প্যাকেটজাত গরুর মাংসে ভেজাল প্যাকেটজাত গরুর মাংসে ভেজাল - ajkerparibartan.com
প্যাকেটজাত গরুর মাংসে ভেজাল

3:33 pm , February 23, 2023

হোটেল রেস্তোরায় গরুর বদলে খাওয়ানো হচ্ছে মহিষের মাংস

বিশেষ প্রতিবেদক ॥ দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত বৃদ্ধির সুযোগে খোলা বাজারের মাংসের দোকানগুলোতেও পড়েছে এর প্রভাব। কেজি প্রতি গরুর মাংসের দাম এখন ৭০০ টাকা। আর এই সুযোগে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী মহিষের মাংসও বিক্রি করছে একই দামে। বিশেষ করে বরিশালের নামি দামি হোটেল রেষ্টুরেন্টে বিভিন্ন কৌশলে সাপ্লাই হচ্ছে মহিষের মাংস। কোথাও কোথাও মহিষ ও গরুর মাংস মিশিয়ে প্যাকেটজাত করে সাপ্লাই হচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। তবে এসব অভিযোগ একবারেই ভিত্তিহীন এবং গরুর চেয়ে মহিষের মাংসের দাম আরো বেশি বলে দাবী বরিশালের মাংস ব্যবসায়ীদের। তবে প্যাকেটজাত হিমায়িত মাংসে বাংলাদেশের বাজার সয়লাব হচ্ছে এবং ভারত থেকে এসব প্যাকেটজাত মাংস আমাদানি হচ্ছে বলে অভিযোগ করলেন বরিশালের গরুর মাংস ব্যবসায়ীদের বেশিরভাগ অংশ।
বরিশালের উল্লেখযোগ্য পোর্ট রোড বাজারের মাংস ব্যবসায়ী আজমিরি ও সেলিম মিট হাউস দোকানের স্বত্বাধিকারী রনি আহমেদ, সেলিম ও সরোয়ার জানালেন, বাজারে মাংসের দাম বাড়ার পরপরই বরিশালের কয়েকটি দোকানে প্যাকেটজাত মাংসের চাহিদা খুব বেড়ে গিয়েছিল। এমনকি হাজী বিরিয়ানির বিরুদ্ধেও এ অভিযোগ ছিলো যে তারা ভারতীয় হিমায়িত মাংসের ব্যবহার করেন বলেই পরিমাণে মাংস বেশি দিতে পারেন। এছাড়াও বড় বড় বেশকিছু হোটেল ব্যবসায়ীরা প্যাকেটজাত মাংসের দিকে ঝুঁকে ছিলেন। তবে এখন সেটা অনেকটা কমে এসেছে। ঢাকার বেশকিছু শপিং মলে এই প্যাকেটজাত হিমায়িত মাংসের ব্যবহার রয়েছে, সেটা দেখে বরিশালেও বেশকিছু শপিং মলে প্যাকেটজাত হিমায়িত মাংস বিক্রি হচ্ছে। রনি বলেন, শুনেছি শপিং মলের ব্যবসায়ীরা বৈধপন্থায় ভারত থেকে এসব প্যাকেটজাত হিমায়িত মাংসের আমদানি করছেন ও সারাদেশে সাপ্লাই দিচ্ছেন। এটা আমাদের জন্য যেমন হুমকি তেমনি ক্রেতাদের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হবে বলে দাবী করেন বরিশালের প্রায় সব মাংস ব্যবসায়ীরাই। শুধু তাই নয়, প্যাকেটজাত হিমায়িত মাংসের হালাল হারাম বিচার করাও কষ্টসাধ্য বলে জানান বরিশাল জেলা ইমাম সমিতির সভাপতি মাওলানা আব্দুল মান্নান। আর বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ হচ্ছে সুস্থ সুন্দর জীবনে থাকতে চাইলে শুধু মাংস নয়, প্যাকেটজাত হিমায়িত সব খাবারই পরিহার করতে হবে।
