ছারছীনার মরহুম পীর শাহ্ মোহাম্মদ মোহেব্বুল্লাহ এর জীবন ও আদর্শ ছারছীনার মরহুম পীর শাহ্ মোহাম্মদ মোহেব্বুল্লাহ এর জীবন ও আদর্শ - ajkerparibartan.com
ছারছীনার মরহুম পীর শাহ্ মোহাম্মদ মোহেব্বুল্লাহ এর জীবন ও আদর্শ

4:33 pm , July 5, 2025

আলহাজ্ব মির্জা নূরুর রহমান বেগ ॥ গতবছরের এইদিনে আমরা হারিয়েছি আমাদের প্রাণপ্রিয় অভিভাবক, মহান শিক্ষাগুরু ছারছীনা শরীফের মরহুম পীর শাহ্ মোহাম্মদ মোহেব্বুল্লাহ (রহঃ) কে। একটি বছর হয়ে গেল তিনি আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তাঁর অবর্তমানে আজ আমরা তাঁর রেখে যাওয়া স্মৃতিগুলোকে স্মৃতিচারণ করে নিজেকে ধন্য করতে চাই।
জন্ম ও বংশ পরিচয় : ইংরেজি ১৯৫০ সাল ও বাংলা ১৩৫৭ সালের এক শুভক্ষণে দক্ষিণ বাংলা বরিশালের পিরোজপুরের ছারছীনা নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন মাওলানা শাহ্ মোহাম্মদ মোহেব্বুল্লাহ। তার পূর্ণনাম আবু মাহবুব শামসুল আরেফীন শাহ্ মোহাম্মদ মোহেব্বুল্লাহ। পিতার নাম শাহ্ আল্লামা শাহ্ সূফী আবু জাফর মোহাম্মদ ছালেহ, মাতার নাম মোসাম্মাত মনোয়ারা বেগম, দাদার নাম শাহ্ সুফী নেছারুদ্দীন আহমদ। তিনি বিখ্যাত আকন বংশে জন্মগ্রহণ করেন।
উপাধী লাভ : তাঁর দাদা মারফতের স¤্রাট শাহ সুফি নেছার উদ্দিন আহমদ (রহ.) তখনো জীবিত। হযরত মাওলানা আবু জাফর মোহাম্মদ ছালেহ তদীয় ওসিয়ত নামায় উল্লেখ করেছেন- “একদা ওয়ালেদ সাহেব কেবলা তাঁর সামনে একটি চৌকিতে মোহেব্বুল্লাহকে বসালেন এবং বললেন এই হল শাহ সাহেব ।
শিক্ষাজীবন :১৯৬১ সালে ১১ বছর বয়সে তৎকালীন ছারছীনাতে প্রতিষ্ঠিত “আদর্শ মাদ্রাস” যা বর্তমানে “দ্বীনিয়া” মাদ্রাসা নামে পরিচিত সেখানে ভর্তি হন। ১৯৭৫ সালে কৃতিত্বের সাথে ছারছীনা কামিল মাদ্রাসা থেকে প্রথম  শ্রেণীতে কামিলে উত্তীর্ণ হন।
উল্লেখযোগ্য ওস্তাদ: তাঁর শিশুকালের ওস্তাদ ছিলেন নাজিরপুর থানার কলারদোয়ানিয়া গ্রামের মৌলভী আব্দুল হামিদ। এছাড়াও মুমতাজুল ফুকাহা আলহাজ্ব হযরত মাওলানা তাজাম্মুল হুসাইন খাঁন, বাংলার অদ্বিতীয় মুহাদ্দিস আল্লামা নিয়াজ মাখদুম খোত্তানী, বিশিষ্ট মুহাদ্দিস আব্দুস সাত্তার বিহারী, মাওলানা আব্দুল কুদ্দুস, মাওলানা আজিজুর রহমান (তৎকালীন ভাইস প্রিন্সিপাল ছারছীনা কামিল মাদ্রাসা), হযরত মাওলানা আব্দুল মজিদ, হযরত মাওলানা আবুল খায়ের মোহাম্মদ আব্দুল আজিজ, হযরত মাওলানা আব্দুর রশিদ, হযরত মাওলানা রফিকুল্লাহ নেছারী (পটুয়াখালী হুজুর)।
বিশেষ পা-িত্য অর্জন : তিনি ছিলেন তীক্ষ্ম মেধার অধিকারী। যোগ্য ওস্তাদদের আন্তরিক তা’লীম ও শিক্ষার মাধ্যমে তিনি বিশেষ পান্ডিত্য অর্জন করতে থাকেন। আরবী, উর্দু, ফার্সি সহ বিভিন্ন ভাষায় যথেষ্ট মাহারাত ছিল তাঁর। নিরিবিলি এবং নির্জন পরিবেশ তিনি পছন্দ করতেন। গভীর রাতে রিক্ত প্রেমিকের মত তাকে ফার্সি বয়াত পড়তে দেখা যেত।
