4:47 pm , June 25, 2025

বিশেষ প্রতিবেদক ॥ ‘পরিকল্পিত বনায়ন করি-সবুজ বাংলাদেশ গড়ি’ প্রতিপাদ্য নিয়ে বুধবার থেকে জাতীয় বৃক্ষরোপন অভিযান ও বৃক্ষমেলা শুরু হয়েছে। দেশের বিশাল উপকূলীয় এলাকা সহ দক্ষিণাঞ্চলকে বঙ্গোপসাগর থেকে ধয়ে আসা ঘূর্ণিঝড় থেকে রক্ষায় প্রাকৃতিক ঢাল উপকূলীয় বনভূমি এখন নিজেই ঝুঁকির মুখে। ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড় ‘হেরিকেন’ থেকে শুরু করে সিডর, আইলা, মহাসেন, আম্পান ও ‘ইয়াস এর মত বড় ধরনের ঘূর্ণিঝড় এবং জলোচ্ছ্বাস প্রতিহত করতে দেশের বিশাল উপকূলীয় বন প্রাকৃতিক ঢাল হিসেবে কাজ করছে। কিন্তু ১৯৬৬ সাল থেকে বিশ^ব্যাংক সহ বিভিন্ন দাতা ও সাহায্য সংস্থার অর্থায়ন সহ দেশের নিজস্ব সম্পদে যে প্রায় সোয়া ২ লাখ হেক্টর উপকূলীয় বনভূমি সৃজন করা হয়েছে তার অন্তত ৩০ভাগ ইতোমধ্যে বিনষ্ট ও বেদখল হয়ে গেছে।
এমনকি এসব বনভূমি প্রতিটি ঝড়ঝঞ্ঝায় উপকূলভাগের বিশাল জনগোষ্ঠী সহ সম্পদের সুরক্ষায় প্রাকৃতিক ঢাল এর ভূমিকা পালন করলেও এর উন্নয়ন ও পুনর্বাসনে এখন পর্যন্ত কোন প্রকল্প নেই। বিগত এক যুগেরও বেশী সময় ধরে উপকূলীয় এলাকায় নতুন বন সৃজনে কোন প্রকল্প না থাকায় বিদ্যমান ও ক্ষতিগ্রস্ত বনভূমির স্থায়িত্ব ও টেকসই ধারা অব্যাহত থাকছে না।
এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে, ১৮৭৭ সাল থেকে ২০২৪ সালের মধ্যভাগ পর্যন্ত বঙ্গোপসাগর থেকে অন্তত অর্ধশতাধিক তীব্র ঘূর্ণিঝড় ছাড়াও ৪৯ বার ঘূর্ণিঝড় ও ২০ বার ‘হেরিকেন’ মাত্রার ঘূর্ণিঝড় আমাদের উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হেনেছে। বন বিভাগের একটি দায়িত্বশীল সূত্রের মতে, ২০০৭ সালেল ১৫ নভেম্বর রাতে ২৪৮ কিলোমিটার বেগে ঘূর্ণিঝড় সিডর এর আঘাত প্রতিহত করতে গিয়ে বরিশাল অঞ্চলের উপকূলভাগ সহ মূল ভূ-খন্ডের প্রায় ১ কোটি সরকারি ও বিভিন্ন বসতবাড়ীর গাছপালা বিনষ্ট হয়।
ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ এর আঘাতে উপকূলীয় বনের প্রায় সাড়ে ১১ হাজার হেক্টরের গাছ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঘূর্ণিঝড় ‘আম্পান’এ প্রায় ১২ হাজার হেক্টরের বন বাগান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। আর সবশেষ ২০২৩ সালের মে মাসের ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ এর প্রভাবে সাড়ে ৬ হাজার হেক্টরের ম্যানগ্রাভ বাগান, পৌনে ২শ হেক্টরের স্ট্রীপ, গোলপাতা ও ঝাউ বাগান ছাড়াও নার্সারি সমূহের প্রায় দেড় লাখ চারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