২২ ফেব্রুয়ারী বুধবার বরিশালের মাংস ব্যবসায়ী, হোটেল রেষ্টুরেন্টের মালিক ও ম্যানেজারসহ সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলে নগরীর মাংস বিক্রি ও খাওয়ার উপযোগীতা নিয়ে তৈরি হয়েছে বিশাল সংশয়। এরউপর বরিশাল সিটি করপোরেশনের আওতাধীন এলাকায় মাংস বিক্রির প্রক্রিয়ায় সিটি করপোরেশনের কোনো নজরদারি খুঁজে পাওয়া যায়নি। এমনকি একমাত্র কসাইখানাটিও অব্যবহৃত হয়ে ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে গেছে। গরু-মহিষ জবাইয়ের জন্যও নেই কোনো নীতিমালা এ শহরে। নগরীর উল্লেখযোগ্য বাজার পোর্ট রোড, নতুন বাজার, চৌমাথা বাজার, বাংলা বাজারসহ ছোটখাট বাজার বা পাড়া মহল্লায় প্রায় ১০০টির মতো মাংসের দোকান রয়েছে। কিন্তু নেই কোনো মাংস ব্যবসায়ীদের সংগঠন। পুরান বাজার বা কাটপট্টি বাজারে একটি মাংস ব্যবসায়ীদের সংগঠন থাকলেও তার কোনো কার্যক্রম বা অনুমোদন নেই। এই মাংসের দোকানগুলোর মধ্যে হাতেগোনা কয়েকজন ব্যাবসায়ী নগরীর প্রায় ২৫০টি ছোটবড় খাবারের দোকানে মাংস সাপ্লাই দিচ্ছে। তবে সবচেয়ে বেশি দিচ্ছে পুরান বাজারে।
চরকাউয়া খেয়াঘাট বাজারে রানা ও  সবুজের দুটি মাংসের দোকান রয়েছে। মাংস ব্যবসায়ী রানা গরু কিনতে যশোরে গেছেন জানিয়ে দোকানের কর্মচারী বলেন, নগরীর ছোটবড় খাবারের দোকানে তারা গড়ে প্রতিদিন ৫০-৬০ কেজি গরুর মাংস সাপ্লাই দিচ্ছেন। হোটেল রেষ্টুরেন্টের মালিকদের চাহিদা অনুযায়ী তারা এটা সাপ্লাই দেন। বেশিরভাগ গরুই তারা যশোর থেকে কিনে আনেন।
চৌমাথা ও বাংলা বাজারের মাংস ব্যবসায়ীদেরও একই দাবী। তাদের সকলের অর্থাৎ বরিশাল জেলার বেশিরভাগ মাংসই আসে সাতক্ষীরা ও যশোর থেকে। বেশিরভাগ গরুই ভারত থেকে আসে ওই অঞ্চলে। সেখানের গরুর হাট থেকেই সারাদেশে ছড়িয়ে পরে।
চরকাউয়া ডিসি ঘাট সংলগ্ন হোটেল ব্যবসায়ী সবুজ বলেন, আগে আমার রেষ্টুরেন্টে গড়ে ২০ কেজি মাংস প্রয়োজন হতো, এখন সর্বোচ্চ ৩ কেজি মাংস প্রয়োজন হয়। আমি খেয়াঘাট বাজারের ব্যবসায়ী রানার কাছ থেকে নিয়মিত মাংস এনে রান্না করি। এদিকে প্রতিদিন পনেরো কেজি মাংসের চাহিদা কেডিসি রোডের মদিনা রেষ্টুরেন্টে। সদর রোডের দুটি বড় রেষ্টুরেন্টেও রানার মাংস চলে। যা বেশিরভাগই বয়স্ক গরু বা মহিষের মাংস বলে অভিযোগ হোটেল রেষ্টুরেন্ট গ্রাহকদের। গ্রাহকদের অভিযোগ,  ১৩০ বা ১৬০ টাকায় হাফপ্লেট মাংস দেয়। এতে মাত্র চার-পাঁচ  টুকরো থাকে। চিবোতে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়। মোটা আঁশ দেখে বোঝা যায় অতিবয়স্ক নয়তো মহিষের মাংস এগুলো।
হোটেল রেষ্টুরেন্ট মালিকদের দাবী তারা চুক্তি করে নির্দিষ্ট মাংস ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বাজার দরের কিছুটা কমে মাংস কেনেন। একসাথে অনেক পরিমাণ ও নিয়মিত হবার কারণে তাদের থেকে দাম কিছুটা কম রাখা হয়।
আবার অনেক বড় রেষ্টুরেন্টের মালিক নির্দিষ্ট দামে ২০ কেজির হিমায়িত মাংসের বাক্স ক্রয় করেন শপিং মল থেকে। এখানে ২০ কেজির নীচে বিক্রি হয়না বলেও জানান তারা।
