জীবন যুদ্ধে জয়ী গৌরনদীর শ্রেষ্ঠ পাঁচ নারীর সাফল্য সংগ্রামী জীবনের দৃষ্টান্ত জীবন যুদ্ধে জয়ী গৌরনদীর শ্রেষ্ঠ পাঁচ নারীর সাফল্য সংগ্রামী জীবনের দৃষ্টান্ত - ajkerparibartan.com
জীবন যুদ্ধে জয়ী গৌরনদীর শ্রেষ্ঠ পাঁচ নারীর সাফল্য সংগ্রামী জীবনের দৃষ্টান্ত

1:00 am , June 19, 2021

 

গৌরনদী প্রতিবেদক ॥ গৌরনদী উপজেলার অসহায় হতদরিদ্র পাঁচ নারী জীবন সংগ্রামে জয়ী হয়েছেন। কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন, কঠোর পরিশ্রম ও দারিদ্ররতার সঙ্গে যুদ্ধে করে সমাজে আজ তারা নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন। অর্থনৈতিক সাফল্য, শিক্ষা ও চাকুরী সাফল্য, সফল জননী, নির্যাতন ও বিভীষিকা মুছে এগিয়ে যাওয়ার সাফল্য ও সমাজ উন্নয়নে অসামন্য অবদান রাখায় সমাজের দৃষ্ঠান্ত সৃষ্টিকারী ওই পাঁচ নারীরা হলেন বরিশালের গৌরনদী উপজেলার বার্থী ইউনিয়নের ধুরিয়াইল গ্রামের শাহ আলম সরদারের স্ত্রী শাহিনুর বেগম (অর্থনৈতিক সফল), চাঁদশী ইউনিয়নের চাঁদশী গ্রামের বিমল চন্দ্র গাইনের স্ত্রী অঞ্জনা রানী মন্ডল (শিক্ষা ও চাকুরী), পৌর এলাকার আশোকাঠি গ্রামের সৈয়দ শাহ আলমের স্ত্রী খাদিজা ইয়াসমিন (সফল জননী), বানীয়াশুরী গ্রামের জাকির রুজবাইনের স্ত্রী ইসরাত জাহান মনি (নির্যাতন ও বিভীষিকা মুছে ফেলে স্বপ্ন পুরন) ও বার্থী ইউনিয়নের বার্থী গ্রামের আল মামুন সরদারের স্ত্রী জেসমিন বেগম (সমাজ উন্নয়ন)। উপজেলা প্রশাসন ও মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের যৌথ উদ্যোগে রোকেয়া দিবস ২০২০ উপলক্ষে ৫ জয়িতা নারীকে সংবর্ধনা প্রদান অনুষ্ঠানে সম্মননা ক্রেষ্ট, সনদ প্রদান করা হয়। স্থানীয় লোকজন, গৌরনদী উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা জাহানারা পারভীনসহ বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে জীবন সংগ্রামে জয়ী পাঁচ নারীর জীবন সংগ্রামের চিত্র।
শাহিনুর বেগম ঃ ৪ ভাই ৩ বোনসহ পরিবারের ৪র্থ সন্তান শাহিনুর বেগম। বাবা ছিল দরিদ্র কৃষক অভাবের কারনে তেমন কোন লেখাপড়া করতে পারেন নাই। ৮ম শ্রেনীতে পড়াশোনাকালীন বাবা তাকে বিয়ে দেন। স্বামী ছিল ভূমিহীন। সে ৫০ টাকা মুজুরীতে দিন মজুরের কাজ করে সংসার চালাত। দারিদ্রতার কষাঘাতে জর্জরিত ছিল সংসার ও দাম্পত্য জীবন। বাধ্য হয়েই শাহিনুর সংসারের হাল ধরেন। সংসার জীবনে শাহিনুরের তিন পুত্র সন্তান ও ১ কন্যা সন্তান জন্ম গ্রহন করে। সংসার খরচ বেড়ে যাওয়ায় হতাশায় নিমজ্জিত হন শাহিনুর। সন্তানদের মানুষ করা নিয়ে শাহিনুরের চোখে স্বপ্ন থাকলেও তা যেন নিমিষেই অন্ধকারে নিমজ্জিত। তাই পথ খুজতে থাকলেন কি করে সংসারে আয় বাড়ানো যায়। অবশেষে ২০১৩ সালে গৌরনদী কৃষি অফিসের মাধ্যমে ইষ্টিগেটেড এ্যাগ্র্রিকালচারাল প্রোজেক্টিভিটি প্রজেক্ট এর আওতায় ১০ সেশনের কৃষি প্রশিক্ষন গ্রহন করেন। ভার্মি কম্পোষ্ট সার (কেঁচো সার) তৈরী করতে থাকেন। নিজের উৎপাদিত সার নিজের সামান্য জমিতে ব্যবহার করে জমি চাষ করে অধিক ফসল ফলিয়ে লাভবান হন তিনি। পাশাপাশি কঠোর পরিশ্রম করে বেশী বেশী কেঁচো সার উৎপাদন করে নিজের প্রয়োজন মিটিয়ে বিক্রি শুরু করেন। এভাবে নিজের চেষ্টায় দারিদ্রকে জয় করে স্বাবলম্ভি হয়েছেন শাহিনুর বেগম।