ইলমে তাসাউফ শিক্ষা : তিনি তাঁর তদীয় পিতা শাহ্ সুফী আবু জাফর মোহাম্মদ ছালেহ (রহঃ) থেকে ইলমে তাসাউফের গভীর জ্ঞান অর্জন করেন।
বিবাহ ও আওলাদ : একবার ফুরফুরা শরীফের পীর কেবলা হযরত মাওলানা আবু বকর সিদ্দিকী আল কুরাইশী তার প্রধান খলিফা ছারছীনা শরীফের হযরত পীর  কেবলাকে বলেছিলেন খোলাফায়ে রাশেদীনের আবু বকর সিদ্দিকের সাথে রাসুল (সা.) এর যে সম্পর্ক বাবা নেছার তোমার সাথে আমার সেই সম্পর্ক। উক্ত কথার পরিপূর্ণতা লাভ করলো হুজুর কেবলার বিবাহের মাধ্যমে। ১৯৮০ সালে ফুরফুরা শরীফের গদ্দীনশীন পীর হযরত মাওলানা আবুল আনছার মোহাম্মদ আব্দুল কাহহার সিদ্দিকীর প্রথমা কন্যাকে বিবাহ করেন। তিনি দুই পুত্র সন্তন ও তিন কন্যা সন্তান রেখে যান। পুত্রদ্বয় : বড় সাহেবজাদা আলহাজ্ব হযরত মাওলানা শাহ্ আবু নছর নেছারুদ্দীন আহমাদ হুসাইন (মা.জি.আ.) (বর্তমান গদ্দীনশীন পীর), ছোট সাহেবজাদা আলহাজ্ব হযরত মাওলানা হাফেজ শাহ্ আবু বকর মোহাম্মদ ছালেহ নেছারুল্লাহ  (ছোট হুজুর কেবলা) (মা.জি.আ.)।
বিভিন্ন দায়িত্ব পালন : ১৯৭৫ সালে থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত দুই বছর ছারছীনা দারুসসুন্নাত কামিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ জমইয়াতে হিযবুল্লাহর কেন্দ্রীয় নায়েবে আমীরের পদে অধিষ্ঠিত হন। ১৯৮৩ সালে ছালেহিয়া ট্রাস্টি বোর্ডের সেক্রেটারি নিযুক্ত হন। একই সময়ে তিনি ছারছীনা মাদ্রাসার সেক্রেটারী নিযুক্ত হন। ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ জমিয়তে উলামার সেক্রেটারী নিযুক্ত হন। ১৯৯০ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারী শুক্রবার বাদ জুময়াহ ছারছীনা দরবার শরীফের পীর হিসেবে দায়িত্বগ্রহণ এবং সকলকে তাজদীদি বাইয়াত করান। ১৯৯০ সালে হতে ওফাতের পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশ জমইয়াতে হিযবুল্লাহর আমীরের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯০ সাল হতে ওফাতের পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। এছাড়াও ওফাতের পূর্ব পর্যন্ত ঢাকার মহাখালিস্থ মসজিদে গাউসুল আজমের মুতাওয়াল্লী ছিলেন।
দেশ-বিদেশ ভ্রমণ : ১৯৭৪ সালে পিতার সাথে প্রথম হজ্বব্রত পালন করেন। ১৯৮২ সালে পিতার সাথে ইরাক সফর করেন। ১৯৯৪ সালে ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হেসেনের দাওয়াতে “আলমে ইসলামী আন্তর্জাতিক সম্মেলনে” তিনি যোগদান করেন এবং প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন কর্তৃক বিশেষ সম্মানে ভূষিত হন। সমগ্র দেশের এ প্রান্ত থেকে সে প্রান্ত পর্যন্ত হেদায়েতের উদগ্র বাসনা নিয়ে উল্কার গতিতে ছুটে বেরিয়েছেন তিনি।