তবে এমনটা ঢাকায় খুব দেখা গেলেও বরিশালে চোখে পড়েনি বা কোনো অভিযোগও পাওয়া যায়নি দাবী করে বরিশাল ভোক্তা অধিকার সংরক্ষন অধিদপ্তরের উপপরিচালক অপূর্ব অধিকারী বললেন, মাংসে পানি দিয়ে ওজন বাড়ানোর অভিযোগে নতুন বাজারের মহিলা মাংস বিক্রেতাকে এবং বিএসটিআইয়ের অনুমোদন না থাকায় ও কোনো আমদানি রশিদ দেখাতে না পারায় গোড়াচাঁদ দাস রোডের প্রিমিয়ার মিটকে জরিমানা করা হয়েছে। এরা বরিশালে প্যাকেটজাত হিমায়িত মাংস বিক্রি করছিলো। তিনি আরো বলেন, প্যাকেটজাত হিমায়িত মাংসের আমদানি রশিদ দেখাতে হবে এবং অবশ্যই ব্যবহার বিধিসহ প্যাকেটের গায়ে মেয়াদ লিপিবদ্ধ থাকতে হবে। এটা না থাকলেই সেটা সম্পূর্ণ অবৈধ হবে।
মেডিসিন ডাঃ আযাদ, মনিরুজ্জামান এবং বিভাগীয় স্বাস্থ্য বিভাগের উপ পরিচালক শ্যামল কৃষ্ণ মন্ডল বলেন, তাজা খাদ্যের বিকল্প নেই। আমরা বরিশালে তাজা খাবার সহজেই পাচ্ছি। কিন্তু ঢাকাসহ বিশ্বের অনেক বড় বড় শহরে প্যাকেটজাত হিমায়িত খাদ্য নির্ভর মানুষ। সেক্ষেত্রে এই প্যাকেটজাত মান যাচাই-বাছাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পঁচা জিনিসটা প্যাকেটজাত হয়ে প্রিজার্বড করা হলে তা বোঝার সাধ্য কারো নেই। তাই হিমায়িত করতেও নির্দিষ্ট মাপঝোঁপ রয়েছে।
বরিশালের সিভিল সার্জন ডাঃ মারিয়া হাসান বলেন, বাংলাদেশের প্যাকেটজাত হিমায়িত খাদ্যের মান নির্ণয়ের জন্য বিএসটিআই কাজ করছে। এজন্য অনেককিছু যাচাই-বাছাই করতে হয়। মানব স্বাস্থ্যের জন্য সামান্যতম ক্ষতিকর বুঝতে পারলে তা সাথে সাথে নিষিদ্ধ করা জরুরী।
ডাঃ মারিয়া আরো বলেন, বিশ্ব বাজারে ক্রমাগত প্যাকেটজাত খাদ্যের চাহিদা বাড়ছে। গুণগত মান ঠিক থাকলে সব খাবারই খাওয়া যাবে এবং এটা ক্ষতিকরও হবেনা। তবে সবার আগে গুণগত মান যাচাই করতে হবে।
প্যাকেটজাত হিমায়িত মাংস কতটা হালাল তা বিবেচনার দাবী রাখে জানিয়ে বরিশাল জেলা ইমাম সমিতির সভাপতি মাওলানা আব্দুল মান্নান বলেন, সূরা আল আনআমের  ১১৮ থেকে ১২১ আয়াত অনুসরণ করলে জবাইকৃত পশুর মাংস কতটা হালাল তা পরিষ্কার বোঝা যাবে। আয়াত ১১৮তে বলা হয়েছে ‘যে জন্তুর ওপর আল্লাহর নাম উচ্চারিত হয়, তা থেকে তোমরা আহার করো, যদি তোমরা তাঁর বিধানগুলোতে বিশ্বাসী হও। ১১৯ আয়াতে বলা হয়েছে ‘তোমাদের কী হয়েছে যে যেসব জন্তুতে আল্লাহর নাম নেওয়া হয়েছে, তোমরা তা থেকে আহার করবে না অথচ আল্লাহ ওই সব জন্তুর বিশদ বিবরণ দিয়েছেন, যেগুলো তোমাদের জন্য হারাম করেছেন। তবে সেগুলোও তোমাদের জন্য হালাল, যখন তোমরা নিরুপায় হয়ে যাও। নিঃসন্দেহে অনেকে অজ্ঞতাবশত নিজেদের খেয়ালখুশি দিয়ে অন্যকে বিপথগামী করে। নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালক সীমালঙ্ঘনকারীদের সম্পর্কে সবিশেষ অবহিত। আর আয়াত ১২১ বলছে,  যেসব জন্তুর ওপর আল্লাহর নাম নেওয়া হয়নি, তার কিছুই তোমরা আহার করো না; তা অবশ্যই পাপ। নিশ্চয়ই শয়তানরা তাদের বন্ধুদের তোমাদের সঙ্গে বিবাদ করতে প্ররোচনা দেয়; যদি তোমরা তাদের অনুসরণ করো, তোমরাও মুশরিক হয়ে যাবে।
