মুক্তিযুদ্ধে বরিশালের নাট্য-সংস্কৃতি কর্মীদের ভূমিকা মুক্তিযুদ্ধে বরিশালের নাট্য-সংস্কৃতি কর্মীদের ভূমিকা - ajkerparibartan.com
মুক্তিযুদ্ধে বরিশালের নাট্য-সংস্কৃতি কর্মীদের ভূমিকা

2:19 pm , December 11, 2021

 

সৈয়দ দুলাল ॥ মুক্তি একটা আকাক্সক্ষার নাম, স্বাধীনতা একটা অভিলাষের নাম। এই আকাক্সক্ষা ও অভিলাষ আমরা ত্রিশ লক্ষ শহিদের রক্ত আর দুই লক্ষ নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জন করেছি। এ এক বেদনাতুর, গৌরবময় এবং মহান অর্জন। যাকে এককথায় মহামুক্তির সোপান হিসেবে উল্লেখ করতে পারি। একটা জাতি যখন মুক্তির জন্যে লড়াই করে বিজয় অর্জন করে তখন মুক্তির যুদ্ধটা চিরকালীন হয়ে যায়। যুদ্ধটা চলতে থাকে স্বাধীনতাকে অর্থবহ অবিস্মরণীয় করে তোলার জন্যে। এই যুদ্ধ চলতে থাকে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে, সবসময়। বৃটিশ ও পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনকালে নির্যাতন ও নিপীড়নের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বাঙালি জাতির জাগরণের যে দিন এসেছিল তার মূলে ছিল সাংস্কৃতিক সুচেতনা। বাঙালির রাজনৈতিক পথপরিক্রমা সর্বক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক কর্মকা- জনমানসে গভীর প্রভাব ফেলেছে এবং রাজনৈতিক আন্দোলন সংগ্রামের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে এগিয়ে নিয়ে গেছে বাঙালির সংগ্রাম। সাংস্কৃতিক আন্দোলন রাজনীতির সম্পৃক্ততায় একে অন্যের পরিপূরক হিসেবে কাজ করেছে। যুগিয়েছে প্রেরণা। সংস্কৃতির রয়েছে অবারিত প্রবেশাধিকার। যা সমাজের সবকিছুকেই তুলে ধরতে পারে মানসলোকে। সমাজ-শিল্প- অর্থনীতি-রাজনীতি-নীতি ও আদর্শ সবকিছুকেই সংস্কৃতি ধারণ করতে পারে অনায়াসে। এই সংস্কৃতিই বাঙালি সংস্কৃতি, যা প্রতিনিয়ত উঠে এসেছে স্বাধীনতাকে অর্থবহ করার প্রত্যয়ে।
বাঙালির হাজার বছরের শ্রেণি সংগ্রাম, ভাষার অধিকার, প্রতিরোধে সংগ্রাম এমনকি নারীর সংগ্রামী আত্মত্যাগÑ সবকিছুই যুগে যুগে এ দেশের কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীর অগ্রণী ভুমিকায় সংগঠিত হয়েছে। এ ঐতিহ্য থেকে বিচ্যুত থাকেনি বরিশালের সাংস্কৃতিক অঙ্গন। বাঙালি জাতীয়তাবাদের সূচনা ভাষা আন্দোলন। দেশ বিভাগের পরপরই সংঘটিত হয়েছিল বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন। যে আন্দোলনের শুরু থেকে চুড়ান্ত রূপ পর্যন্ত বরিশালের আছে গৌরবময় ইতিহাস। প্রথম ভাষাসংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন বরিশালের কাজী গোলাম মাহাবুব। বাহান্নর একুশে ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে অমর কবিতা লিখেছেন আবদুল গফফার চৌধুরী। ওই কবিতায় প্রথম সুর দিয়েছিলেন শিল্পী আবদুল লতিফ, চূড়ান্ত সুর¯্রষ্টা শহীদ আলতাফ মাহামুদÑ সবাই বরিশালের কৃতিসন্তান। কথিত আছে আলতাফ মাহামুদ সদররোড অবস্থিত আর,সি. দাস ভবনের তিন তলায় শিল্পীসংঘে বসে সুরারোপ করেছিলেনÑ ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী, আমিকি ভুলিতে পারি…’ অমর গীতিকার। একই সাথে অধ্যাপক হোসেন আলী, মোশাররফ হোসেন নান্নু, রাণী ভট্টাচার্য্য, ইউসুফ হোসেন কালু সহ বরিশালের বেশ কয়েকজন সংস্কৃতিকর্মী স্থানীয় পর্যায়ে ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন।
