মাদক ছেড়ে আলোর পথের যাত্রীরা সফল মাদক ছেড়ে আলোর পথের যাত্রীরা সফল - ajkerparibartan.com
মাদক ছেড়ে আলোর পথের যাত্রীরা সফল

2:47 pm , December 6, 2019

খান রুবেল ॥ দিনে আত্মগোপন, রাতে র‌্যাব-পুলিশের ভয়ে নির্ঘূম রাত। সেই সাথে মরণঘাতি মাদকের ভয়াবহ ছোবল। প্রতিটি মুহুর্ত যেন ভয় আর উৎকন্ঠায় কাটছিলো। তার মধ্যে মাসে মাসে মামলার ঘানি টানতে আদালতে কাঠগড়ায়। কখনো বা স্বজনদের ছেড়ে জেলখানার চার দেয়ালে বন্ধি থাকতে হয়েছে। সার্বিকভাবে জীবন-যাপনের পরিধি ছোট হয়ে যায়। জীবনধারন হয়ে উঠে অভিশপ্ত। ভেবে ছিলাম আর বেঁচে থাকা হবে না। কিন্তু না, খুঁজে পেয়েছি আলোর দেখা। মা-ভাই এবং স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে বেশ ভালোই কাটছে জীবন সংসার। দেখছি সৎ পথে বড় হওয়ার স্বপ্ন। মানুষের কাছ থেকে পাচ্ছি আত্মসম্মানও। অনেকটা আবেগ জড়ানো কন্ঠে এ কথা বলেছেন উজিরপুর পৌর এলাকার ৫ নং ওয়ার্ডের টেম্পু স্ট্যান্ড এলাকার বাসিন্দা পিতৃহারা ২৬ বছর বয়সী যুবক মো. গোলাম রাব্বি বালি। যিনি ডিআইজি’র আহ্বানে সাড়া দিয়ে মাদকের অন্ধকার জগৎ ছেড়ে আত্মসমর্পণ করে আলোর পথে ফিরেছেন। একান্ত আলাপে মাদক ব্যবসা ছেড়ে সুন্দর ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা রাব্বি বালি বলেন, ‘মাত্র ১৮ বছর বয়সে বাবা মারা যান। অসহায় মায়ের পক্ষে সংসারের হাল ধরা সম্ভব হচ্ছিলো না। মানুষের দুয়ারে গিয়ে আমাকে এবং ছোট ভাই ও বোনের মুখে দু’মুঠো খাবার তুলে দিয়েছেন। মায়ের কষ্ট দেখে নিজেই উপার্জনের পথ খুঁজি। কিন্তু নিষ্ঠুর এ জগতে কেউ কাউকে সহযোগিতার হাত বাড়ায় না। আমার ভাগ্যেও তেমনটিই ঘটেছিলো। রাব্বি বলেন, ‘বেকারত্ব জীবন নিয়ে কয়েকটি বছর কেটে যায়। তার মধ্যে সাড়ে তিন বছর পূর্বে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে বিয়ে করেছি। বিয়ের পরে সংসারে হাল এসে কাঁধে উঠে। দেখা দেয় চরম অর্থ সংকটের। কোন কাজ না পেয়ে অর্থের জন্য বেছে নিয়েছিলাম অন্ধকার মাদকের জগৎ। প্রথমে মাদক সেবন করেছি। এর পর প্রতিবেশী মাদক ব্যবসায়ী মামুন হাওলাদারের মাধ্যমে সরাসরি মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ি। আমার মুল ব্যবসা ছিলো ইয়াবা এবং ফেন্সিডিল। যা পেতাম প্রতিবেশী মামুনের কাছ থেকেই। প্রথম প্রথম এগুলো বিক্রি করে বেশ ভালই আয় রোজগার হতে লাগলো। এক পর্যায় পেশাদার মাদক ব্যবসায়ী হয়ে গেলাম। টাকার দেখা মিললেও অসৎ পথে এ আয়ে সংসারে শান্তি আসলো না। বরং অশান্তি যেন চিরসঙ্গী হয়ে গেলো। মাদকসহ ধরা পড়ে হয়ে গেলাম তালিকাভুক্ত ব্যবসায়ী। পর পর হওয়া দুটি মাদক মামলায় আদালতে হাজিরা এবং মামলা চালাতে গিয়ে যা উপার্জন করেছিলাম তার সবটুকুই ফুরিয়ে গেছে। তার উপর র‌্যাব-পুলিশের অভিযানের