4:35 pm , July 1, 2025

সাইফুল ইসলাম, বাবুগঞ্জ প্রতিবেদক ॥ বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীরের নামে বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার আগরপুর (জাহাঙ্গীর নগর) ইউনিয়নে ২০০৮ সালে গড়ে তোলা হয় গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এটি আকৃষ্ট করতে পারছে না দর্শনার্থীদের। এর কারণ হিসেবে কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও পরিকল্পনার অভাবকে দায়ী করছেন সচেতন মহল।
সুশিল সমাজের প্রতিনিধিরা বলেন, নির্মানের দেড়যুগ পেরিয়ে গেলেও সরকারি সহযোগিতা ও প্রচারের অভাবে পূর্ণতা পায়নি বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরটি। এটির এখন বেহালদশা। বীরশ্রেষ্ঠের নামের এই জাদুঘরটি সংস্কার করে যুগ উপযোগি করে গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। জাদুঘরটিতে আকৃষ্ট করার মতো মুক্তিযুদ্ধের তেমন কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই। গ্রন্থাগারে নেই পর্যাপ্ত বই, জীর্ণ হয়ে পড়েছে আসবাবপত্র। দর্শনার্থীদের অভিযোগ, জাদুঘরটির বাইরে জঙ্গলে ঘেরা ভেতরেও তেমন কিছু নেই।
সরজমিনে গিয়ে বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর স্মৃতি জাদুঘরে ঢোকার আগেই জানা গেল সেখানকার অযতœ-অবহেলার কথা। ভেতরে গিয়ে সেসবের সত্যতা মিলেছে । গত ৩ বছর ধরে কেয়ারটেকার নেই। সাহিত্য, প্রযুক্তি বিজ্ঞান, রচনাবলীসহ আরও কিছু শেল্ফ ভাঙাচোরা এবং খালি পড়ে আছে। একইসঙ্গে জাদুঘরের ভেতরে ড্যামেজ হয়ে পানি পড়ছে। কক্ষের দরজা পুরোটাই ভাঙা। বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর স্মৃতি জাদুঘর হলেও সেখানে এই বীরশ্রেষ্ঠর বীরত্বগাঁথা ও জীবনী সংক্রান্ত কোনো বই পাওয়া গেল না। সবমিলিয়ে পুরো গ্রন্থাগার ও জাদুঘরেই অযতœ আর অবহেলার ছাপ স্পষ্ট। একপর্যায়ে পাশে থাকা মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষার্থীদের জিজ্ঞেস করে জানা গেল গ্রন্থাগার ও জাদুঘরে মানুষের আসা যাওয়া না থাকায় দিনদিন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
বীরশ্রেষ্ঠের আত্মীয় ও একই গ্রামের বাসিন্ধা মোঃ হারুন অর রশিদ বলেন, আমি সহকারী লাইব্রেরীয়ান হিসেবে অস্থায়ীভাবে বিনা পারিশ্রমিকে দুই বছর দায়িত্ব পালন করি। তার পরে ১ জন লাইব্রেরীয়ান নিয়োগ দেওয়া হলে প্রায় দুই থেকে তিন বছর থাকার পর চাকরি থেকে অব্যহতি নেয়। তার পরে দীর্ঘ দিন পর আবার সহকারী লাইব্রেরীয়ান নিয়োগ দেওয়া হয় সে-ও কিছু দিন পর চাকরি থেকে অব্যহতি দেয়। কেহই বিনা বেতনের চাকরি করেননি। তার পর থেকে অদ্যবধি ২০২৫ সাল পর্যন্ত কোন সহকারী লাইব্রেরীয়ান না থাকলেও একজন কেয়ারটেকার দেখাশোনা করতো। কিন্তু ২০২২ সালে ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হয়ে কেয়ারটেকার কাম দারোয়ান ইন্তেকাল করেন। তার পর থেকে প্রতিষ্ঠানটির দুইটা পদই শুন্য। কেয়ারটেকার কাম দারোয়ান মারা যাওয়ার পর তার ছেলে চাকরির আশায় দীর্ঘ দিন অস্থায়ীভাবে দায়িত্ব পালন করে আসছিল । কিন্তু চাকরি পাওয়ার আশ্বাস না পেয়ে তিনি দ্বায়িত্ব ছেড়ে দেয়। এখন দীর্ঘ দিন পর্যন্ত কোন দ্বায়িত্ব প্রাপ্ত লোক না থাকার কারণে প্রতিষ্ঠানটি অবহেলিত অবস্থায় পরে আছে। কোন দর্শনার্থী আসলে ভিতরে প্রবেশ করতে পারেনা। এই অবস্থায় বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীরের পরিবার ও আমরা এলাকাবাসী যথাযথ কর্তৃপক্ষের সু-দৃষ্টি কামনা করছি।
বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার সাহসি এ যোদ্ধা যতোটা সম্মানের সঙ্গে আছেন, নিজ জন্মভূমিতে ঠিক ততোটাই অবহেলার শিকার। এছাড়াও বীরশ্রেষ্ঠর প্রতি এমন অযতœ-অবহেলার কথা আক্ষেপের সুরেই জানালেন একমাত্র জীবিত তারই ছোট ভাই মনজুর রহমান বাচ্চু। দর্শনার্থী এমনকি এই গ্রন্থাগারের এলাকার লোকজন বা শিক্ষার্থীরা কেন আসছে না? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শিক্ষার্থী ও দর্শনার্থীদের আকৃষ্ট করার জন্য আমরা পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিতে পারিনি, জাদুঘরে মুক্তিযুদ্ধকালীন ছবি, ভিডিও আর্কাইভ থাকলে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা ইতিহাস জানার সুযোগ পেত। আগে এখানে মোটামুটি জনসমাগম হলেও এখন আর নেই।
