করোনা ॥ আমার করুন অভিজ্ঞতা করোনা ॥ আমার করুন অভিজ্ঞতা - ajkerparibartan.com
করোনা ॥ আমার করুন অভিজ্ঞতা

2:51 pm , June 3, 2020

কাজী মিরাজ ॥ ৩১ মে রোববার দিনগত রাত পোনে ১১টা। ভয়ার্ত এক আত্মচিৎকারের সাথে একটা ফোন এলো। ফোনটা ছিলো আমার স্ত্রীর। ফোন আসার সাথে সাথেই আমি বুঝতে পেরেছি আমার স্ত্রীর মাতৃবিয়োগ হয়েছে। আমি আগেই প্রস্তুত ছিলাম এই খবরের জন্য। কারন গত কয়েকদিন ধরেই তিনি বেশ অসুস্থ ছিলেন। রাত ১১টা নাগাদ শাশুড়ীর আবাসস্থল নগরীর আলেকান্দা এলাকা (পুরো ঠিকানা দিলাম না) পৌছুলাম। পুরো এলাকায় ভুতুরে পরিবেশ। সমস্থ বাড়ীর বাতি নিভানো। দরজা জানালা বন্ধ। থেমে থেমে আসছে স্বজনদের শোকের আহাজারি। আশেপাশের দুএকটি জানালার কিঞ্চিত খোলা অংশে ভয়ার্ত চোখ। যেন কিছুক্ষন আগে এখানে ভংঙ্কর কোন যুদ্ধ হয়েছে। ঘটনার কয়েকঘন্টা পর্যন্ত আশেপাশে বাড়ির কেউই এগিয়ে এলোনা। মাত্র কয়েক ঘন্টা আগেও যে মানুষটির জন্য এলাকাবাসির গভীর সহানুভুতি ও সহমর্মিতা ছিলো মুহুর্তেই তিনি হয়ে গেলেন এক অজানা আতঙ্ক। হাতেগোনা কয়েকজন আত্মীয়স্বজন এবং বন্ধু বান্ধব এলেও তাদের চোখে মুখে ছিলো অজানা শঙ্কা। বেশির ভাগ মানুষের মনে সন্দেহ দানা বাঁধে করোনায় মৃত্যু হয়েছে তাদের প্রতিবেশির! একঘন্টা পর বরিশাল কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের বরিশাল অফিসের প্রধান ফয়সাল মাহামুদ ও তার চার জন পুরুষ সঙ্গী ও দুই নারী আসলেন। পরম মমতায় তারা দোতলা থেকে লাশ নামিয়ে ধর্মীয় অনুশাসন অনুযায়ী গোসল এবং অন্যান্য কাজে অংশ নিলেন। এই সময় আসলো প্রথম বাঁধা। এখানে মরহুমার গোসল করানো যাবে না। কিছুক্ষুনের মধ্যে পুলিশ এলো। তাদের বক্তব্য বেশি ভিড় করতে পারবেন না। এরপরে ফোন এলো কোতয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নুরুল ইসলামের। তিনি বললেন, মৃতের নমুনা পরীক্ষা করা দরকার। এ কাজে তিনি সহযোগীতাও করতে চান। এর পরে সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. আব্দুল মতিন ফোন করে বললেন কিছু সময়ের মধ্যেই নমুনা সংগ্রহের জন্য এক্সপার্ট আসবে। আধাঘন্টার মধ্যেই নমুনা সংগ্রহ করা হলো। আমার অসুস্থ স্ত্রীকে রাত ৩টা ১০ মিনিটে পিপিই, হ্যান্ড গ্লাভস, মাক্স সহ অনেকটা চাদে অবতরন কারী নভোচারীর বেশে আলোকান্দা এলাকায় শ্বশুর বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হলো শেষ বারের মতো মায়ের মুখ দেখানোর জন্য। আশেপাশের সমস্ত বাড়ির দরজা-জানালা বন্ধ থাকায় বাড়তি কোন বাতির ব্যবস্থা করা গেল না। গর্ভধারিনী মাকে টর্চের আলো জেলে কয়েক মূহুর্ত দেখানো হলো। স্ত্রীকে আমার সদর রোডের বাসায় প্রায় সঙ্গাহীন অবস্থায় রেখে পুনরায় শ্বশুরবাড়িতে গেলাম। ইতিমধ্যে