সয়াবিন বীজ থেকে তেলের কারখানা চায় কৃষকরা সয়াবিন বীজ থেকে তেলের কারখানা চায় কৃষকরা - ajkerparibartan.com
সয়াবিন বীজ থেকে তেলের কারখানা চায় কৃষকরা

3:51 pm , February 22, 2024

আরিফ আহমেদ, বিশেষ প্রতিবেদক ॥ তেল শুধু বাংলাদেশের নারী-পুরুষের নয় সারা বিশ্বের ভোজনরসিক মানুষের জন্য অতি জরুরী নিত্যপ্রয়োজনীয়  তরল পদার্থ। যা উদ্ভিদ থেকে পিষন প্রক্রিয়ায় তরল তৈলে পরিণত হয়ে খাবারের জন্য ভোজ্য তেল হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে ভোজ্য তেলের চাহিদা ক্রমশ বাড়ছে। আর তেলের চাহিদার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বাজার দর। সরিষা কিম্বা সয়াবিন দুটিরই বাজার দরে অস্থির ক্রেতা। অথচ দুটোতেই রয়েছে বাংলাদেশের কৃষকদের চমৎকার অভিজ্ঞতা এবং পর্যাপ্ত বীজ উৎপাদন করছেন তারা। কিন্তু চমৎকার উৎপাদন থাকার পরও সয়াবিন বীজ থেকে তেল উৎপাদনের কোনো সুযোগ বা আগ্রহ নেই বাংলাদেশে। ফলে প্রতিবছর হাজার কোটি টাকার তেল আমদানি করতে হয় বিশ্বের আটটি দেশ থেকে।
বরিশালের মুলাদি উপজেলার কৃষক এম কবীর বলেন, সরিষা থেকে যেভাবে তেল উৎপাদন হয়, একইভাবে সয়াবিন বীজ থেকেও তেল উৎপাদন করা সম্ভব। কিন্তু সরিষার তেল উৎপাদন লাভজনক হলেও সয়াবিন বীজ আমরা বিভিন্ন কোম্পানির কাছে আগাম বিক্রি করে দেই। কৃষি কর্মকর্তারাই এ কাজে আমাদের সাহায্য করেন। সয়াবীজ চাষ করে আমরা লাভবান হচ্ছি। তিনি বলেন,  বরিশাল বিসিক শিল্প নগরীতে তেল উৎপাদন কারখানা হলে আমাদের অনেক সুবিধা হতো। তাহলে বাজারে তেলের দামও কমে যেত।
আর বরিশাল অঞ্চলের কৃষি কর্মকর্তারা জানান, আমাদের দেশে সয়াবিন বীজ উৎপাদন ভালো হলেও তেল উৎপাদনের কোনো কারখানা আজ পর্যন্ত হয়েছে কিনা জানা নেই। ঘানি পদ্ধতিতে সয়াবিন উৎপাদন সম্ভব হলেও তা নিরাপদ নয় বলে জানান জেলা উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা জালালউদ্দিন। তিনি এবং তার আশেপাশের সহকর্মী কবীর হাসান, মজিবরসহ কয়েকজন বলেন, আমাদের দেশে অপরিশোধিত তেল থেকে শোধন করে সয়াবিন তৈরি কারখানা রয়েছে। বড় বড় তেল কোম্পানি অপরিশোধিত তেল বিদেশ থেকে আমদানি করে তা পরিশোধিত করে বোতলজাত করছে। কিন্তু সয়াবিন বীজ থেকে তেল তৈরি কারখানা এখনো হয়নি। খুব সম্ভব এটি খুবই ব্যয়বহুল এবং একটি কারখানার খোরাক উপযোগী সয়াবিন বীজ উৎপাদন হয় কিনা তাও গবেষণার বিষয় বলে জানান তারা।
তবে ঘানি পদ্ধতিতেও সয়াবিন তেল উৎপাদন সম্ভব এবং তা নিরাপদ বলে দাবী একাধিক কৃষকের। বরিশালের হাটখোলা এলাকার মরিচপট্টিতে সরিষার ঘানি থেকে সরাসরি তেল বিক্রেতা তসলিম জানান, তার ঘানিতে আগে সয়াবিন বীজ থেকে তেল তৈরি করা হতো, এখন আর সয়াবিন তারা পাননা।
বরিশাল অঞ্চলের কৃষক ও কৃষি কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, লক্ষ্যমাত্রার অধিক সয়াবিন উৎপাদন হবার পরও বাংলাদেশে সয়াবিন তেল তৈরির কোনো কারখানা আজ পর্যন্ত গড়ে ওঠেনি। প্রতিবছর হাজার কোটি টাকার সয়াবিন আমদানি করতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। কারণ, বাংলাদেশে সয়াবিন ফসল ও ভোজ্যতেল হিসেবে খুবই জনপ্রিয় এবং বর্তমানে এর বাজার মূল্য অতিচড়া। পাঁচ লিটার এখন ৮৪০ থেকে ৮৬০ টাকা। এই সয়াবিন তেল সবটাই বিদেশ থেকে আমদানী করতে হয়। আর এতে প্রতিবছর খরচ পড়ে ২৬ হাজার কোটি টাকা। বিপুল পরিমানের এই অর্থ  পুরোটাই চলে যায় বিদেশে। এছাড়া ভোজ্য