ভয়ে কতো রাত যে নির্ঘূম কেটেছে তা গুনে বলা যাবে না। দিনের আলোয় ভয় কম থাকলেও সমাজের সাথে মিশতে পারতাম না। ঘৃনা আর আড় চোখে দেখতো সবাই। মা, ছোট ভাই-বোন এবং স্ত্রীও কারোর কাছে মুখ দেখাতে পারত না। কেউ মিশতোনা আমাদের সাথে। জন্ম নেয়া আমাদের শিশু সন্তানের ভবিষ্যৎ প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে দাড়ায়। তাই ভেবে ছিলাম এ অপরাধের জগৎ ছেড়ে ভালো হয়ে যাব। কিন্তু সেই সুযোগ পাচ্ছিলাম না। রাব্বি বলেন, ‘হঠাৎ করে গত প্রায় দুই বছর পূর্বে উজিরপুর থানার ওসি স্যার আমাকে ধরে নিয়ে বলল মাদক ব্যবসা ছেড়ে দিতে হবে এবং ডিআইজি স্যারের কাছে আত্মসমর্পন করতে হবে। সুযোগটা আর হাত ছাড়া করলাম না। এক কথায় রাজি হয়ে গেলাম। সকলের সামনে আত্মসমর্পণ করলাম। আর কখনো মাদকের সংস্পর্সে যাব না বলে প্রতিজ্ঞা করলাম। ডিআইজি এবং এসপি স্যার খুশি হয়ে আমার কর্মস্থানের ব্যবস্থা করলেন। সৎ পথে রোজগারের জন্য তিন চাকার একটি ভ্যানগাড়ি উপহার দিলেন। ওই ভ্যান গাড়ি চালিয়ে মা-স্ত্রী-সন্তান এবং ভাই-বোনদের কষ্ট করে দিন চলছিলো। এরপর মা রাশিদা বেগম গত প্রায় দুই বছর পূর্বে প্রবাসে যান। মায়ের দেয়া টাকায় একটি গ্যাসে চালিত অটো টেম্পু কিনেছি। আমি নিজেই অটো টেম্পুটি চালাচ্ছি এবং ডিআইজি স্যারের দেয়া ভ্যান গাড়িটি ভাড়া দিয়েছি। প্রতিদিন সেখান থেকে ৩০ টাকা করে পাচ্ছি। আত্মসমর্পনের পরে একটি মামলা থেকে খালাসও পেয়েছি। আরেকটি মামলা রয়েছে সেটিও ডিআইজি স্যার লিগ্যাল এইডের মাধ্যমে পরিচালনার ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন। সব মিলিয়ে আমি এবং আমরা এখন বেশ ভালোই আছি। আসলে মাদক কোন ভালো জীবন নয়। এটি একটি অভিশপ্ত জীবন। আমি ফিরে এসেছি। এখনো যারা এই অভিশপ্ত জীবনে রয়েছেন আমি মনে করি তাদেরও ফিরে আসা উচিৎ। এদিকে একই ভাবে কথা হয় মাদক ছেড়ে আলোর পথে ফিরে আসা ঝালকাঠি সদর উপজেলার কলাবাগান এলাকার বাসিন্দা মাদক ব্যবসায়ী রুবিনা বেগম (৩০) এর সঙ্গে। তিনি জানান, ‘স্বামী মনিরুজ্জামানের মাধ্যমে মাদক ব্যবসার সাথে সম্পৃক্ত হন তিনি। গাঁজা এবং ইয়াবা বিক্রি করতেন তারা। শুধু বিক্রিই নয়, একসময় মাদকাসক্তও হয়ে পড়েন। আমার স্বামীর বিরুদ্ধে এ যাবত ৪টি মাদক মামলা হয়েছে। যার দুটিতে আমিও আসামি।তিনি বলেন, মাদকের কারনে সংসারে সীমাহিন অশান্তি ছিলো। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মারপিট, কলোহ লেগেই ছিলো। প্রতি রাতে পুলিশ এসে দরজার কড়া নাড়তো। ঘরে বিয়ের যোগ্য কলেজ পড়–য়া মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুঃশ্চিন্তা চলে আসলো। পরে ডিআইজি স্যারের ডাকে সাড়া দিয়ে স্বামী-স্ত্রী দু’জনই মাদক ব্যবসা ছেড়ে আত্মসমর্পণ করেছি। স্যার আমাদের একটি সেলাই মেশিন