গোসল করানো হয়ে গেছে। লাশের পাশে আমার শাশুরির একমাত্র পুত্র, আমি ও আমার এক ভায়রা এবং খুব কাছের দু তিন জন ঠায় দাড়িয়ে রইলাম। মৃত্যু থেকে দাফন পরবর্তী ১০ ঘন্টার মধ্যে শ্বশুর বাড়ির খুব কাছের আত্মীয় স্বজন এবং স্থানীয় কাউন্সিলরেরও দেখা মেলেনি। এমনকি সকাল ৯টায় যখন লাশ নিয়ে গোরস্থানের উদ্দেশ্যে যাত্রার পূর্ব পর্যন্ত রাতে বন্ধ করা কোন প্রতিবেশির দরজা জানালা খোলাই হলো না। কোন একজনও একটি বারের জন্য বাড়ির বাহির হলো না। পরিস্থিতি বিবেচনা করে কেউ যাতে বিব্রত না হয় সকাল ৯টায় অত্যন্ত তড়িঘড়ি করে সদর উপজেলা চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান রিন্টুর লাশ টানা ট্রাকে গোরস্থানে মরদেহ নিয়ে যাওয়া হলো। গোরস্থানে নেওয়ার সময় আশেপাশের পরিবেশ দেখে মনে হয়েছিলো ওই এলাকায় সকাল ৯টায়ও সুর্যোদয় হয়নি। যেন এখানে স্বঘোষিত কারফিউ চলছে। ১০/১২ জনের অংশগ্রহণে জানাজা শেষে আমার শাশুরির দাফন কার্য সম্পন্ন করলাম। এই ১০/১২ জনের মধ্যে ৫জনই ছিল কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের কর্মী। দাফনের পরের দিন বিকেলের দিকে প্রতিবেশি এক পুলিশ কর্মকর্তার ফোন এলো। ফোনের সারমর্ম হলো এলাকার সববাড়িওয়ালাদের একই অভিমত। আপনার শ্বশুর বাড়ির কেউই করোনার নমুনা রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত বাড়ি থেকে বের হতে পারবে না। মুহুর্তের মধ্যেই নিজেকে একজন অসহায় মানুষ হিসেবে আবিষ্কার করলাম। নিজেকে কোন রকমে সংবরন করলাম। অত্যন্ত বিনয়ের সাথে ফোনের অপরপ্রান্তের শশুর বাড়ির প্রতিবেশিকে তার এই অযোক্তিক আবদারের সম্মান জানালাম। ফোনের লাইন কাটার পর দেখলাম আমার দু-চোখের অশ্রুধারা চিবুক বেয়ে নামছে। পরের দিন রাতে খবর পেলাম আমার শ্বাশুরির নমুনার রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে। পুনরায় লক্ষ করলাম দু-চোখের অশ্রুধারা আমাকে ভিজিয়ে দিচ্ছে। পরম করুনাময়ের কাছে শুকরিয়া জানালাম। মুহুর্তেই মনে হলো যদি পজেটিভ রিপোর্ট আসতো তাহলে এই সমাজের তথাকথিত পরম সভ্য মানুষগুলো হয়তো শোকে কাতর আমার শাশুরির একমাত্র অসহায় পুত্র ও অসুস্থ শ্বশুরকে এলাকা ছাড়া করতো। হে পরম করুনাময় আমাদের করুনা কর। মুক্তি দাও অদৃশ্য করোনার ভয়ঙ্কর রূদ্র মুর্তি থেকে।

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন    
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী মিরাজ মাহমুদ
 
বার্তা ও বানিজ্যিক কার্যালয়ঃ কুশলা হাউজ, ১৩৮ বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সড়ক,
সদর রোড (শহীদ মিনারের বিপরীতে), বরিশাল-৮২০০।
© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
Developed by NEXTZEN-IT