৌ যোগাযোগে ঝুঁকি বৃদ্ধি করছে। ভোলার ইলিশা থেকে লক্ষ্মীপুরের মজুচৌধুরীর হাট পর্যন্ত ২৮ কিলোমিটার প্রশস্ত ভাটি মেঘনায়ও ডুবোচরে উপ মহাদেশের দীর্ঘতম ফেরি সার্ভিস সহ সব ধরনের নৌযান চলাচল বিঘিœত হচ্ছে। অথচ এ নৌপথটির ওপরই চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে সারা দেশের নৌ যোগাযোগ নির্ভরশীল।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি সূত্রের মতে ২০০৬ সালের জানুয়ারীতে বরিশালের কীর্তনখোলা নদীতে লবনাক্ততার মাত্রা ছিল ৬১০-৬৩০ পিপিএম। সেখানে ২০১৭ সালের জানুয়ারীতে তা ৯১০ পিপিএম-এ পৌঁছে। ২০১৮ সালে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও ’১৯ সালে একই নদীতে লবনাক্ততার মাত্রা আবার ৯শ পিপিএম অতিক্রম করে। ২০২০-এর জানুয়ারীতেও লবনাক্ততার মাত্রা প্রায় ৯শ পিপিএম-এর কাছে থাকলেও ২০২১-এর এপ্রিলের শুরু থেকে বরিশালে কীর্তনখেলায় তা ১ হাজার পিপিএম অতিক্রম করে বলেও একাধিক সূত্র জানিয়েছে।  তবে গত দু বছর লবনাক্ততার মাত্রা বিপদসীমার নীচে থাকলেও তা অনেক সময়ই ‘বর্ডার লাইন’এর কাছে চলে আসছে।
উজানে প্রবাহ নিয়নস্ত্রন সহ স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের অভাবে ২০২১-এর শুষ্ক মৌসুমে সাগরের নোনা পানি গোপালগঞ্জের মধুমতি নদীতে পৌঁছে সর্বকালের সর্বোচ্চ ২১শ পিপিএম লবনাক্ততা শনাক্ত হয়। যা ২০১৬ সালে ছিল ১২শ পিপিএম। অথচ আমাদের কৃষি ও মৎস্য সম্পদ সহ মানবদেহের জন্য সহনীয় লবনাক্ততার মাত্রা ৬শ পিপিএম।
উজানে বিবেকহীন প্রবাহ নিয়ন্ত্রনের সাথে জলবায়ু পরিবর্তনে বিগত ২০২১ ও ২০২২ সালে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের অভাবে নদীর দেশ দক্ষিণাঞ্চলের নদ-নদী সমূহে ক্রমাগত তার চরিত্র বদলাচ্ছে। এমনকি গতবছরও মূল বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিপাতের ব্যাপক ঘাটতির পরে শরৎ পেরিয়ে হেমন্তে প্রবল বর্ষনে উঠতি আমন ও আগাম রবি ফসলের ব্যাপক ক্ষতির সাথে নদী ভাঙন তীব্র আকার ধারন করে। যা কৃষি ও মৎস্য সম্পদ সহ সুস্থ মানব সভ্যতাকে ক্রমাগত বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিচ্ছে বলেও দাবী পরিবেশবীদদের।

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন    
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী মিরাজ মাহমুদ
 
বার্তা ও বানিজ্যিক কার্যালয়ঃ কুশলা হাউজ, ১৩৮ বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সড়ক,
সদর রোড (শহীদ মিনারের বিপরীতে), বরিশাল-৮২০০।
© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
Developed by NEXTZEN-IT