তেল নিয়ে তেলেসমাতিতে দরিদ্র পরিবারের চোখে অন্ধকার তেল নিয়ে তেলেসমাতিতে দরিদ্র পরিবারের চোখে অন্ধকার - ajkerparibartan.com
তেল নিয়ে তেলেসমাতিতে দরিদ্র পরিবারের চোখে অন্ধকার

1:00 am , March 8, 2022

বিশেষ প্রতিবেদক ॥ ভোজ্যতেল নিয়ে দেশজুড়ে চলছে তেলেসমাতি কারবার। যার প্রভাবে অস্থির বরিশালের তেল বাজার। হতদরিদ্র পরিবারের মানুষদের চোখে মুখে এখন অন্ধকার দেখছেন। একইসাথে বাজারে বেড়েছে গুড়া দুধ ও পোলাও চালের দাম। মাছ-মাংস ও সবজির দরেও অস্থিরতা চারিদিকে। তেলের দর নিয়ন্ত্রণের বাধ্য হয়ে হাইকোর্টে রিট জারী হয়েছে গত ৬ মার্চ। সয়াবিন তেলের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে মনিটরিং সেল গঠন ও নীতিমালা তৈরি করতে গত রোববার সুপ্রিম কোর্টের তিন আইনজীবী মনির হোসেন, সৈয়দ মহিদুল কবীর ও মোহাম্মদ উল্লাহ এ রিট করেন। অপরদিকে খোলা তেল বিক্রি নিয়ে সৃষ্ট জটিলতায় বড় কোম্পানিগুলোর পক্ষে অবস্থান নিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। অনুসন্ধানে দেখা যায়, বরিশালের অন্যতম তেল সাপ্লায়ার প্রতিষ্ঠান সিটি, বসুন্ধরা, তীর ও ফ্রেশ কোম্পানির ডিলারগন তাদের তেল সাপ্লাই বন্ধ রেখেছেন। খোলা বাজারে তাই তেল নেই বলে অভিযোগ বাংলা বাজারের বিক্রেতা ধলুর। আর বরিশালের ডিলারদের সাথে কথা বলে জানা যায়, সারাদেশে কোম্পানির তেল সরবরাহ বন্ধ আছে। সরকারকে ভ্যাট ও ট্যাক্স কমাতে বলেছে । এদিকে বরিশালের বাংলা বাজারের মুদি ব্যবসায়ী ধলু বলেন, কোম্পানি থেকে সরবরাহ করা হচ্ছে না। ওরা বলছে তেল নাই। তেলের প্রতি লিটারে ১২ টাকা করে বাড়বে, কিন্তু নতুন করে তেল দিচ্ছে না। গত ২৮ ফেব্রুয়ারির পর থেকে আর নতুন তেল আনতে পারি নাই। নাম প্রকাশ না করার শর্তে পোর্টরোডের বিক্রেতা বলেছেন, কেউ কেউ বলছে, পাঁচ লিটার বোতল ৭৯০ টাকায় নিতে হবে। কিন্তু ৭৯০ টাকায় আনার পর ৭৯৫ টাকায় বেঁচতে হবে, এত সীমিত লাভে কোন দোকানদার তেল আনতে চায় না আর। এজন্য তেল নাই দোকানে। তিনি বলছিলেন, তার এলাকার কোন দোকানীই এ মাসে নতুন তেল আনতে পারেননি। গত মাসে আনা তেল, বিশেষ করে এক লিটার এবং তিন লিটারের বোতল বেঁচতে হচ্ছে তাদের। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বলছে, সয়াবিন তেলে মিল, আমদানিকারক এবং পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতা মিলে তেল মজুদ করে রাখার কারণেই তেলের কৃত্রিম সংকট দেখা দিয়েছে। অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বেড়েছে, ফলে দেশেও বাড়বে এই আশায় অনেক ব্যবসায়ী তেল বাজারে ছাড়ছেন না। সে কারণেই এই কৃত্রিম সংকট, আর সেটি ঠেকাতে তারা অভিযান শুরু করেছেন। তিনি বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে জানিয়েছি যে, আন্তর্জাতিক বাজারে যে দাম বেড়েছে বা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এসবের জন্য দাম বাড়লে তার প্রভাব দেশের বাজারে আরো দুইমাস পরে পড়বে। কিন্তু এখন তেল নিয়ে বাড়াবাড়ি হচ্ছে। তেল নিয়ে