ইটভাটা নিয়ে চলছে টাকার খেলা ইটভাটা নিয়ে চলছে টাকার খেলা - ajkerparibartan.com
ইটভাটা নিয়ে চলছে টাকার খেলা

3:26 pm , January 25, 2023

বিশেষ প্রতিবেদক ॥ ইটভাটার আগুনে শুধু গাছ নয়, এবার খালপাড়ের জমির মাটি কেটে নিয়ে তা নদী আকৃতি পেয়েছে বেশিরভাগ গ্রামে। অন্যদিকে উজাড় হচ্ছে ফসলি জমি। কৃষকের জমির মাটি কেটে বদলী জমি নিতে বাধ্য করার অভিযোগ অনেক ইটভাটা মালিকের বিরুদ্ধে। অভিযোগ নিয়ে গেলে মালিক পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘আমাদের কেনা জমিতে আমরা বরিশালের পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারাসহ  সংশ্লিষ্ট প্রশাসন। জেলায় ৫শ ইটভাটার বেশিরভাগই অবৈধ। এসব অবৈধ ইটভাটা টাকার বিনিময়ে মৌখিকভাবে অনুমোদন দেয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। প্রতিটি অবৈধ ইটভাটা থেকে একথেকে ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত উৎকোচ  নেন বরিশালের পরিবেশ অধিদপ্তরের  কর্মকর্তারা।
অনুসন্ধানে এমন অভিযোগ উঠে এসেছে গৌরনদী, আগৈলঝাড়া ও উজিরপুর এলাকার ইটভাটা মালিকদের কাছ থেকে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ইটভাটা মালিক বেশকিছু প্রমাণপত্র দেখিয়ে বলেন, গত ২৭ ডিসেম্বর পরিবেশ অধিদপ্তরের লোক এসে এক লাখ টাকা নিয়ে গেছে। আরো এক লাখ দেয়ার নোটিশ দিয়ে গেছে বলে জানান তিনি। আশেপাশের আরো পাঁচটি ইটভাটা থেকেও সেদিন টাকা নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও সদর উপজেলার চাঁদপুরা ইউনিয়নের তালুকদার হাটের একটি রেস্তোরায় ইটভাটা মালিকদের সাথে হাঁস রুটি পিঠার নিমন্ত্রণ রক্ষা করেছেন বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা।
এদিকে সরেজমিনে গত ২২ জানুয়ারী উজিরপুর, হিজলা, মেহেন্দিগঞ্জ ও সদর উপজেলার চাঁদপুর ইউনিয়নের পশ্চিম চাঁদপুরা, ঘোপের হাট ও পূর্ব কর্নকাঠী এলাকা ঘুরে দেখা গেছে ইটভাটার ভয়ঙ্কর আগ্রাসন। এখানে ঘোপের হাট, চরকরঞ্জী, রাণীরহাট সংযোগ খালটি এখন নদীতে পরিণত হয়েছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে যেসব এলাকায় ইটভাটা হচ্ছে তার আশেপাশে ফলজ বৃক্ষের ফলদান ব্যাহত হচ্ছে। কয়লার পাশাপাশি অবাদে ব্যবহার হচ্ছে গাছ। আর এইসব ইটভাটার বেশিরভাগই অবৈধ বলে দাবী পরিবেশবিদদের। চরকরঞ্জী ও কর্ণকাঠী গ্রামের ভিতরে ঘনবসতি পূর্ণ এলাকায় পাশাপাশি দুইটি ইটভাটা নষ্ট করছে সামাজিক পরিবেশ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা। হেরিংবন ও মাটির সড়কে মাটি বোঝাই ট্রাকের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সড়ক। গ্রামবাসী প্রতিবাদ বা প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করলেই তেড়ে আসছে মাস্তান বাহিনী। তারা সবাই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, প্রশাসনেও সব তাদের লোক। ফলে বন্ধ সব অভিযোগ ও প্রতিবাদ এখন। এমনটাই জানালেন সদরের চরকাউয়া ইউনিয়নের পূর্ব কর্ণকাঠী গ্রামের বাসিন্দারা। এখানে ইটভাটা দুটোর মালিক মিলন হাজী ও সজীব মৃধাসহ আরো কয়েকজন নেতা শ্রেণির