তেল নিয়ে বছরজুড়ে রয়েছে সিন্ডিকেটের তেলেসমাতি। অথচ শুধু বরিশাল অঞ্চলেই চলতি বছর সয়াবিন বীজ উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪৪ হাজার ৬১২ মেট্টিকটন। আর বরিশাল জেলার মুলাদি, হিজলা ও মেহেন্দিগঞ্জের তিন উপজেলায় আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১৮ হাজার হেক্টর জমিতে। এ জেলায় উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২৮ হাজার ৫০ মেট্টিকটন। বরিশালের ছয় জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি সয়াবিন চাষের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছে বরিশালে। এরপর ভোলা জেলায় প্রায় ১১ হাজার হেক্টর জমির বিপরীতে ১৬ হাজার ৫০০ টন, পিরোজপুরে ১০ হেক্টর জমির বিপরীতে ১০ মেট্টিক টন, ঝালকাঠিতে ১৪ হেক্টর জমির বিপরীতে ১৮ টন, পটুয়াখালীতে ১৫ হেক্টর জমির বিপরীতে ২৭ টন, বরগুনায় ৫ হেক্টর জমির বিপরীতে ৭ টন সয়াবিন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে বলে জানালেন বিভাগীয় উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা গোলাম মোস্তফা।
এদিকে গত ২০০৩ সাল থেকে একটু একটু করে সয়াবিন চাষ ও তেল উৎপাদন শুরু করেছে বাংলাদেশ। গত ২০২০ সালে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সয়াবিন তেল উৎপাদন হয় ( তিন লাখ টনের বেশি)। মার্কিন কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) ফরেন এগ্রিকালচারাল সার্ভিসের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে ২০১৮ সালে বাংলাদেশে ২ লাখ ৯৩ হাজার টন সয়াবিন তেল উৎপাদন হয়। ২০১৯ সালে তা আরো ১০ দশমিক ৯২ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ২৫ হাজার টনে। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে দেশে সয়াবিন তেল উৎপাদন বেড়েছে ৩২ হাজার টন। যা বর্তমানে স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্য নির্ধারণ করা সম্ভব এবং দেশে উৎপাদিত সয়াবিন তেল বিদেশে রপ্তানীও সম্ভব বলে মনে করেন অনেক কৃষিবিদ।
এরআগে বাংলাদেশের প্রতিটি বিভাগীয় শহরে বিশেষ করে বরিশালে শিল্প নগরী স্থাপন এবং সয়াবিন উৎপাদন কারখানা তৈরি জরুরী বলে মনে করেন কৃষিবিদ ও বরিশাল ইসলামি ফাউন্ডেশনের  পরিচালক নুরুল ইসলাম।
এদিকে অনুসন্ধানে জানা গেছে, শিল্প বিপ্লবের আগে গৃহপালিত পশু দিয়ে ঘানিতে সরিষার তেলের মতই  সয়াবিনের বীজ পিষে তেল সংগ্রহ করা হতো। ঘানি পদ্ধতিতে এখনো সয়াবিন উৎপাদন সম্ভাবনা থাকলেও তা ক্রমশ বিলুপ্তির পথে হাটছে। সরিষার ক্ষেত্রে ঘানি পদ্ধতিতে  মিডিয়া ও প্রশাসন উৎসাহ দিলেও অজ্ঞাত কারণে সয়াবিন বীজ ঘানিতে পেষা নিয়ে রয়েছে বিতর্ক।  এখন বৈদ্যুতিক স্ক্রু প্রেস বা মেকানিক্যাল প্রেস ব্যবহার করে বিদেশ থেকে অপরিশোধিত সয়াবিনের তেল সংগ্রহ করা হয় এবং  তেল পরিশোধন করা হয়। আর আমাদের দেশীয় উৎপাদিত সয়াবিন বীজ গো-খাদ্য বা মাছের ফিড হিসাবে ব্যবহার হচ্ছে গত একযুগ ধরে।

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন    
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী মিরাজ মাহমুদ
 
বার্তা ও বানিজ্যিক কার্যালয়ঃ কুশলা হাউজ, ১৩৮ বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সড়ক,
সদর রোড (শহীদ মিনারের বিপরীতে), বরিশাল-৮২০০।
© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
Developed by NEXTZEN-IT