৫৪’র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬২’র ছাত্র আন্দেলন , ৬৬’র ৬দফা ভিত্তিক গণজাগরণ, ৬৭ সালের জুন মাসে পাকিস্তান সরকার রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্র সঙ্গীত নিষিদ্ধ করার ষড়যন্ত্র বরিশালের শিল্পী ও বুদ্ধিজীবী সমাজকে একত্রিত করে। বরিশালের শিল্পী ও বুদ্ধিজীবী সমাজ একত্রিত হয়ে ওই উত্তাল সময়েই গড়ে তোলে প্রান্তিক। শুরু হয় রবীন্দ্র চর্চা। বর্তমান সরকারি বরিশাল কলেজস্থ তমাল তলায় প্রান্তিকের আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয় রবীন্দ্রনাথের জন্ম ও প্রয়াণ দিবসের অনুষ্ঠান। বরিশালে রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রসংগীত চর্চায় এই সংগঠনের ভূমিকা অগ্রগণ্য। প্রান্তিক গঠনে অগ্রণী ছিল সেলিম আহাম্মেদ, শহীদ সেরনিয়াবাত, বদিউর রহমান, মীর মুজতবা আলী, আবু আল সাঈদ নান্টু প্রমুখ। প্রান্তিকের ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত চর্চা আন্দোলন’ পাকিস্তান বিরোধী মনোভাব সৃষ্টিতে সচেতন বরিশালবাসীকে উদ্বুদ্ধ করেছিল ব্যাপকভাবে। ১৯৬৮ সালের জানুয়ারি মাসে পাকিস্তান সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে। শেখ মুজিবুর রহমানকে ১ নম্বর আসামি করে ৩৫জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে আসামি করা হয়। ওই মামলার সাত জন আসামী ছিলেন বৃহত্তর বরিশালের। মামলায় শেখ মুজিবুর রহমানকে আটক করার পর থেকেই বরিশালের সাংস্কৃতিক কর্মীরা গান-কবিতা-নাটক দিয়ে যোগ দেয় আন্দোলনে। সৃষ্টি করতে থাকে স্বাধীকারভিত্তিক জনমত। মামলা পরিচালনার ব্যয়ভার বহন করার জন্য রাস্তায় রাস্তায় লালসালু পেতে অর্থ সংগ্রহ করে কেন্দ্রীয় ফান্ডে জমা দিয়েছেন বরিশালের শিল্পি সমাজ। একদিনের ঘটনা আমার স্মৃতিপটে এখনো স্পষ্ট হয়ে আছেÑ শহরের চকেরপুল তিন রাস্তার মোড়ে একটা বড় লাইটপোস্ট ছিলো। দিনটি ছিল হাটবার। তখন শনি-মঙ্গল বার হাট বসতো। হাটবার দিন লোক সমাগম হোত। ওই লাইটপোস্টের সামনে লালসালু বিছিয়ে গলায় হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে আক্কাস হোসেন নিজের লেখা ও সুর করা গানÑ‘ভিক্ষা দেও গো নগরবাসী, ভিক্ষা আমায় দে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা রুজু হইয়াছে…’। আমিও তাদের সাথে দাঁড়িয়ে গেলাম। লালসালুর উপর মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে টাকা-পয়সা দিয়ে যাচ্ছেন। ঘণ্টা খানেক পরে ওই কাপড় নিয়ে, বাজার রোড, কাপুড়িয়াপট্টি, হাটখোলার ভেতরে গান ও অর্থ সংগ্রহ চলছে রাত অবধি।
৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে যত রাজনৈতিক সভা হতো তার আগে বরিশালের শিল্পিরা গান গেয়ে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতেন। এমন অগ্নিস্ফূলিঙ্গের মধ্যে ৬৯ সালের জানুয়ারি মাসে গণঅভ্যুত্থানের সূচনা হয়। ২৪ জানুয়ারি ঢাকায় পুলিশের গুলিতে আসাদ নিহত হয়। বর্তমানে আসাদ গেট শহিদ আসাদের নামে স্থাপিত হয়। গণঅভ্যুত্থানের আগুন সারাদেশের মতো বরিশালেও ছড়িয়ে পরে। ২৮ জানুয়ারি ছাত্র-জনতার মিছিলে পুলিশ ও ইপিআর গুলি চালায়। সদর রোডস্থ কাটপট্টির মুখে আছমত আলী খান ইনস্টিস্টিউটের (এ.কে. স্কুল) নবম শ্রেণির ছাত্র আলউদ্দিন শহিদ হয়। ওই সময় বরিশালে আবু আল সাইদ নান্টু-এর নেতৃত্বে একদল শিল্পি সমাজ প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। পাড়ায় পাড়ায়, প্রতিবাদ সমাবেশে চলে গণসঙ্গীত। গড়ে ওঠে আয়ুব শাহীর বিরুদ্ধে গণজাগরণ। পতন হয় আয়ুব খানের। উনসত্তরের উত্তাল-রক্তাক্ত রাজপথের ধূলায় আকবর হোসেন-এর নেতৃত্বে জন্ম নেয় নাট্য সংগঠন খেয়ালী (বর্তমান খেয়ালী গ্রুপ থিয়েটার)।

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন    
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী মিরাজ মাহমুদ
 
বার্তা ও বানিজ্যিক কার্যালয়ঃ কুশলা হাউজ, ১৩৮ বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সড়ক,
সদর রোড (শহীদ মিনারের বিপরীতে), বরিশাল-৮২০০।
© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
Developed by NEXTZEN-IT