তবে বছর পাঁচেক আগে ১০৪ কোটি টাকার সম্পূর্ণ দেশীয় তহবিলে ‘বঙ্গোপসাগরে জেগে ওঠা চরাঞ্চলে বনায়ন’ নামে একটি প্রকল্পের আওতায় ২৫ হাজার হেক্টরে নতুন বনায়ন সহ এক হাজার কিলোমিটার উপকূলীয় বেড়িবাঁধ ও বিভিন্ন সড়কে বৃক্ষ রোপনের একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে। উপকূলের ১০টি জেলায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন মেয়াদ ১ বছর বৃদ্ধি সহ সোয়া ৩ কোটি টাকা প্রকল্পব্যায় বাড়িয়ে ৪০ হাজার বসতবাড়ী বনায়নের লক্ষ্যে গাছের চারা বিতরন করা হয়।
তবে ‘গ্রীন ক্লাইমেট ফান্ড’এর সহায়তায় উপকূলীয় এলাকায় আরো বনায়নের একটি ‘উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা’ গ্রহণের প্রচেষ্টার কথা শোনা গেলেও তা এখনো আলোর মুখ দেখেনি।
সরকার বঙ্গোসাগরের কোল ঘেষে দেশের ৭১০ কিলোমিটার উপকূলীয় তটরেখার ১৯টি জেলার ৪৮টি উপজেলার ৪৭ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকাকে ‘উপকূলীয় এলাকা’ হিসেবে চিহিৃত করেছে। যা দেশের মোট আয়তনের ৩০%। মোট জনসংখ্যার ২৮% মানুষ এসব ঝুকিপূর্ণ এলাকায় বাস করে। উপক’লীয় এলাকার বিশাল জনগোষ্ঠী সহ সম্পদকে রক্ষায় ১৯৬৬ সাল থেকে যে বনায়ন শুরু হয়, তারই ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় উপকূলভাগে ইতোপূর্বে দুই লক্ষাধীক হেক্টর সরকারি খাস জমিতে ‘লবনাম্বুজ বন বা ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট’ সহ বিভিন্ন ধরনের বনায়ন করা হয়েছে।
কিন্তু বঙ্গোপসাগর থেকে ধেয়ে আসা একের পর এক ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস প্রতিহত করতে গিয়ে উপকূলীয় বনভূমিও অনেকটা ক্ষতবিক্ষত। সিডরের ক্ষতি পূরণের আগেই পরবর্র্তি ৩ বছরে ঘূর্ণিঝড় ‘মহাসেন’ ও ‘আইলা’ উপকূলীয় বন বাগান সহ বিশাল জনপদকে আরো ক্ষতবিক্ষত করে।
বছর পাঁচেক আগে ভারত, ব্রাজিল ও মালয়েশিয়ার কয়েকজন গবেষক সুন্দরবন সহ বরিশাল অঞ্চলের উপকূলীয় বন বাগান পরিদর্শন করে ক্ষয়ক্ষতির ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেন। তাদের গবেষনা ফলাফল আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘এলসেভিয়ায়ের এষ্টুয়ারিন, কোষ্টাল এন্ড সেলফ সায়েন্স জর্নাল’এ প্রকাশিত হয়েছিল। ঐ গবেষনাপত্রে আম্পান সহ সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড়গুলোতে বরিশাল উপকূলীয় অঞ্চলের বনের ক্ষতি ৫৬.১৯ শতাংশ এলাকা বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। এমনকি আম্পানের কারণে উপকূলীয় ম্যানগ্রোভ বা লবনাম্বুজ বনের সব অংশেরই অবনতি সহ ভাঙন দেখা দিয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে তাদের গবেষনা প্রতিবেদনে।