অঞ্জনা রানী মন্ডল ঃ অঞ্জনা রানী মন্ডল ২ভাই ও ১ বোন। তার জন্ম ১৯৬৪ সালের ২২জুন। তার বাবা ছিলেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকুরীজীবি ও মা ছিলেন গৃহীনি। বাবার স্বল্প আয়ে তাদের সংসার চলত। মা তাদের ভাই বোনদের নিয়ে গ্রামের বাড়িতে থাকতেন। ১৯৭১ সালের পাক হানাদার বাহিনীর বিভিষিকাময় তান্ডব ও রাজাকারদের লুটপাটের ফলে যথা সর্বস্ব হারিয়ে বাবা-মা নিঃশ্ব হয়ে যান। স্বাধীনতার পরে শুন্য হাতে বাবা তার হারানো চাকুরীতে যোগদান করেন। শুরু হল আর্থিক দৈন্যতার জীবন সংগ্রাম ও জীবনযুদ্ধ। ১৯৮১ সালে চাঁদশী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে প্রথম বিভাগে এসএসসি পাশ করেন। এ সময় তার মা মারা যান। বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। তার ভাই বোনদের মানুষ করার জন্য মাসী তাকে বরিশাল নিয়ে যান এবং বরিশাল মহিলা কলেজে ভর্তি করে দেন। দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যায়নরত অবস্থায় আগৈলঝাড়ার বাহাদুরপুর গ্রামের বিমল গাইনের সঙ্গে বিয়ে হয়। ১৯৮৪ সালে এইচএসসির দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করেন। ১৯৮৬ সালে দ্বিতীয় বিভাগে বিএসসি পাশ করেন। ১৯৮৭ সালে বাহাদুরপুর নিশিকান্ত গাইন বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। সেখানে তিন বছর শিক্ষকতা করার পরে ১৯৯০ সালে বাহাদুরপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে যোগদান করে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সেখানে শিক্ষকতা করেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি লেখাপড়া অব্যহত রাখেন। ২০০৭ সালে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় এম,এ ডিগ্রিী ও বরিশাল টিসার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে প্রথম শ্রেনিতে মাষ্টার্স অব এডুকেশন (এমএড) ডিগ্রী লাভ করেন। ২০০৫ সালে শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের অধীনে ন্যাশনাল একাডেমী ফর কম্পিউটর ট্রের্নিং এন্ড রিসার্স থেকে কম্পিউটর প্রশিক্ষন শেষ করেন। ২০১৪ সালের ১৩ নভেম্বর চাঁদশী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। তিনি কর্ম জীবনের পাশাপাশি সংসার জীবনেও একজন সফল নারী। মেয়েকে গনিত বিষয়ে এমএসসি পাশ করে মায়ের পথ ধরেই শিক্ষকতায় যোগদান করেছেন এবং ছেলেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার পাশ করিয়ে মেট্রারেলে কর্মরত রয়েছে।
খাদিজা ইয়াসমিন ঃ বরিশাল জেলার গৌরনদী উপজেলার আশোকাঠি গ্রামের আজিজুর রহমানের কন্যা খাদিজা ইয়াসমিন। বাবার তিন কন্যা সন্তানের মধ্যে সে বড়। কোন ভাই না থাকায় বাবার বড় সন্তান হিসেবে সংসারের সকল ঝৈ ঝামেলা তাকে সহ্য করতে হয়। ১৯৮৪ সালে ৭ম শ্রেনীতে পড়াশোনা অবস্থায় কৃষক পরিবারের ৬ ছেলে মধ্যে ছোট ছেলে দশম শ্রেনীতে পড়–য়া ছাত্র সৈয়দ মোঃ শাহ আলমের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। ১৯৮৮ সালে প্রথম কন্যা সন্তানের মা হন। ওই বছর এসএসসি পরীক্ষায় দিয়ে প্রথম বিভাগে পাশ করেন। বিয়ের পরে পড়াশোনা চালিয়ে গিয়ে একে একে এইচএসসি, বিএ ও এমএ দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করেন। তার স্বামীও এমএ পাশ করেন। বিয়ের পরে স্বামী স্ত্রী দুজনেই ইচ্ছাশক্তিকে কাজে লাগিয়ে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষত হন। স্বামী স্ত্রীর আয় রোজগার শুরু করার আগেই শুরু হয় সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ। খাদিজা ইয়াসমিন প্রথম কন্যা সন্তান ও ছোট ছেলেকে এমবিবিএস পাশ করিয়ে চিকিৎসক বানিয়েছেন। কন্যা বর্তমানে একটি সরকারি হাসপাতালে কর্মরত। তাদের জীবন বাল্য বিয়ে ও আর্থিক অস্বচ্ছলতার অভিশাভে অভিশপ্ত ছিল । শত প্রতিকূলতার মধ্যে সংসার জীবনে সংসার করে সর্বোচ্চ শিক্ষ গ্রহন করে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। সকল বাধা বিপত্তি ও সমস্যাকে মোকাবেলাকরে আজ খাদিজা ইয়াসমিন সমাজে প্রতিষ্ঠিত একটি মানুষ একটি পরিবার।
