সাগর উত্তাল থাকায় শিকারে যেতে পারেনি জেলেরা সাগর উত্তাল থাকায় শিকারে যেতে পারেনি জেলেরা - ajkerparibartan.com
সাগর উত্তাল থাকায় শিকারে যেতে পারেনি জেলেরা

3:34 pm , July 24, 2021

৬৫ দিন মৎস্য আহরন নিষেধাজ্ঞা শেষ

বিশেষ প্রতিবেদক ॥ দেশের সমুদ্র সীমায় মৎস্য আহরনে ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা উঠে গেছে গত রাতের প্রথম প্রহরে। তবে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হলেও লঘু চাপের প্রভাবে সাগর উত্তাল থাকায় শনিবার বিকেল পর্যন্ত প্রায় কোন জেলে নৌকা ও ট্রলার সাগরে যেতে পারেনি। যদিও গত সপ্তাহ খানেক ধরে সাগরে জাল ফেলার লক্ষ্যে সব ধরনের প্রস্ততি চলছিল জেল পল্লীগুলোতে। আবহাওয়া বিভাগ থেকেও উত্তাল সাগরে মাছধরা ট্রলার ও নৌকাগুলোকে যেতে মানা করা হয়েছে। মূলত ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্তএ নিষেধাজ্ঞাকালীন সময়ের বেশীরভাগই সাগর অনেকটাই বিক্ষুব্ধ থাকে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই নিষেধাজ্ঞার এ সময়ে সাগরে মাছ ধরা প্রায়ই বন্ধ থাকে। এমনকি এবারো এ নিষেধাজ্ঞার মধ্যে গত ২৬ মে ঘূর্ণিঝড় ইয়াশ দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম উপকুলে আঘাত হানে।
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের সাতক্ষীরা থেকে পূর্ব-দক্ষিণের টেকনাফ পর্যন্ত ৭১০ কিলোমিটার উপকুলীয় তটরেখা এবং সমুদ্রের ২শ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত ‘একান্ত অর্থনৈতিক এলাকা’র ১ লাখ ৪০ হজার ৮৬০ বর্গ কিলোমিটারে ছোট-বড় নানা প্রকারের ৪৭৫ প্রজাতির মৎস্য সম্পদ অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখছে। এ ছাড়াও সমুদ্র এলাকায় ৩৬ প্রজাতির চিংড়ি, ৫ প্রজাতির লবস্টার, ১৫ প্রজাতির কাঁকড়া, ৫ প্রজাতির কচ্ছপ ও ১৩ প্রজাতির প্রবাল সহ বিভিন্ন জলজ সমুদ্র সম্পদকে সমৃদ্ধ করেছে।
দেশের মৎস্য সম্পদে সামুদ্রিক মাছের অবদান এখন প্রায় ৮Ñ১০%। সমুদ্র এলাকায় প্রায় ৫.১৬ লাখ জেলে ২৫৫টি বানিজ্যিক ট্রলার, ছাড়াও প্রায় ৭০ হাজার ইঞ্জিন চালিত ও ইঞ্জিন বিহীন নৌকায় ১ লাখ ৮৯ হাজার জাল সহ মাছধরার নানা সরঞ্জামের মাধ্যমে মৎস্য আহরন করে থাকেন। সরকার চিংড়ির প্রজনন প্রক্রিয়া নিরাপদ ও নিশ্চিত করা সহ অন্যান্য মাছের বিচরন, প্রজনন ও উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি আহরন প্রবৃদ্ধি টেকসই করতে, বঙ্গোপসাগরে নিজস্ব অর্থনৈতিক অঞ্চলে ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই মৎস্য আহরন নিষিদ্ধ করে। সামুদ্রিক জলাশয়ে ৬৫ দিনের এ আহরন নিষেধাজ্ঞার কারণে গত কয়েক বছরে মৎস্য সম্পদে লক্ষাধিক টন মাছ যোগ হয়েছে বলে মৎস্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে।
মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, ৬৫ দিনের বন্ধ মৌসুম কার্যকরের আগে অর্থাৎ ২০১২-১৩ থেকে ’১৪-১৫ সময়ের তুলনায় ২০১৫-১৬ থেকে ’১৭-১৮ পর্যন্ত বানিজ্যিক ট্রলার থেকে আহরিত মাছের ক্যাচলগ পর্যালোচনায় মৎস্য আহরনের পরিমান বৃদ্ধির সুস্পষ্ট প্রবনতা পরিলক্ষিত হয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে দেশে উৎপাদিত ৪৩ লাখ ৮৪ হাজার টন মাছের মধ্যে সামুদ্রিক জলাশয়ে উৎপাদন ছিল প্রায় ৬ লাখ ৬০ হাজার টন। যা পরবর্তি বছরগুলোতে ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে বলেও জানিয়েছে অধিদপ্তর।
উপকুলের জেলে ও মৎস্যজীবীরা ৬৫ দিনের এ আহরন নিষিদ্ধের বিষয়টিকে ভালভাবে না নিলেও মৎস্য সম্পদের টেকসই উন্নয়নের স্বার্থেই তা করা হচ্ছে বলে মৎস্য অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে। এমনকি আহরন নিষিদ্ধকালীন এ সময়ে উপকুলের প্রায় ৩ লাখ জেলে পরিবারকে দু দফায় মাথাপিছু ৮৬ কেজি করে চাল বিতরন করা হয়েছে। যারমধ্যে বরিশাল বিভাগের ১ লাখ ৪৭ হাজার ৮৩টি জেলে পরিবার ১২ হাজার ৬১৮ টন খাদ্য সহায়তা পেয়েছেন।
পাশাপাশি নিষিদ্ধকালীন এ সময়ে ৪৯টি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা ছাড়াও মৎস্য অধিদপ্তর নিজস্ব ব্যবস্থায় আরো বিপুল সংখ্যক অভিযান পরিচালনা করে ৬০টি বিভিন্ন ধরনের মাছধরা ট্রলার এবং ২০ লাখ মিটার জাল আটক করেছে। যার বাজারমূল্য প্রায় ৫ কোটি টাকা। এছাড়াও ৩.৩২ টন মাছ আটক করে নিলামে বিক্রি করা হয়েছ। এ সময়ে প্রায় ৪৫টি মামলা দয়ের ছাড়াও ১৫ লাখ টাকার মত জরিমানা আদায় করেছে ভ্রাম্যমান আদালত। ১৮ জন জেলে ও মৎসজীবীকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ডও দেয়া হয়েছে। এ সময় বাজেয়াপ্তকৃত জাল, ট্রলার ও মাছের নিলাম থেকে সরকারী কোষাগারে জমা হয়েছে প্রায় সাড়ে সাড়ে ৪ কোটি টাকা।
মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য ও বৈচিত্র্যপূর্ণ মৎস্য সম্পদে সমৃদ্ধ বঙ্গোপসাগর বিশে^র একমাত্র উপ-সাগর যেখানে সবচেয়ে বেশী নদী বিধৌত পানি প্রবেশ করে। কিন্তু সম্প্রতিককালে বিশ^ব্যাপী ‘সামুদ্রিক ও উপকুলীয় মৎস্য সম্পদ অতি আহরন, ভুমি ও সমুদ্র হতে সৃষ্ট দুষণ এবং জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তন সহ নানামুখী সংকট-এর সম্মুখীন’। ফলে বাংলাদেশ সহ বিশে^র মৎস্যকুলের প্রাচুর্য, বিস্তৃতি ও প্রজাতির উপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে।
বিশে^র সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ অসীম হলেও অফুরন্ত নয়। তাই সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ ব্যবস্থাপনায় সম্ভাব্য সকল ঝুকি ও অনিশ্চয়তাকে বিবেচনায় রেখে বিগত বছরগুলোতে আহরন বৃদ্ধি পেলেও প্রজাতির গুনগতমান অবনমন লক্ষ্য করেছেন বিজ্ঞানীগন। এরফলে মৎস্য সেক্টরের ওপর নির্ভরশীল বিভিন্ন স্তরের অংশীজনের মাছের সীমিত সম্পদ নিয়ে অসম প্রতিযোগীতা এবং আয় বৈষম্যও বাড়ছে।