গত কয়েক বছর ধরে দেশের উত্তরাঞ্চল সহ পাশর্^বর্তি ভারতে বৃষ্টির অভাবে উজান থেকে নদ-নদীর প্রবাহ আশংকাজনকভাবে হ্রাসের ফলে সাগরের লবনাক্ত পানি উপকূল থেকে বরিশাল অতিক্রম করে চাঁদপুরে ভাটিতে মেঘনার হিজলা পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে। উপকূলীয় এলাকা ও এর নদ-নদীগুলোতে লবনাক্ততার মাত্রা অতীতের যেকোন সময়ের তুলনায় বেড়ে যাবার কারণেও বনের ক্ষতি হচ্ছে। আবার অনেক চরাঞ্চলে ক্রমাগত পলি পরে ভূমির উচ্চতা বৃদ্ধির ফলেও গাছ পর্যাপ্ত পানি পচ্ছেনা। ফলে এর স্থায়িত্ব ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পলি জমে উপকূলের নদী ও খাল ভরাট হবার কারণেও বনের ইকোসিষ্টেম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
আবার নদী ভাঙনেও প্রতিবছর প্রায় ১৩ হাজার হেক্টর বনভূমি বিলীন হচ্ছে। বনায়নে আর্থিক সহায়তাকারী বিশ^ ব্যাংকের প্রতিবেদনে ১৯৭৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ৩৭ বছরে দেশের উপকূলীয় এলাকায় ১৪৪ বর্গ কিলোমিটার বনভূমি হ্রাস পাবার কথা বলা হয়েছে।
এমনকি একের পর এক ঘূণিঝড়ের ছোবলে দক্ষিণ উপকূল সংলগ্ন বনভূমি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গত দুই দশকে খেপুপাড়া সংলগ্ন উপকূলীয় বনাঞ্চলের প্রায় ৬৪ ভাগ বনভূমি সাগরের ঢেউ সহ ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলেও জনাগেছে। এমনকি ওই এলাকার ইকোপার্ক, নারকেল বাগান ও ঝাউ বাগান সহ লবনাম্বুজ বনের বেশীরভাগ এলাকাই বিলীন হয়েছে।
পাশাপাশি বন বিভাগ জানিয়েছে ইতোমধ্যে সৃজিত বনভূমির কারনে দেশের বিশাল উপকূলীয় এলাকায় অনেক ভূমি উদ্ধারও সম্ভব হয়েছে। অনেক চরাঞ্চল মূল ভু-খন্ডের সাথেও যুক্ত হয়েছে ইতোমধ্যে। তবে পরিবশেবীদদের মতে, ভূ-খন্ড উদ্ধারের চেয়েও সৃজিত বনভূমিম সবচেয়ে বেশী ইতিবাচক ভূমিক রাখছে বঙ্গোপসাগর থেকে ধেয়ে আসা ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের হাত থেকে উপকূলভাগকে রক্ষায়।
এ পর্যন্ত উপকূলীয় এলাকায় যে বনায়ন হয়েছে, তার প্রায় ৯৫ ভাগই ছিল কেওড়া গাছ। কিন্তু দ্রুত বর্ধনশীল হলেও দশ বছর বয়স থেকে কান্ড ছিদ্রকারী পোকার আক্রমনে কেওড়া বাগান মরে যাচ্ছিল। পাশাপাশি উপকূলীয় বাগানে ক্রমাগত পলি জমে ভূমির উচ্চতা বৃদ্ধি সহ অবাধে গবাদিপশুর বিচরনে বনভূমির মাটি শক্ত হয়ে বাগানের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছিল। এ থেকে পরিত্রানে উপকূলীয় এলাকায় কেওড়া’র বিকল্প হিসেবে ‘ছইলা,বাইন, সাদা বাইন, মরিচা বাইন, গেওয়া, সুন্দরী, পশুর, ধুন্দল, সিংড়া, খলসী, কিরপা, গোলপাতা, হেতাল, কাকড়া, গড়ান ও গর্জন’ গাছের চারা উত্তোলন ও আবাদ কৌশল উদ্ভাবন করেছে বাংলাদেশ বন গবেষনা ইনস্টিটিউট। তবে সাম্প্রতিককালে কেওড়া গাছের কান্ড ছিদ্রকারী ‘স্টেম বোরার’ পোকার আক্রমন প্রকৃতিকভাবেই অনেকটা স্থমিত হয়েছে বলেও গবেষকরা জানিয়েছেন।
এসব ব্যাপারে বন অধিদপ্তরের বরিশাল কোষ্টাল সার্কেলের বন সংরক্ষক বলেন, বনভূমির ক্ষয়ক্ষতি পুনর্বাসন সহ নতুন বনায়নে অপাতত কোন প্রকল্প বা কর্মসূচী না থাকলেও আমরা যতটা সম্ভব ক্ষতি মেরামতের চেষ্টা করে যাচ্ছি।