ইসরাত জাহান মনি ঃ গৌরনদী উপজেলার বানিয়াশুরী গ্রামের ফারুক শরীফের কন্যা ইসরাত জাহান মনি। ২ ভাই ও ১ বোনের মধ্যে সে ছোট সন্তান। বাবার অভাবের সংসার ছিল। কৃষক পরিবারের সন্তান হিসেবে অভাব অনাটনের মধ্যে দিয়ে লেখাপড়া করেন। একাদশ শ্রেনীতে পড়াশোনার সময়ে তার বান্ধবীর ভাইয়ের প্রেমে জড়িয়ে পড়েন। ২০১৫ সালে এইচএসসি পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে দুই পরিবারের অমতে নিজেরাই বিয়ে করেন। ওই বছর তার বাবা মারা যান। এত প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে এইচএসসি পরীক্ষায় ভাল ফলাফল করেন। ২০১৬ সালে স্বামীর হাত ধরে চট্রগ্রামে চলে যান। শ্বাশুড়ি তাকে মেনে না নেওয়ায় শ্বাশুড়ি বিভিন্ন সময় অমানবিক অত্যাচার করে এবং এক পর্যায়ে ঘর থেকে বের করে দেন। তখন তারা স্বামী স্ত্রী দুজনে টিউশনি করে জীবন যাপন করে পুনরায় লেখাপড়া শুরু করেন। তিন বছর পর একটি সন্তান জন্ম গ্রেহনের ৫দিন পর স্বামী গাজীপুর চলে যান। তারপর থেকে আর খোজ খবর নেননি স্বামী ফারুক শরীফ। সেই থেকে বাবার বাড়ি থাকেন ইসরাত জাহান মনি। শত কষ্টের পরেও জীবন যুদ্ধে থেমে থাকেনি ইসরাত জাহান মনি। বিভিন্ন প্রশিক্ষনের মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহন করে ভার্মি কম্পোষ্ট সার তৈরী ও টেইলারিং কাজ করে স্ববলম্বী হয়েছেন।
জেসমিন বেগম ঃ গৌরনদী উপজেলার দক্ষিন ধানডোবা গ্রামের মৃত ফেলান সরদারের কন্যা জেসমিন বেগম। তারা ৬ বোন ৪ ভাই। বাবা মায়ের ১০ সন্তানের মধ্যে সে অষ্টম সন্তান ছিলেন। বাবা ছিলেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এবং পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। বড় সংসারে সব সময় আর্থিক দৈন্যতা লেগেই থাকত। পারিবারিক নানান প্রতিকূলতার মধ্যেও ১৯৮৭ সালে এসএসসি পাশ করেন। দুই বছরের মাথায় ১৯৮৯ সালে একই গ্রামের মামুন সরদারের সঙ্গে বিয়ে হয়। তার তিন ছেলে এক মেয়ে লেখাপড়া শেষ করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত। ১৯৯১ সাল থেকে সমাজ উন্নয়ন কাজে নিজেকে উৎসর্গ করেন। ২০০৬ সালে নাগরিক উদ্যোগে সামাজিক কাজ করেন। ২০১১ সালে বার্থী ইউনিয়নের সংরক্ষিত আসনের সদস্য পদে নির্বাচন করেন। এতে নির্বাচিত হতে না পারলেও সমাজের অসহায় দুঃস্ত মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ, নারী নির্যাতিন প্রতিরোধে সার্বক্ষনিক সোচ্চার একজন নারী কর্মী। নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় আজীবন একজন সংগ্রামী মানুষ। তাই সমাজ উন্নয়নে অবদান রাখায় তাকে জয়িতা ২০২০ নির্বাচিত করা হয়।

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন    
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী মিরাজ মাহমুদ
 
বার্তা ও বানিজ্যিক কার্যালয়ঃ কুশলা হাউজ, ১৩৮ বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সড়ক,
সদর রোড (শহীদ মিনারের বিপরীতে), বরিশাল-৮২০০।
© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
Developed by NEXTZEN-IT