মৎস্য বিজ্ঞানীগন ‘বিশাল এলাকার জলরাশির মৎস্য সম্পদ সংরক্ষন, ব্যবস্থাপনা এবং সুষ্ঠু ও বিজ্ঞানসম্মত সহনশীল আহরন নিশ্চিত করে বছরের পর বছর সামুদ্রিক মৎস্য উৎপাদন অব্যাহত এবং বংশ বৃদ্ধি সহ মজুদ অক্ষুন্ন রাখার ওপর গুরুত্ব’ দিয়েছেন। তবে এক্ষেত্রেও বিজ্ঞানীগন ‘আমাদের একান্ত বাস্তবতা ও পরিবেশকে বিবেচনায় নিয়ে সামুদ্রিক মৎস্য ব্যবস্থাপনা নীতি ও কৌশল প্রণয়ন অত্যাবশ্যক’ বলেও মনে করছেন।
২০১৫ থেকে ’১৮ সাল পর্যন্ত ৬৫ দিনের মাছ ধরা নিষিদ্ধ কার্যক্রমটি শুধুমাত্র বাণিজ্যিক ট্রলারের ক্ষেত্রে কার্যকর হলেও ২০১৯ থেকে তা সব মৎস্য নৌযানের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হয়েছে। এছাড়াও প্রতিবছর আশি^নের বড় পূর্ণিমার আগে-পরের ২২ দিন উপকুলের ৭ হাজার বর্গ কিলোমিটারের মূল প্রজনন ক্ষেত্রে সব ধরনের মৎস্য আহরন সহ দেশের সব নদ-নদীতে ইলিশ আহরন নিষিদ্ধের ফলে গত দুই দশকে এ মাছের উৎপাদন প্রায় তিনগুন বেড়েছে।
কিন্তু সাগর ও উপকুলে ঝড়Ñঝঞ্ঝার মৌসুমে ৬৫ দিন মাছধরা নিষিদ্ধ ঘোষনার বিষয়টি নিয়ে উপকুলের বিশাল জেলে ও মৎস্যজীবীদের অভিযোগ, ‘বাংলদেশের সমুদ্র এলাকায় মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকলেও এ সময়ে ভারতে নিষিদ্ধ না থাকায় সে দেশের জেলেরা অবাধে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় প্রবেশ করে মাছ লুটে নিচ্ছে’। তবে মৎস্য বিজ্ঞানীগন এক্ষেত্রে ‘প্রতিবেশী দেশের সাথে সমতা রেখে সাগরে মৎস্য আহরন নিষিদ্ধ ঘোষনার সময় পুণঃ বিবেচনার’ কথা বলেছেন। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরের জলসীমায় ১৫ এপ্রিল থেকে ৩১ মে পর্যন্ত মৎস্য আাহরনে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। মিয়ানমারেও জুন থেকে আগষ্ট পর্যন্ত সাগরে মাছ ধরা নিষিদ্ধ।
এসব ব্যাপারে দেশের বিশিষ্ট মৎস্য বিজ্ঞানী ও মৎস্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (সামুদ্রিক) ড. মোঃ আবুল হাসনাত বলেন, নির্দিষ্ট সময়ে মাছধরা বন্ধ রাখা সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদের কার্যকরি ব্যবস্থাপনার একটি সহজ ও অত্যন্ত ফলদায়ক পদ্ধতি। যা বিশে^র বিভিন্ন দেশে বাস্তবায়ন হচ্ছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা-ফাও’এ বর্তমানে কর্মরত ড. হাসনাত সমুদ্রে আহরন নিষেধাজ্ঞার সময়কাল প্রতিবেশী দেশের সাথে সমন্বয় করে নির্ধারনের কথাও বলেছেন।