লোক। একই অভিযোগ জানান চরকরঞ্জী থেকে ঘোপের হাট ও তালুকদার হাট এলাকার বাসিন্দারা। তালুকদার হাট থেকে ঘোপের হাট হয়ে বৈরাগ বাড়ি সড়কের উন্নয়ন কাজ বন্ধ হয়ে আছে এখানের একটি ইটভাটার মালিকের স্বেচ্ছাচারিতায়। কারণ, মূল রাস্তার নকশা রয়েছে এই রচি ব্রীক ফিল্ডের ভিতর দিয়ে। সাইফুল ইসলাম দুলাল হাওলাদার নামের প্রভাবশালী নেতা এই ব্রিক ফিল্ড এর মালিক। তিনি বরিশাল এসি ল্যান্ডের সাথে সমঝোতা করে এই কাজ আটকে রাখার অভিযোগ। শুধু তাই নয়, এখানে খাল পাড় সংলগ্ন সব জমি এখন তার ও কবির ফকিরের দখলে। ইটভাটার জন্য মাটি কেটে কেটে কয়েকটি স্থানে খালের আকৃতি বদলে দিয়েছেন তারা। তাদের সম্পর্কে জানার জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরে ফোন করলে কর্মকর্তা জানান,  এমন কোনো অভিযোগ পায়নি তারা। অথচ গ্রামবাসীর অভিযোগ লিপিতে তাদের স্বাক্ষর রয়েছে।
বৈধ না অবৈধ ইটভাটা এগুলো তা জানেন না গ্রামবাসী। তবে ২০১৯ সালে সংসদে পাসকৃত বাংলাদেশ সরকার ইটভাটার জন্য যে নীতিমালা প্রনয়ণ করেছে তা মানা হচ্ছে কিনা সেটাও তদারকি হয়না বলে অভিযোগ অনেকের।
নীতিমালায় বলা হয়েছে – প্রশাসকের অনুমোদনক্রমে কোনো ব্যক্তি ইট প্রস্তুত করিবার উদ্দেশ্যে মজা পুকুর বা খাল বা বিল বা খাঁড়ি বা দীঘি বা নদ-নদী বা হাওর-বাঁওড় বা চরাঞ্জল বা পতিত জায়গা হইতে মাটি কাটিতে বা সংগ্রহ করিতে পারিবেন : তবে শর্ত থাকে যে, ইটভাটার লাইসেন্সের জন্য আবেদনপত্রে প্রস্তাবিত ইটভাটার মালিক কর্তৃক ইট প্রস্তুতের মাটির উৎস উলেখপূর্বক হলফনামা দাখিল করিতে হইবে। উপধারা (৩) এ পরিবর্তন এনে বলা হয়েছে – “ইটের কাঁচামাল হিসেবে মাটির ব্যবহার হ্রাস করার উদ্দেশ্যে সরকার, সরকারি গেজেট প্রজ্ঞাপন দ্বারা, নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে ইটভাটায় উৎপাদিত ইটের একটি নির্দিষ্ট হারে ছিদ্রযুক্ত ইট ও ব্লক প্রস্তুতের জন্য নির্দেশনা জারি করিতে পারিবে।”
কিন্তু বরিশালের চরকাউয়া,  চাঁদপুরা, চরামদ্দির সঠিখোলাতে খালের পাড়ে আবাদি জমিতে গড়ে ওঠা পাঁচ থেকে ছয়টি ইটভাটা অবাধে খালপাড় থেকেই মাটি কেটে নিচ্ছে। আর এসব ইটভাটাগুলোতে অবাধে পুড়ছে কাঠ।
অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, বরিশালের ১০ উপজেলার ৫০০ প্রায় ইটভাটা এখন। তবে পরিবেশ দপ্তর বলছে, ৩০০ এর বেশি হবে। এর মধ্যে  মধ্যে ৫০/৬০টির পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র রয়েছে। বাকী একটিরও কোনো ছাড়পত্র নেই। আর ২৮টি জিগজ্যাগ কিলন পদ্ধতির চিমনির ইটভাটা বাদে বাকি সবগুলোতেই অবৈধভাবে কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। যারা কয়লা ব্যবহার করছে তা  নিম্নমানের কয়লা। সেটাও আবার ব্যবহার না করে সাজিয়ে রাখা হয় দীর্ঘদিন। এটা জেনেও না জানার ভান করে আছে প্রশাসনের লোকেরা। কারণ, প্রভাবশালী এসব ইটভাটা মালিক মুহুর্তেই বদলী ঘটাতে পারেন কর্মকর্তাদের অবস্থান। পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, প্রতি মাসে জেলার ইটভাটাগুলোতে ১১ লাখ ৮০ হাজার মণ কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। এ হিসাব পরিবেশ দপ্তরে থাকার পরও ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ খুব একটা চোখে পড়েনা কখনোই।
