শুধু ফুটপাত নয়, হকারদের দখলে নগরীর জলাশয় ও বিনোদন পার্ক শুধু ফুটপাত নয়, হকারদের দখলে নগরীর জলাশয় ও বিনোদন পার্ক - ajkerparibartan.com
শুধু ফুটপাত নয়, হকারদের দখলে নগরীর জলাশয় ও বিনোদন পার্ক

3:03 pm , March 29, 2023

আরিফ আহমেদ, বিশেষ প্রতিবেদক ॥ বরিশাল নগরীর শুধু ফুটপাতই নয়, জলাশয়, পার্ক ও পুকুরের চারপাশ এখন দখল করে আছে অবৈধ দোকানপাট ও বিভিন্ন ক্ষুদে হকাররা। যেখানে হকার নেই সেখানে আছে মহেন্দ্র, ইজিবাইক ও মোটরসাইকেল অথবা ভাঙা ফুটপাতের মৃত্যুফাঁদ। প্রায় সব সড়কের ফুটপাত দখল করে আছে বিভিন্ন ছোট ছোট খাবার ঘর, চা দোকান ও মনোহরি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। রমজান উপলক্ষে গড়ে ওঠা ইফতার বাজারও কম নয়।
সরেজমিনে ২৯ মার্চ বরিশাল নগরীর চৌমাথা ঘুরে দেখা গেল নতুন নতুন অবৈধ খাবার দোকানের ভিড়ে হারিয়ে গেছে এখানকার সৌন্দর্যের অন্যতম আকর্ষণ চৌমাথা লেকটি। কেউ কেউ এটিকে পুকুর বা জলাশয়ও বলেন। ক্ষুদে দোকানের ভিড়ে পুকুরের তিনপাশেই হাঁটাচলা বন্ধ হয়ে গেছে। সেই সাথে দোকান থেকে ছুড়ে ফেলা বর্জ্য দূষিত করে দিচ্ছে পুকুরের জল। ফুটপাতের এই ক্ষুদে বাজারের দাপটে ভিতরের বড় বাজার চোখেই পরেনা বলে জানালেন এখানকার ব্যবসায়ীদের একজন আলাল খান। এখানে দায়িত্বরত ট্রাফিক কনস্টেবল জানালেন, সন্ধ্যার পর এখানে সড়ক অচল হয়ে যায় মানুষের ভিড়ে। বেশিরভাগই ফুচকা সামুচা, ডালপুরি ইত্যাদি ফাস্টফুড খেতে আসা মানুষ। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের বসানো এসব দোকান নিয়ে কথা বলার ক্ষমতা নেই বাসিন্দা বা পথচারীদের কারো। এ চিত্র শুধু চৌমাথা নয়, বরিশালের সদর রোড, জেলখানা মোড় থেকে ফজলুল হক এভিনিউর সিটি করপোরেশন ভবনের সামনের সড়কের দুপাশে, আদালত পাড়া, পোর্টরোড, লঞ্চঘাট, হেমায়েত উদ্দিন সড়ক, চকবাজার, কাঠপট্টির ফুটপাতসহ নগরীর বেশিরভাগ দখল করে চলছে হকারদের অবৈধ দোকানপাট বসানোর প্রতিযোগিতা। কোথাও পায়ে চলা এতটুকু পথ অবশিষ্ট নেই সাধারণ মানুষের যাতায়াতের জন্য।
এসব সড়কে চলাচলে পথচারীদের দূর্দশা দেখেও না দেখার ভান করে যাচ্ছেন সংশ্লিষ্ট প্রশাসন।
অনুসন্ধানে ও সিটি করপোরেশন সুত্রে জানা যায়, বর্তমানে বরিশাল সিটি কর্পোরেশন এলাকায় বসবাসকারী জনসংখ্যা প্রায় ৫ লক্ষ ও আয়তন ৫৮ বর্গ কিলোমিটার। বর্তমানে ৩০টি ওয়ার্ডের আওতায় বরিশাল নগরীর মোট সড়কের পরিমাণ ৫৯৩ কিলোমিটার। এর মধ্যে পিচ ঢালাই সড়কের আয়তন ২৬৭ কিলোমিটার। করপোরেশন কর্তৃপক্ষের দাবি, বেহাল সড়কের পরিমাণ মাত্র ৮৫ কিলোমিটার। আর ফুটপাতে কোনো সমস্যা নেই। তবে নগরবাসী বলছে, এর পরিমাণ আরও অনেক বেশি। বলা চলে পাকা সড়কের এক-তৃতীয়াংশ সড়কই বেহাল।
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে সিটি করপোরেশন ভবনের সামনে থেকে সড়কের সব ফুটপাত এখন যেন স্থায়ীভাবে হকারদের দখলে। সিটি ভবনের সামনের বয়োবৃদ্ধ হকার জানালেন, মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ আমাদের বসিয়েছেন। তাই তিনি যতদিন আছেন, আমাদের কাউকে কোনো ট্যাক্স দিতে হয়না।