এদিকে দূর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারনে মাছ শিকারে যেতে পারেনি কলাপাড়ার মৎস্য বন্দর আলীপুর, মহিপুর ও কুয়াকাটার সহা¯্রাধিক জেলে। শুক্রবার রাত ১২টার পর থেকে জেলেদের মৎস্য শিকারে যাওয়ার সকল প্রস্তুতি ভেস্তে গেছে উত্তর পশ্চিম বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট সু স্পষ্ট লঘুচাপের কারনে। লঘু চাপের কারনে পায়রা বন্দরসহ তিনটি সামুদ্রিক বন্দরকে তিন নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখে যেতে বলেছেন। উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলার সমূহকে পরবর্তি নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত উপকূলের কাছাকাছি এসে সাবধানে চলাচলের নির্দেশনা দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। সাগর উত্তাল হয়ে ওঠায় জেলেদের রূপালী ইলিশ শিকারের মাধ্যমে সোনালী স্বপ্ন ভেঙ্গে তছনছ হয়ে গেছে বলে মহিপুর ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি মো. ফজলুল হক গাজী দাবি করেছেন।
সরেজমিন দেখাগেছে, শত শত ট্রলার মৎস্য বন্দর আলীপুর ও মহিপুরের সকল আড়ত দারদের ঘাটে নোঙর করা রয়েছে। সকল ট্রলারের মাঝি মাল্লারা অলস সময় পার করছেন আর আকাশের দিকে তাকিয়ে মাছ শিকারে যাওয়ার মাহেন্দ্র ক্ষনের অপেক্ষা করছে। এসময় জেলে ইউসুফ বলেন, আমাদের বুক ফেঁটে যাচ্ছে। খুব আশা নিয়ে মাছ শিকারের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে ট্রলারে এসেছি। ১০ জনের সংসারের ঘানি টানতে গিয়ে দুই মাসে এক লাখ টাকার ঋণ গ্রস্থ হয়ে পড়েছি। এখন ইলিশের মৌসুম, মাছ শিকার করে আয় করা টাকা দিয়ে ঋণ পরিশোধ করবো। আমার মতো এমন অবস্থা উপকূলের হাজারো জেলেদের।
মহিপুর ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি মো. দেলোয়ার গাজী বলেন, আড়াই লাখ টাকা খরচ করে ট্রলার প্রস্তুত করেছি মাছ শিকারের জন্য। কিন্তু দূর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া ভাত বোঝাই প্লেটে ছাই মেরে দিয়েছে ! আমাদের প্রতি ঘন্টা এখন অতি গুরুত্বপূর্ণ এবং মূল্যবান। জেলেরা ট্রলার নিয়ে সাগরে মাছ শিকার করারত অবস্থায় থাকলে তীরে বসে আমরা নগদ অর্থের স্বপ্ন দেখি। আর ঘাটে বসে বসে জেলেরা বাজার সদায় খেলে আমাদের ঋণের বোঝা আরো বাড়তে থাকে। এখন অপেক্ষায় আছি কখন সাগর শান্ত হয় আর আমরা ট্রলার সাগরে পাঠিয়ে রূপালী ইলিশ শিকারের মাধ্যমে বিগত দিনের আর্থিক লোকসান কাটিয়ে উঠতে পারবো।

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন    
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী মিরাজ মাহমুদ
 
বার্তা ও বানিজ্যিক কার্যালয়ঃ কুশলা হাউজ, ১৩৮ বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সড়ক,
সদর রোড (শহীদ মিনারের বিপরীতে), বরিশাল-৮২০০।
© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
Developed by NEXTZEN-IT