অসুস্থতা : ২০২৪ সালের মাঘের মাহফিলের শেষ দিন। মাগরিবের নামাজ হয়েছে, তালিম হয়েছে, লক্ষ লক্ষ ভক্ত মুরীদের সামনে তাদের কলিজার টুকরা প্রাণপ্রিয় পীর শারীরিকভাবে অসুস্থ, সকলে ভগ্ন হৃদয়। কারও বুঝতে বাকি নাই মুর্শিদ আর বেশী দিন থাকবে না। জীবন সায়াহ্নের বেলাভূমিতে দাঁড়িয়েছেন তিনি। তিনি স্টেইজে সকলের সামনে চেয়ারে বসলেন। নিষ্পাপ উজ্জ্বল পবিত্র চেহারার দিকে তাকিয়ে সকলের চোখে আসুর ফোয়ারা বয়ে  যেতে রইলো।  তিনি নসিহত করলেন- “আমার পরে আপনারা এ দরবার দেখে রাখবেন। মাদ্রাসা, মসজিদ, দরবার, খানকাহ, দ্বীনিয়া মাদ্রাসা আপনাদের। বাতিলের সাথে কখনো আপোষ করবেন না। এ দরবারকে আমলের মাধ্যমে টিকিয়ে রাখবেন। আমার পরে কাকে নিয়ে চলবেন তা অসিয়ত নামায় লেখা আছে, আপনার দেখে নিবেন”। কারও বুঝতে বাকি রইল না প্রিয়তম পীর আমাদের থেকে বিদায় নিচ্ছেন। কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল সারা ময়দান। হুজুরের অসুস্থতা বাড়তে থাকলে জানুয়ারিতে প্রথমে ঢাকা ও পরে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। নবী পাগল শায়খ এত অসুস্থতার মধ্যেও মদীনা শরীফ যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে যান। রমজান মাসে জীবনেরন শেষ ওমরা পালন করেন।
ওফাত লাভ : আমাদের মহান মুর্শিদ ২০২৪ সালের ১৭ জুলাই বুধবার রাত ২ টা ১১ মিনিটে তাহাজ্জুদের সময় ঢাকার গ্রীন রোডস্থ সেন্ট্রাল হসপিটালে মহান রবের জিকিররত অবস্থায় মায়ার বাঁধন ছিন্ন করে সকলকে এতিম করে চিরতরে বিদায় নিলেন। কেঁদে উঠলো লক্ষ লক্ষ আশেক ও ভক্তকুল।
জানাজা ও দাফন : হুজুরের ইন্তেকালের পরদিন ১৮ জুলাই বাদ জোহর ছারছীনা দরবার শরীফে তাঁর জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। এতে ইমামতি ও সমবেত সকলকে তাজদীদি বাইয়াত ও খুতবা প্রদান করেন তার বড় সাহেবজাদা বর্তমান গদ্দীনশীন পীর আলহাজ্জ হযরত মাওলানা শাহ্ আবু নছর নেছারুদ্দীন আহমাদ হুসাইন (মা.জি.আ.)। জানাযা শেষে পিতার পার্শ্বে তাঁকে দাফন করা হয়।

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন    
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী মিরাজ মাহমুদ
 
বার্তা ও বানিজ্যিক কার্যালয়ঃ কুশলা হাউজ, ১৩৮ বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সড়ক,
সদর রোড (শহীদ মিনারের বিপরীতে), বরিশাল-৮২০০।
© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
Developed by NEXTZEN-IT