যদিও নির্ভরযোগ্য সুত্রে জানা যায়, সিটি ভবনের সামনের নির্দিষ্ট কয়েকটি দোকান ছাড়া আশপাশের ফুটপাতের জন্য প্রতিদিন পুলিশের জন্য ৩০ টাকা ও নেতাদের জন্য দোকান ভেদে ১৫০ থেকে ৩০০ টাকা গুনতে হয় এসব অবৈধ দোকানীদের। কিছু কিছু দোকান বসাতে রীতিমতো বড় অংকের জামানতও দিতে হয়েছে বলে জানা গেল অনুসন্ধানে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন রাজনৈতিক নেতা জানান, শুধু সরকার দলীয় প্রভাবশালীরাই নয়, এলাকার বিভিন্ন প্রভাবশালী নেতা ও প্রশাসন যৌথভাবেই এই ফুটপাত দখল বাণিজ্য করছে। নগরীর গুরুত্বপূর্ণ প্রায় প্রতিটি সড়কের ফুটপাত, বেলস পার্ক বা বঙ্গবন্ধু উদ্যানের মডেল স্কুল সংলগ্ন দোকানপাট সবই তারা ভাগবাটোয়ারা করে খাচ্ছে।
এছাড়াও বিভিন্ন সড়কে রাস্তার উপর মোটরসাইকেল রাখা কিম্বা ফুটপাতের ম্যানহোলের ঢাকনা ভাঙা বা সরিয়ে রাখার কারণেও ভোগান্তিতে পড়তে হয় নগরবাসীকে। জিলা স্কুলের সামনের সড়কে এবং আমতলার মোড়ে সড়ক জনপদের ফুটপাতের দিকে তাকালে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এসব সড়কে প্রায়শই দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে পথচারী ও শিক্ষার্থীরা। আমতলা মোড়ের পানির ট্যাঙ্ক এলাকাতো এখন পুরোটাই হকারদের দখলে। মডেল মসজিদকে কেন্দ্র করে এখানে এখন জমজমাট ফুটপাত বাণিজ্য। জেলখানা মোড় থেকে সদর রোড, হেমায়েত উদ্দিন সড়ক, পোর্ট রোডের পুরোটাই হয় হকার নয়তো রাস্তার উপর রাখা ইজিবাইক, অটোরিকশা ও মোটরসাইকেল দখল করে রাখছে ঘন্টার পর ঘন্টা। নগরবাসীর এই ভোগান্তি যেন দেখার কেউ নেই। পরিবেশবিদ কাজী মিজানুর রহমান বলেন, এ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করা না গেলে দুর্ঘটনা ও যানজট বাড়তেই থাকবে। তাছাড়া বিশেষ বিশেষ স্থান যেমন চৌমাথার পুকুর বা লেকটি, পার্ক এলাকা হকার মুক্ত রাখা উচিত। কেননা বিদেশি অতিথিদের কাছে এসব স্থান শহরের আকর্ষণ তুলে ধরে।
বরিশাল নগরীর সদর রোড, গীর্জা মহল্লা, চকবাজার, আমতলার মোড় থেকে চৌমাথা মার্কেট ও রূপাতলী চত্ত্বর, বাংলা বাজার মোড়, ব্রাউন কম্পাউন্ড সড়ক থেকে নতুন বাজার, নথুল্লাবাদ গোলচত্বর এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সড়ক ও ফুটপাতের পুরোটাই বেশিরভাগ হকারদের দখলে। আদালত পাড়ায়তো রীতিমতো রাস্তার ওপরই স্থায়ী পসরা সাজিয়েছে হকারেরা। বাহারি রকমের ফল, সবজি, কসমেটিক্স সামগ্রী, পোশাক এমন কিছু নেই যা এখানের ফুটপাতে বিক্রি হয় না। আর কাঁচা বাজারতো বলাবাহুল্য। প্রায় সব এলাকাতেই সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ফুটপাতগুলো হকারদের দখলে চলে যায়। এলাকা ভেদে রাত ১০টা বা ১ পর্যন্ত তাদের দখলেই থাকে ফুটপাত। রাস্তার উপর দোকান বসিয়ে ব্যবসা করার কারণে প্রায়ই দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে পথচারীরা। কয়েকজন পথচারী এ নিয়ে নাকি সিটি মেয়র বরাবর আবেদনও করেছেন বলে জানালেন। একজন বললেন, এ দূর্ভোগ যেন শেষ হওয়ার নয়। আসলে ফুটপাত দখলমুক্ত রাখতে টেকসই কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না বিধায় এ ভোগান্তি চলতেই থাকে।