তিনি বলেন, গোশত বা মাংস খাওয়ার বিষয়ে এই স্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে যখন তখন সন্দেহের কোনো অবকাশই ইসলামে নেই।
মাওলানা আব্দুল মান্নান আরো বলেন, শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বব্যাপী এখন প্যাকেটজাত গোশতের ব্যাপক বাজার রয়েছে। বাংলাদেশে কম হলেও বিদেশে এর চাহিদা অনেক বেশি। সাধারণত মানুষ বিভিন্ন শপ থেকে প্যাকেটজাত গোশত কিনে খেয়ে থাকেন। ঢাকায় এটা খুব চালু হয়েছে ইদানিং কিন্তু প্যাকেটজাত মাংসের ক্ষেত্রে জন্তু হালাল কিনা, জন্তুর জবাইকারী মুসলিম নাকি অন্য ধর্মাবলম্বী, জন্তু জবাইয়ের সময় আল্লাহর নাম নেওয়া হয়েছে কিনা এগুলো অজানা রয়ে যায়।
ইসলামে হালাল জন্তুর বিবরণ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জন্তু হালাল করার প্রক্রিয়াও বলে দেয়া হয়েছে। এজন্য প্যাকেটজাত মাংসের ব্যাপারে যদি জানা থাকে, এই মাংস শরিয়তসম্মত পদ্ধতিতে মুসলিমের হাতে জবাইকৃত হালাল প্রাণির মাংস, তাহলে সেই মাংসগুলো খেতে কোনো অসুবিধা নেই।
কিন্তু প্যাকেটকৃত মাংসের ব্যাপারে যদি নিশ্চিতভাবে জানা না যায়, এটা মুসলিম নাকি অন্য ধর্মাবলম্বীর জবাইকৃত জন্তুর মাংস, তাহলে এমন অবস্থায় প্যাকেটজাত মাংস না খাওয়া উত্তম ।
তিনি আরো বলেন, যদি নিশ্চিতভাবে জানা যায় প্যাকেটজাত মাংস কোনো কাফের বা মুশরিকের জবাইকৃত জন্তুর, তাহলে এমন প্যাকেটজাত মাংস খাওয়া কোনোভাবেই বৈধ নয়। অনুরূপভাবে কোনো মুসলমান বা প্রকৃত আহলে কিতাব (আসমানি কিতাবের অনুসারী) জবাই করে, কিন্তু শরিয়তসম্মত মাধ্যমে আল্লাহর নাম নিয়ে ধারালো চাকু বা এজাতীয় কিছু দিয়ে জবাই করা হয়নি; বরং মেশিনে বা এই জাতীয় কোনো পন্থায় আল্লাহর নাম নেওয়া ছাড়া জবাই করা হয়েছে, তাহলে এমন প্যাকেটজাত মাংসও খাওয়া জায়েজ হবে না।
তিনি বলেন, আহলে কিতাব (আসমানি কিতাবের অনুসারী) বলতে শুধু মুসলমান হবে তা নয়। বরং বাস্তবে ইহুদি-খ্রিস্টান হলে এবং তারা আল্লাহর নামে হালাল প্রাণী জবাই করলে সেই প্রাণির মাংস খাওয়া জায়েজ হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বর্তমানে তারা প্রকৃত আহলে কিতাব নয়। তাই তাদের জবাইকৃত জন্তুর প্যাকেটজাত গোশত খাওয়ার ব্যাপারেও সতর্কতা অবলম্বন জরুরি। মনে সন্দেহ জমে এমন মাংস না খাওয়াই বাঞ্ছনীয় ও বাস্তবতানির্ভর বলে জানান মাওলানা আব্দুল মান্নান।

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন    
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী মিরাজ মাহমুদ
 
বার্তা ও বানিজ্যিক কার্যালয়ঃ কুশলা হাউজ, ১৩৮ বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সড়ক,
সদর রোড (শহীদ মিনারের বিপরীতে), বরিশাল-৮২০০।
© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
Developed by NEXTZEN-IT