কেতনার বিল বধ্যভুমিঃ শিশু শহীদ অমৃতর কথা কেতনার বিল বধ্যভুমিঃ শিশু শহীদ অমৃতর কথা - ajkerparibartan.com
কেতনার বিল বধ্যভুমিঃ শিশু শহীদ অমৃতর কথা

4:09 pm , December 26, 2023

কমল সেনগুপ্ত ॥ ১৬ মে ১৯৭১। আগৈলঝাড়ার রাজিহার ও রাংতা গ্রাম। দু’গ্রামের সীমানায় কেতনার বিল। কেতনার বিলে পাকিস্তানী হানাদারদের ভয়ে লুকিয়ে ছিল এ অঞ্চলের আটটি গ্রামের কয়েক হাজার নিরাপরাধ মানুষ। ঐদিন লুকিয়ে থাকা নিরীহ মানুষের উপর ভয়াবহ গণহত্যা চালায় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী। যা দক্ষিণাঞ্চলের সর্ববৃহৎ গণহত্যা। নির্মম এই গণহত্যায় কেতনার বিলের পাত্র বাড়িরই ১৯ জন শহীদ হন। মৃতদের কারো ঠাঁই হয়েছে গণকবরে। বহু লাশ খেয়েছে শেয়াল- কুকুরে। নাম হয়েছে বধ্যভূমি। কেতনার পথে পথে, মাঠে-ঘাটে, আকাশে বাতাসে আজও ছড়িয়ে আছে হানাদারদের বর্বরতা, নৃশংসতা। শুনলে কেঁদে ওঠে মন। আঘাত হানে চেতনায়। সেদিন কেতানার বিল এলাকায় যখন পৌঁছালাম তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। কথা হল পাত্র বাড়ীর রাজেন পাত্রের সাথে। পাশেই ছিলেন বিমল পাত্র। ১৯৭১ সালে তার বয়স ১৭। তাগড়া জোয়ান। বললেন কত রক্তাক্ত কাহিনী শুনবেন? এখানে স্বামী হারিয়েছে বহু অন্তঃস্বত্তা স্ত্রী, প্রাণ হারিয়েছে অন্তঃস্বত্তা মা। পরিবারের সবাইকে হারিয়ে আজও বেঁচে আছে সেদিনের ৫ বছরের কবিতা। সেদিন হানাদারদের হাত থেকে রেহাই পায়নি সদ্যজাত শিশুও। বলতে বলতে দীর্ঘশ্বাস। বুকের ব্যাথা বুকেই চেপে রেখে হাতের ইশারায় বললেন, ঐ খানে ১২ দিনের শিশু অমৃতকে পাক হানাদাররা পায়ের বুটের তলায় পিষে হত্যা করে। শেষ হয় অমৃতর ১২ দিনের পৃথিবী দেখা। আঁতকে উঠলাম। রাজেন জানালেন, ফুলি পাত্রের ৩ টি মেয়ের পর ছেলে সন্তান অমৃতর জন্ম। আনন্দের বন্যা বয়েছিল বাবা কার্তিকের মনে। ফুলি সন্তান নিয়ে তখন আঁতুড় ঘরে। ঘটনার দিন দেখলাম বিলের হাঁটু পানি ভেঙ্গে পাকিস্তানী হানাদারেরা আমাদের বাড়ির দিকে আসছে। মুহুর্মুহু গুলিবর্ষণ। আমরা উত্তর দিকে পালাতে শুরু করলাম। নিরাপদ দূর থেকে দেখলাম, অসুস্থ ফুলি নবজাতককে নিয়ে পালাবার চেষ্টা করছে। হঠাৎ একটা গুলি এসে লাগল পিঠে। উপুর হয়ে পড়ে গেল সে। আদরের সন্তান হাত থেকে ছিটকে গেল। রক্তাক্ত ফুলি। কিন্তু জননীর নাভিমূল ছেঁড়া ধন। এ অবস্থাতেই সন্তানকে কোলে তুলতে গেল সে। একটু সামনেই পড়ে আছে স্বামী ও তিন সন্তানের রক্তাক্ত লাশ। পাকিস্তানী জল্লাদরা তখন কাছে এসে গেছে। আবার গুলি। মাটিতে লুটিয়ে পড়ল ফুলি। তখন মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে হাত দিয়ে হাতরাতে হাতরাতে সন্তানকে খুঁজতে লাগল সে। কিন্তু একটা বুলেটে ছিটকে গেল ফুলির হাতের কব্জি। তখন ওদের গুলি শেষ। দেখলাম পাকিস্তানী জল্লাদরা উল্লাস করতে করতে এগিয়ে গেল শিশুটির দিকে। এক নরখাদক বুটের তলা দিয়ে পিষতে লাগলো অমৃতর কাঁচা নাভি। ওরা যেভাবে পিষতে চেয়েছিল মুক্তি পাগল বাঙ্গালীকে। ১২ দিনের অমৃত তখন মায়ের কোল ছেড়ে ধরণীর কোলে আশ্রয় নিয়েছে। পাক হানাদারেরা ফিরে গেল একটু পরেই। ফিরে এসে দেখলাম হাজার হাজার লাশ পরে আছে বিলের হাঁটু পানিতে, বাড়ির উঠোনে। আর অমৃতর পেট থেকে নীচের অংশ মাটিতে পিষে গেছে। মুখটা একটু হা-করা। ‘তবুও তার মুষ্টিবদ্ধ হাত উত্তোলিত, উদ্ভাসিত। কি এক দুর্বোধ্য প্রতিজ্ঞায়’। হু হু করে কেঁদে ওঠে মন। চোখ ভিজে আসে। চোখ ভেসে যায়। বুকে ক্ষোভের আগুন জ্বলে।
অমৃত! অমৃত!! তোমার হা-করা মুখে প্রতিদিন সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত অবধি হরতাল হবে একদিন। হয়ত প্রতিদিন। কিন্তু ত্রিশ লক্ষ শহীদের তালিকায় শিশুর সংখ্যা কতো? কেউ তার হিসেব জানি? আমরা কখনও ভেবেছি শিশু শহীদদের কথা? মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী নরপশুরা লক্ষ লক্ষ শিশু কিশোরকে নির্মম, নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে। কাউকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে, কাউকে আগুনে পুড়িয়ে, কাউকে বুটের তলায় পিষে। ভাবলাম কত নবজাতক, কত শিশুর রক্তের বিনিময়ে শৃঙ্খল মুক্ত আমাদের প্রিয় জন্মভূমি? আমাদের স্বাধীনতা? ইতিহাসে ওদের সবার নাম আজও লেখা হয়নি, পায়নি আলাদা কোন স্বীকৃতি, স্থাপিত হয়নি কোন স্মৃতিচিহ্ন।

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন    
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী মিরাজ মাহমুদ
 
বার্তা ও বানিজ্যিক কার্যালয়ঃ কুশলা হাউজ, ১৩৮ বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সড়ক,
সদর রোড (শহীদ মিনারের বিপরীতে), বরিশাল-৮২০০।
© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
Developed by NEXTZEN-IT