সন্তান নিয়ে স্কুলে যাবার পথে এক মা বলেন, নগরীর সড়কে ও ফুটপাতে আমাদের জন্য চলাচল করা খুবই কঠিন। যেখানে সড়কে দুর্ঘটনার শিকার হতে হয়, সেখানে ফুটপাতেরও যদি এমন অবস্থা হয়, তাহলে সেটা কোনোভাবেই মানা যায় না। চলার পথে হকার ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে ক্রেতাদের যে ভিড়, এর মাঝে চলাচল করা সত্যিই কঠিন। নতুনবাজার এলাকায় বিএম কলেজ ছাত্রী সায়মা বলেন, সড়ক ও ফুটপাত যে যার মতো করে দখল করেছে। পথচারীদের ভোগান্তি দেখার সময় কারো নেই। ঝুঁকি নিয়েই চলতে হয় আমাদের। আরেক শিক্ষার্থী মাকসুদা বলেন, ফুটপাত দিয়ে হাঁটার সময় অনেক মানুষের সঙ্গে ধাক্কা লাগে। আবার কেউ কেউ ইচ্ছা করেই ধাক্কা দেয় । এতে খুবই বিব্রত হই। বিশেষ করে ফুটপাত ব্যবহারে নারী পথচারীদের অসুবিধা খুব বেশি।
স্থানীয় একটি প্রাইভেট ক্লিনিকের নার্স ফাতেমা বলেন, অফিস থেকে ফেরার পথে ফুটপাত ধরে বাসায় ফিরি। কিন্তু নগরীর বেশিরভাগ এলাকার সড়ক ও ফুটপাত ব্যবসায়ীদের দখলে। এতে করে বেশি ভোগান্তির শিকার হন পথচারীরা। বছরের পর বছর এই ভোগান্তি চললেও সিটি করপোরেশনের স্থায়ী কোনো উদ্যোগ আমরা দেখিনি।
বাংলা বাজারের ব্যবসায়ী ধলু মিয়া বলেন, আমাদের এই সড়ক এতটাই ছোট যে ক্রেতাদের কোনো রিকশা বা গাড়ি পাশে দাঁড় করালেই যানজট লেগে যায়। এর উপরে গত দুই মাসে শহরে কয়েকগুণ ইজিবাইক ও অটোরিকশা বেড়েছে। নতুন বাজারের বাসিন্দা নাসিম তালুকদার বলেন, সকাল থেকে প্রতিদিন ঘণ্টাখানেক আটকে থাকতে হয় নতুন বাজার থেকে নথুল্লাবাদ যেতে। এখনই এই অবস্থা হলে দুই বছর পর কি হবে? নাসিম তালুকদারের প্রশ্নের জবাব দিলেন বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ (বিএমপি)’র উপ-পুলিশ কমিশনার ট্রাফিক এস এম তানভীর আরাফাত। তিনি জানালেন, এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামী দুই বছরের মধ্যে যানজটে অচল হয়ে যাবে বরিশাল নগরী। যদি এর আগেই অভ্যন্তরীণ সড়ক প্রশস্তকরণ, ইজিবাইক ও অটোরিকশার অনুপ্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করা না হয়। বাইপাস সড়কসহ এজন্য আমরা সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষকে বেশকিছু প্রস্তাবনা ইতিপূর্বে দিয়েছি।

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন    
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী মিরাজ মাহমুদ
 
বার্তা ও বানিজ্যিক কার্যালয়ঃ কুশলা হাউজ, ১৩৮ বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সড়ক,
সদর রোড (শহীদ মিনারের বিপরীতে), বরিশাল-৮২০০।
© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
Developed by NEXTZEN-IT