মুক্তিযুদ্ধকালীন বেইজ কমান্ডার বীর প্রতীক রতন শরীফ বলেন, এটি সত্যিই একটি কষ্টদায়ক বিষয়। যাদের রক্তের বিনিময়ে আজ আমরা স্বাধীন দেশে বাস করছি তাদের স্মৃতি ও ইতিহাসকে আমরা পদদলিত করে চলছে। এই অবস্থা থেকে রেহাই পেতে হলে বীরশ্রেষ্ঠদের স্মৃতির প্রতি এমন অযতœ-অবহেলার মানসিকতা থেকে অবশ্যই বেরিয়ে আসতে হবে। আমাদের কে মুক্তিযুদ্ধের এই মহান বীরসহ সকল মুক্তিযোদ্ধার যথাযথ সম্মান দিতে হবে। তাদের চেতনা সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে নিরলস ভাবে কাজ করতে হবে। এই মহান বীরদের প্রতি এমন অযতœ-অবহেলা কখনোই কাম্য নয়, কোনো ভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
২০০৮ সালে বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার জাহাঙ্গীরনগর ইউনিয়নে বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের গ্রামের বাড়ি রহিমগঞ্জ গ্রামে নির্মাণ করা হয় গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বরিশাল জেলা পরিষদের তত্ত্বাবোধনে পরিচালিত হচ্ছে জাদুঘরটি।
সম্প্রতি গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শনে গিয়ে আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক বাবুগঞ্জের সন্তান ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ বলেন, শুধু বাবুগঞ্জ নয় সারা বাংলাদেশের যে-কোনো যায়গায় এরকম ইতিহাস ঐতিহ্য নতুন প্রজন্মের জানার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া উচিত আমাদের । সাধারণ জনগণ থেকে শুরু করে দেশের সকল মানুষ খুব সহজেই এই বিষয়গুলো যাতে জানতে পারে এবং এই বিষয়ের উপর জ্ঞান আহরণ করতে পারে সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত বলে আমি মনে করি।
বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও সেক্রেটারী মুহাম্মদ আমানুল্লাহ খান নোমান বলেন, দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানের নামে একটি জাদুঘর করলেও সেখানে দর্শনার্থী সহ সাধারণ জনগণের যাওয়া আসার জন্য স্বাধীনতার এত বছরেও এখন পর্যন্ত জেলার কোথাও কোনো পথনির্দেশক নাই। বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর এর নামে বরিশালের বাবুগঞ্জে একজন শ্রেষ্ঠ সন্তান রয়েছে এটি এখনকার প্রজন্ম ভালোভাবে জানে বলে আমার মনে হয় না। তাই যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে বিনীতভাবে অনুরোধ তারা যেন এই বিষয়ে অতি দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
উল্লেখ্য, বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাংগীর (ইঞ্জিঃ) [বিএসএস-১০৪৩৯] ৭ই মার্চ ১৯৬৯ সালে বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ থানার আগরপুর (বর্তমানে জাহাঙ্গীরনগর ইউনিয়ন) ইউনিয়নের রহিমগঞ্জ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম মৌলভী আবদুল মোতালেব হাওলাদার। তিনি ১৯৬৭ সনে পাকিস্তান হিবিটানি একাডেমিতে (কাকুবে) জেন্টলম্যান ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৭১ বাদে মুক্তিযুদ্ধ সনাক্যাল ডিবি পশ্চিম পাকিস্তানে ১৭০ নম্বর ইঞ্জিনিয়ার ব্যাটালিয়নে কর্মরত দিলেন। তিনি ১৯৭১ সালের ০৩ মূলাই পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বন্দিত্বের নাগপাশ ছিন্ন করে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন এবং রাজশাহী জেলার চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত এলাকায় ৭নং সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর অধিনায়ক হিসেবে কাজ শুরু করে। ১৪ ডিসেম্বর প্রত্যুষে নবাবগঞ্জের রেহাইচরের মধ্য দিয়ে নৌকাযোগে মহানন্দা নদী পার হন এবং অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে শত্রুর কয়েকটি ট্রেঞ্চ “দখন ময়ে নেন। উভয় পক্ষে ভূদুল সংঘর্ষের এক পর্যায়ে শত্রুপক্ষের একটি গুলি মহিউদ্দিনের কপালে মাঘাত করে এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি শাহাদাতবরণ করেন। ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর শহীদ ল্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাংগীর এর মৃতদেহ ঐতিহাসিক সোনামসজিদ প্রাঙ্গণে সমর্মহত করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে বীরোচিত ভূমিকা ও আত্মত্যাগের স্বীকৃতিস্বরূণ তাঁকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মানন বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবে ভূষিত করা হয়।