অমর সুরের অবিনাশী গান- একুশের গান অমর সুরের অবিনাশী গান- একুশের গান - ajkerparibartan.com
অমর সুরের অবিনাশী গান- একুশের গান

3:32 pm , February 19, 2022

 

মুকুল দাস ॥ আবার এসেছে একুশ। তবে এখন কার একুশ আগের চেয়ে অন্যমাত্রায় আসে। কারণ একটাই একুশে ফেব্রুয়ারী বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। তাই এখন শুধু বাঙালির একুশ নয়। সে একুশ ছড়িয়ে গেল সবখানে সবার রঙে রঙ মেলাবে বলে। একুশ এলেই আমাদের আলোড়িত করে, উদ্দীপিত করে সেই প্রভাত ফেরীর গান “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো”। আমরা আজো কন্ঠে নিয়ে নেমে পড়ি ভোরের মিছিলে। সালাম বরকতের ভাই বলেই। এই অমর গানের সুরকার শহীদ আলতাফ মাহমুদ আমাদের ঘরের ছেলে। বরিশালের গৌরব। বরিশালের কীর্তিমান আলতাফ মাহমুদ একুশের গানের কিংবদন্তী সুরস্রষ্টা। বরিশালের কীর্তিমান আলতাফ মাহমুদ এই বরিশালে বসেই “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো” অমর গানটিতে সুরারোপ করেছিলেন। সুরের প্রাথমিক খসড়া করেছিলেন শ্রীনাথ চ্যাটার্জী লেনের এক বাড়িতে। পরবর্তীতে আর সি দাশগুপ্তের বিল্ডিং এর তেতলায় শিল্পী সংসদে বলে গানটি নবজন্ম লাভ করে। সুর রচনা করতে গিয়ে শহীদ আলতাফ মাহমুদ তাল লয় নির্ধারণের ব্যাপারে। প্রয়াত সঙ্গীত গুরু নারায়ন সাহা মাস্টার মশাইয়ের সহায়তা পেয়েছিলেন এবং এই গানের সঙ্গে নারায়ন সাহা মাস্টার মশাই তবলায় সঙ্গঁত করেছিলেন। প্রয়াত নারায়ন সাহার কাছ থেকে জানা যায় রবীন্দ্রনাথের “আনন্দ লোকে মঙ্গঁলা লোকে” গানটির সুরের প্রভাত একুশের এই গানে অনেকখানি পড়েছে। সত্তর সালে বংশীবাদক বন্ধু বরুন সেনের সঙ্গে শহীদ আলতাফ মাহমুদের বাসায় যাই। তখন তিনি থাকতেন সিদ্ধেস্বরীতে। প্রাথমিক পরিচয়েই আলাপ জমে উঠেছিল। তার স্বকন্ঠে গাওয়া তানহা ছবির ওরাহী নাদান এবং কখগঘঙ ছবিতে। পাগলা তুই ভরের রীতি গানটির প্রসঙ্গ তুলেছিলাম। সেদিন ফিল্মী গান যতো আলোচনা করেছিলাম একুশের গান নিয়ে ততোটা নয়া কিন্তু আজ ফিল্মী গানের সুর ভুলে গিয়ে বাঙালি আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো কেই আপন করে নিয়েছে। ‘ওরা আমার মুখের কথা কাইড়া নিতে চায়’ ভাষা আন্দোলন ভিত্তিক এই গানটি এখন একুশের সকল সাংস্কৃতিক সংগঠনের শিল্পীরা সমবেত কন্ঠে পরিবেশন করে থাকে। এই গানটি যখন পরিবেশিত হয় তখন একুশের চেতনায় উদ্দীপিত হয় প্রতিটি শ্রোতা-জনতা। এই অভিনাশী গানের গীতিকার ও সুরকার বরিশালের অহংকার আবদুল লতিফ। একুশের গান বললে অনেক গানের মধ্যে বরিশালের আবদুল গাফফার চৌধুরী রচিত ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো।’ গানটি শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত হয় সর্বত্র। এই গানটির প্রথম সুরকার ছিলেন আবদুল লতিফ। এই গান প্রসঙ্গেঁ একটি কথা বলতেই হয়। শহীদ সুরকার আলতাফ মাহমুদ আবদুল লতিফের সুরের কাঠামো অবিকৃত রেখেই চার্চ মিউজিকের আবহে সুরটি কম্পোজ করেন। আবদুল লতিফের কথা ও সুরে আরো একটি একুশের বিখ্যাত গান “ও আমার এই বাংলা ভাষা”। এছাড়া আবদুল লতিফের রফিক শফিক বরকত নাম গানটি এক সময় গাওয়া হত একুশের কথা মনে রেখে। সামসুদ্দীন আহমেদের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করিলিরে বাঙালি। এই গানটির সুরকার হিসেবে আলতাফ মাহমুদের নাম এসেছে সেলিম রেজা সম্পাদিত। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ও গান গ্রন্থে। কিন্তু প্রায় তেরো বছর আগে প্রথম আলো-য় আবদুল লতিফের সাক্ষাৎ করে লতিফ ভাই সুরকার হিসেবে ও সামসুদ্দীন আহমেদের নাম করেছেন। পঞ্চাশের দশকে বরিশালে সে সময়ের বিখ্যাত গনসঙ্গীত শিল্পী মামুনুর রশীদ এই গানটি গেয়ে পরিবেশনা আরো মর্মস্পশী করে তোলেন। বরিশালে ষাটের দশকে মহিলা কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক সানাউল মাহমুদ অনেক দেশের গান লিখেছিলেন। কিন্তু এর মধ্যে একুশের পটভুমিতে রক্তের অক্ষরে স্বাক্ষর দিলাম গানটি বরিশালে খুব গাওয়া হত। এই গানে সুর দিয়েছিলেন অরুন সেন। এবং একটা সময়ে রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী তপন মাহমুদ এই গানটি গেয়ে জনপ্রিয়তা পেয়ে যান। চট্টগ্রামের বিখ্যাত কবিয়ান রমেশ শীল একুশের ওপর দুখানি হৃদয় স্পর্শী গান রচনা করেছিলেন। তার একটি ‘একুশে ফেব্রুয়ারি আবার দেখি ফিরে এল’ এবং অপরটি “ভাষার জন জীবন হারালি”। এই সময়ে বদরুল হাসান লিখলেন ‘ঘুমের দেশে ঘুম ভাঙাতে’ এবং এতে সুরারোপ করলেন আলতাফ মাহমুদ। এই গানটি দারুন জনপ্রিয়তা পায়। একুশের গানের আরেক গীতিকার মোশাররফ উদ্দীন আহমেদকে আমরা পেয়ে যাই। তার ‘মৃত্যুকে যারা তুচ্ছ করিল ভাষা বাঁচাবার তরে’ গানের মাধ্যমে। এই গানটিতেও সুর সংযোজন করেছিলেন আমার মতো আরো অনেকের ঝিলুভাই খ্যাত আলতাফ মাহমুদ। সম্ভবত একুশের গানের প্রথম রচয়িতা ভাষাসৈনিক গাজীউল হক। গাজীউল হকের লেখা এবং নিজাম-উল-হকের সুরে ‘ভুলবনা ভুলবনা ভুলবনা একুশে ফেব্রুয়ারি ভুলবনা’ এই গানটির কথা শিল্পীদের মধ্যে কজনে জানে ? এরকম আরেকটি ভুলে যাওয়া একুশের গান’ একুশ আসে জানাতে বিশ্বে ভাষার কতটা মূল্য? এই গানটির কথা ও সুর লোকমান হোসেন ফকিরের। ষাট দশকের প্রথম দিকে খুলনার সন্দীপন গোষ্ঠীর কাছ থেকে অনেক গনসঙ্গীত পেয়েছি আমরা। এই গনসঙ্গীত রচয়িতাদের মধ্যে প্রথমে নাম আসে নাজিম মাহমুদের। নাজিম মাহমুদ গনসঙ্গীত ছাড়াও একুশের গানের গীতিকার হিসেবে সুপরিচিত। তার রচিত আমাদের চেতনার সৈকতে একুশের ঢেউ মাথা কুটলো। গানটিতে সুর করেছিলেন সাধন সরকার। এই মূহুর্তে খুলনাভিত্তিক একুশের গান ‘একুশের সীমাহীন পিপাসা’ মনে দোলা দেয়। নাজিম সেলিম বুলবুলের কথাও সুরে। লিষ্ফল কভু হয়না ধরায় রক্তের প্রতিদান, দিকে দিকে তাই ফেব্রুয়ারি শোন এই জয়গান। গানটি খুলনায় একুশের অনুষ্ঠানে গাওয়া হত। একুশের গানের অনুষ্ঠানের ‘রক্ত শিমুল তপ্ত পলাশ দিল ডাক’ গানটি এখন অহরহ শোনা যায়। বলতো দ্বিধা নেই বাংলাদেশ যতো একুশের গান রচিত হয়েছে তার সুরকার হিসেবে হয় দেখবো আলতাফ মাহমুদকে নয়তো আবদুল লতিফকে। বলা যায় একুশের গানের সফল ও স্বার্থক সরকার হিসেবে এ দু’জনের কথা বাঙালি কখনো ভুলে যাবেনা। এবং তাদের নাম চিরদিন শ্রদ্ধার সাথে উচ্চারিত হয়ে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। কিন্তু একটা কথা থেকেই যায় স্বাধীনতার আগে একুশের গানেও যে বানী ও সুর প্রানিত করতো শ্রোতা জনতাকে স্বাধীনতার এতো বছর পরেও আর কোন গীতি কারের হাতে তেমন ভাবে একুশের গানতো আমরা পেলামনা। নাকি গীতিকারেরা এখন একুশের চেতনা থেকে দূরে সরে গিয়েছেন। মুখ রেখেছেন বটে একজন। স্বাধীনতার পরপর বরিশালের সে সময়ের তরুন গীতিকার অমিত দাস একুশের চেতনাকে বুকেধরে বেশ কয়েকটি গান লিখেছিলেন। তারমধ্যে একুশে ফেব্রুয়ারি রুদ্ধ প্রানের এবং এ ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো পলাশ দিন”। গান দুটিতে সুর দিয়েছিলেন বশিরুল হক বাদল। এছাড়া অমিত দাসের আরো একটি গান শহীদ দিবসে মৃত্যুঞ্জয়ী শহীদের গান গাই। এই গানটির সুরকার ছিলেন সঙ্গীত শিক্ষক শান্তি রঞ্জন কর্মকার। তবুও বলতে হয় একুশের চেতনাকে ধরে রাখতে আবার একজন আবদুর গাফফার চৌধুরী ও আবদুল লতিফের মতো একুশের গানের কালজয়ী গীতিকার আমরা কবে পাবো।

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন    
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী মিরাজ মাহমুদ
 
বার্তা ও বানিজ্যিক কার্যালয়ঃ কুশলা হাউজ, ১৩৮ বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সড়ক,
সদর রোড (শহীদ মিনারের বিপরীতে), বরিশাল-৮২০০।
© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
Developed by NEXTZEN-IT