তেলেসমাতি হচ্ছে। এজন্য অভিযান অব্যাহত রাখা হবে। গত কয়েকদিনে সারাদেশে অভিযান চালিয়ে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে সিলগালা এবং জরিমানাও করা হয়েছে। মজুদদারী বন্ধে এখন থেকে এ ধরনের অভিযান চলতে থাকবে বলে জানিয়েছেন সফিকুজ্জামান। তিনি আরো বলেছেন, এখানে পণ্যের কোন ঘাটতি নেই। ভোজ্যতেলের ক্ষেত্রে যেটা হয়েছে এটা ম্যানিপুলেট করা হচ্ছে। অর্থাৎ সাপ্লাই চেইনে তারা কিছুটা কনজারভেটিভ হয়ে গেছে যে তারা সাপ্লাইটা ঠিকভাবে দিচ্ছে না। তাতে বাজারে চাহিদা ও সরবারহের ক্ষেত্রে একটা আর্টিফিশিয়াল ক্রাইসিস তৈরি হচ্ছে এবং যারা এটা করেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বলে তিনি জানিয়েছেন। এছাড়াও ৭ মার্চের মধ্যে ব্যবসায়ীদের কাছে তেলের আমদানি, বিক্রি ও মজুদের তথ্য চেয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এই মূহুর্তে সরকারের নির্ধারিত দাম অনুযায়ী, বোতলজাত সয়াবিন তেল প্রতি লিটারে সর্বোচ্চ মূল্য ১৬৮ টাকা, পাঁচ লিটারের বোতলের দাম ৭৯৫ টাকা। আর খোলা সয়াবিন লিটার প্রতি ১৪৩ টাকা। এই দাম ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতেই সরকারীভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে। এরপরেও তেলের মিলার এবং ডিলাররা সয়াবিনের দাম লিটার প্রতি ১২ টাকা বৃদ্ধির দাবি তুলেছে। কিন্তু রমজান মাসকে সামনে রেখে সরকার সে প্রস্তাবে সায় দিতে রাজী না হওয়ায় তেল সাপ্লাই বন্ধ করে বাজার অস্থির করছে বলে মনে করেন অনেকে। এ অভিযোগের প্রেক্ষাপটে নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করে বাংলাদেশ পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির কেন্দ্রীয় সভাপতি মোহাম্মদ গোলাম মাওলা বলেন, কয়েকটি বড় আমদানিকারকের তেল সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। সে কারণে বাজারে খোলা তেলের কিছুটা সংকট তৈরি হয়েছে। তবে একেবারে পাওয়া যাচ্ছে না, এমন নয়। তেল পাওয়া যাচ্ছে, তবে দাম একটু বেশি। তিনি আরো বলেন, আমদানিকারকরা তেলের মূল্য বাবদ যে স্লিপ দেন, তাতে কখনই লিটারপ্রতি দর লেখা থাকে না। দীর্ঘদিন ধরে এই বিষয়ে বারবার অনুরোধ করলেও মিলাররা তা মানছেন না। বিষয়টি কয়েকবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়েও জানানো হয়েছে। তাতেও কোনো কাজ হয়নি। খোলা তেল বিক্রি বন্ধ বিষয়ে গোলাম মাওলা বলেন, খোলা তেলের ব্যবসা না থাকলে পুরো বাজার চার-পাঁচটি কোম্পানির হাতে চলে যাবে। তারা তখন নিজেদের মতো দাম নির্ধারণ করবে। তিনি বলেন, খোলা তেলের বাজারে এখন যে ওঠানামা, সেটার দায় কোম্পানিগুলোর। কারণ, তারা সরবরাহ ঠিকমতো দিচ্ছে না। ব্যবসায়ীরা বলছেন, স্বাভাবিক সময়ে বাজারে খোলা তেল ও বোতলজাত সয়াবিন তেলের দামে লিটারে ২০ টাকার মতো পার্থক্য থাকে। নি¤œ আয়ের মানুষ খোলা তেলের মূল ক্রেতা। তারা ১০ টাকা, ২০ টাকার তেলও কেনে। পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীদের এই অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে ভোজ্যতেল বিপণনকারী সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, দুষ্ট লোকেরা এমনই বলে থাকে। তা ছাড়া মানুষ বোতলজাত তেল না কিনে খোলা তেল কেন কিনবেন ? তিনি আরও বলেন, তেলের দাম বাড়ানোর জন্য ট্যারিফ কমিশনে চিঠি দেওয়া হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি পেলেই দাম কার্যকর হবে।’ অবশ্য ভোজ্যতেল বিপণনকারী টিকে গ্রুপের পরিচালক (ফাইন্যান্স অ্যান্ড অপারেশনস) মো. শফিউল আতাহার তাসলিম বলেন, তেল বোতলজাত হলে সয়াবিনের সঙ্গে পামের মিশ্রণ দেওয়ার সুযোগ থাকবে না। অন্যদিকে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোর দাবিকে অতিরিক্ত ‘দুষ্টামি’ বলছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এএইচএম শফিকুজ্জামান। এদিকে, খোলা তেল বিক্রির নিষেধাজ্ঞায় হতদরিদ্র পরিবারগুলোর উপর ভয়ানক চাপ পড়েছে বলে দাবী অটোরিক্সা ও ভ্যানচালকদের। ভ্যানচালক বিল্লাল হোসেন বলেন, আমরাতো বাজার থেকে আধা বা একপোয়া কিংবা ১০০ থেকে ৩০০ গ্রাম তেল কিনি। বোতলজাত তেল কেনার সামর্থ্য নেই। বরিশালের বাজারে তেল ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধিতে নিত্য প্রয়োজনীয় চাল, আটা ও সরিষার তেলের দামও বেড়েছে। সরিষার তেল লিটার প্রতি ৩০ টাকা এবং পোলাও চাল ৫ টাকা বেড়েছে।
উল্লেখ্য, বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম কোম্পানি নির্ধারণ করে। আর খোলা তেলের দাম ঢাকার মৌলভীবাজার ও চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের মতো পাইকারি ব্যবসা কেন্দ্রের সরবরাহ আদেশ (এসও) ব্যবসায়ীদের ওপর নির্ভর করে। পরিশোধনকারীদের সরবরাহ করা খোলা তেল পাইকারি বাজারে কেনাবেচা হয়। আর বোতলজাত তেল কোম্পানি সরাসরি পরিবেশকদের মাধ্যমে বিক্রি করা হয় কোম্পানির পক্ষ থেকে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, সয়াবিন তেলের ৬০ শতাংশ ও পাম তেলের ৯৭ শতাংশ খোলা অবস্থায় বিক্রি হয়। এ পরিস্থিতিতে জনস্বাস্থ্য রক্ষা করতে দেশের বাজারে খোলা ভোজ্যতেল বিক্রির ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞার কথা জানিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। আগামী ৩১ মের পর থেকে খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি করা যাবে না। আর খোলা পাম তেল বিক্রির ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হবে আগামী ৩১ ডিসেম্বরের পর। সরকারের এ সিদ্ধান্ত মোটেই জনবান্ধব নয় বলে দাবী খোলা বাজারের বিক্রেতাদের।

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন    
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী মিরাজ মাহমুদ
 
বার্তা ও বানিজ্যিক কার্যালয়ঃ কুশলা হাউজ, ১৩৮ বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সড়ক,
সদর রোড (শহীদ মিনারের বিপরীতে), বরিশাল-৮২০০।
© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
Developed by NEXTZEN-IT