দিয়েছেন। কিন্তু মেশিন চালানোর জন্য যে অভিজ্ঞতার প্রয়োজন সেটা না থাকায় মেশিন বিক্রি করে দিয়েছি। স্বামী এখন কাঠ মিস্ত্রির কাজ করছেন। ঝালকাঠির এসপি স্যার বলেছেন স্বামী মনিরুজ্জামানকে যুব উন্নয়নের মাধ্যমে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে দিবেন। সব থেকে বড় কথা হলো পুলিশ বা আইন শৃঙ্খলা বাহিনী এখন আর আমাদের খোঁজ করে না। হয়রানী করছে না। কেউ চাঁদা চাইতে আসছে না। বরং একজন দারোগা (এসআই) সব সময় আমাদের খোঁজ খবর রাখছেন। দুঃখ কষ্ট থাকলে তা সমাধানের চেষ্টা করছেন। তাই আমরা এখন ভালো আছি। একই ভাবে মাদক ছেড়ে শান্তিতে জীবন যাপনের গল্প বলেছেন, উজিরপুরের গুঠিয়ার আ. হালিম ও ইউনুস হাওলাদার। এদের মধ্যে একজন মাদক গাঁজা ব্যবসায়ী এবং অপরজন ছিলেন গাঁজা সেবনকারী। আত্মসমর্পণের পরে এদের দু’জনকেই কর্মস্থানের জন্য দুটি সেলাই মেশিন উপহার দেয়া হয়েছে ডিআইজি ও এসপি অফিস থেকে। এরা দু’জনই সেলাই মেশিন ভাড়া দিয়ে একজন চা-পানের ব্যবসা এবং অপরজন করজন মাহেন্দ্র চালিয়ে সৎ পথে উপার্জন করছেন। অপরদিকে মাদক ছেড়ে সুস্থ জীবনে ফিরে আসা বাবুগঞ্জ উপজেলার রহমতপুর ইউনিয়নের লোহালিয়া গ্রামের শ্যামল সেনের ছেলে প্রদীপ শীল (২৫) জানান, ‘বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছিলাম। পরে বাবুগঞ্জের ওসি স্যার বললেন আত্মসমর্পণ করার জন্য। তার কথা মতো আত্মসমর্পণ করেছি। পরে ডিআইজি স্যারের ব্যবস্থাপনায় আমাকে মাদক নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। সেখান থেকে ফিরে এখন আমি পুরোপুরি সুস্থ। তিনি বলেন, স্যার আমাকে একটি সেলাই মেশিন দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমি আনিনি। কারন আমার কর্মসংস্থান রয়েছে। বাবুগঞ্জ বাজারে আমার প্রদীপ হেয়ার কাটিং নামক সেলুন রয়েছে। তা দিয়েই আমার জীবিকা নির্বাহ হচ্ছে। ডিআইজি কার্যালয় সূত্রে জানাগেছে, ‘বর্তমান ডিআইজি (উপ মহা-পরিদর্শক) শফিকুল ইসলাম গত ২০১৭ সালের ৬ আগস্ট যোগদান করেন। এর পর পরই বরিশাল বিভাগকে মাদক মুক্ত করতে নানা উদ্যোগ গ্রহন করে। যার মধ্যে মাদক ব্যবসায়ী এবং সেবনকারীদের আত্মসমর্পণের সুযোগ দেয়ার বিষয়টি অন্যতম। এমনকি এতে বেশ সফলতা এবং প্রশংসারও কুড়িয়েছেন তিনি। কেননা ডিআইজি’র আহ্বানে সাড়া দিয়ে রেঞ্জের ৬টি জেলার এক হাজার ৬৩ জন মাদক ব্যবসায়ী এবং সেবনকারী মাদকের অন্ধকার জগৎ ছেড়ে আলোর পথে নতুন জীবনে ফিরেছেন। যার মধ্যে ৩৪৩ জনক মাদক সেবীকে চিকিৎসার জন্য বিনামূল্যে এবং স্বল্পমূল্যে মাদক নিরাময় কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে। চিকিৎসা শেষে নিজ বাড়িতে ফিরে গেছে ৩০৮ জন মাদক সেবী। এখনো চিকিৎসাধিন রয়েছে ৩৫ জন। তাছাড়া আত্মসমর্পণকারীদের মধ্যে ৩৯০ জনকে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাদের পছন্দ অনুযায়ী কাউকে চায়ের দোকানের সরঞ্জামাদী, কাউকে রিক্সা-ভ্যান, মাছ ধরার জাল এবং সেলাই মেশিন প্রদান করা হয়েছে। ২৮১ জনের মাদক ব্যবসায়ী এবং সেবীদের লিগ্যাল এইডের মাধ্যমে মামলা পরিচালনার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর পাশাপাশি পুনর্বাসনমূলক কর্মসূচী ও রেজিস্টার্ড সমবায় সমিতি গঠন করে দিয়েছেন ডিআইজি। এ প্রসঙ্গে ঝালকাঠি জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এমএম মাহমুদ হাসান বলেন, ‘ডিআইজি স্যারের দিক নির্দেশনায় মাদক ব্যবসায়ীদের আত্মসমপর্ণ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। যারা স্বেচ্ছায় মাদকের জগৎ ছেড়ে দিচ্ছে তাদের আত্মসমর্পণের সুযোগ দেয়া হচ্ছে। যারা আত্মসমর্পণ করছে না তাদের বিরুদ্ধে মামলাসহ আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। উপ মহা পরিদর্শক (ডিআইজি) শফিকুল ইসলাম- বিপিএম (বার), পিপিএম বলেন, ‘পুলিশের কাজ হলো আইন প্রয়োগ করা। কিন্তু আইন প্রয়োগেই সকল সমস্যার সমাধান নয়। একজন মাদক সেবনকারী যখন মামলা খাচ্ছে তখন ওই মামলা চালাতে গিয়ে তাকে আরও অপরাধ করতে হচ্ছে। মামলার খরচ বহন করতে গিয়ে সে মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত হয়। এতে দেখা যায় একজন মাদক ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে একাধিক মামলা থাকায় সে আর ভালো হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না। এ কারনেই মাদক ব্যবসায়ী এবং সেবনকারীদের আত্মসমর্পণের সুযোগ দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ‘যার মাদক ছেড়ে আলোর পথে এসেছে তাদের পুলিশ বা কোন আইন শৃঙ্খলা বাহিনী এখন আর বিরক্ত করছে না। তারা শান্তিতে বসবাস করছে। যারা আত্মসমর্পণ করেনি তাদের গ্রেফতারসহ মামলা দিয়ে জেলে পাঠানো হচ্ছে। আবার যারা আত্মসমর্পণ করে পুনরায় মাদকের জগতে ফিরে গেছে তাদের বিরুদ্ধেও আমাদের পুলিশ কঠোর অবস্থানে রয়েছে। আমরা চাই না কারোর বিরুদ্ধে মামলা হোক। আর সেই মামলা চালাতে গিয়ে বড় ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়–ক। তাই যারা এখনো আত্মসমর্পণ করেনি তাদের জন্য আমাদের দরজা খোলা আছে। চাইলে তারাও আত্মসমর্পণ করে আলোর পথে ফিরে আসুক। এতে অন্যদের মধ্যে তারাও ভালো থাকবেন।

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন    
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী মিরাজ মাহমুদ
 
বার্তা ও বানিজ্যিক কার্যালয়ঃ কুশলা হাউজ, ১৩৮ বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সড়ক,
সদর রোড (শহীদ মিনারের বিপরীতে), বরিশাল-৮২০০।
© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
Developed by NEXTZEN-IT