সরজমিনে বরিশালের হিজলা উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় কৃষি ফসলি জমিতে প্রায় অর্ধশতাধিক অবৈধ ইট ভাটা দেখা গেছে। এসব ইটভাটা থেকে রক্ষা পায়নি কবরস্থানের জমিও। প্রতিটি ইটভাটায় জ্বালানি হিসাবে কয়লা ব্যবহারের কথা থাকলেও কাঠ পোড়ানোর মহা উৎসব চলছে। অবৈধ ইটভাটা থেকে নির্গত কালো ধোয়ায় হুমকির মুখে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ। এখানের প্রায় প্রতিটি ইট ভাটার মধ্যে রয়েছে গাছ কাটার করাত কল। অন্যদিকে ইট ভাটার মালিকরা চরাঞ্চলের সাধারণ মানুষের ফসলি জমি কেটে নদী বানাচ্ছে। মালিকরা প্রভাবশালী হওয়ায় মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছেনা অনেক জমির মালিক। সরকারি হিজলা কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ খগেনচন্দ্র বিশ্বাস জানান, এসব ইটভাটার কারণে একদিকে পরিবেশ ধ্বংস হচ্ছে অন্যদিকে অক্সিজেন কমে কার্বনডাই অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে।
হিজলা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আহসানুল হাবিব আল আজাদ জনি জানান, নিয়ম বহির্ভূত ইটভাটা গুলো পরিদর্শনে সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে। তিনি আরো বলেন, ইটভাটার মালিকরা ইটভাটা প্রস্তুত শেষে কৃষি অফিসে ছাড়পত্র নেয়ার জন্য আসে।কিন্তু এখানের কেউই আমাদের কাছে ছাড়পত্র নিতে আসেনি।
পরিবেশ অধিদপ্তরের বরিশাল জেলার দায়িত্বশীল কর্মকর্তা আব্দুল মালেক জানালেন, জেলায় তিন শতকের বেশি ইটভাটা রয়েছে। শুধু সদরেই রয়েছে ৩৫টির বেশি। এই মুহূর্তে আমি ইটভাটার অভিযানেই রয়েছি দাবী করলেও তাকে একজন ইটভাটা মালিকের সাথে ভোজনরত দেখা গেছে।
বরিশাল পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা আব্দুল হালিম জানান, তার জানামতে বিভাগে প্রায় আড়াই হাজার ইটভাটা রয়েছে। হিজলা মেহেন্দিগঞ্জে সবমিলিয়ে ১০/১২টি ইটভাটার ছাড়পত্র দেয়া আছে।
শুধুমাত্র হিজলা আর সদর উপজেলা নয় এ চিত্র বরিশালের প্রতিটি উপজেলায়। কর্মকর্তারা সঠিক জানেন না কতটির বৈধ ছাড়পত্র রয়েছে জেলা বা বিভাগে। ফোন করলে বলেন, তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করুন। আর মুখোমুখি হয়ে পরিবেশ, বন ও কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে সংশ্লিষ্ট সবাই এমনকি জেলা প্রশাসকও বলেন, দেখছি। এখনই ব্যবস্থা নিতে বলা হচ্ছে। কার্যত কোনো ব্যবস্থাই আর দেখা যায়নি।

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন    
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী মিরাজ মাহমুদ
 
বার্তা ও বানিজ্যিক কার্যালয়ঃ কুশলা হাউজ, ১৩৮ বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সড়ক,
সদর রোড (শহীদ মিনারের বিপরীতে), বরিশাল-৮২০০।
© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
Developed by NEXTZEN-IT