2:53 pm , June 14, 2025

বিশেষ প্রতিবেদক ॥ কর্মস্থলমুখি মানুষের ভীড়ে পা রাখার জায়গা নেই বরিশালের নৌ ও বাস টার্মিনালে। আজ রোববার ঈদ উল আযহা পরবর্তি প্রথম কর্মদিবসের আগেই কর্মস্থলে ফিরতে শুরু করেছেন অনেকেই। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বরিশাল নদীবন্দর থেকে গত কয়েকদিন ধরেই ৮-১০টি লঞ্চ ধারণ ক্ষমতার ২ থেকে ৩গুন যাত্রী নিয়ে ঢাকায় যাচ্ছে। আরো কয়েকটি নৌযান বরিশাল ঘাট দিয়ে চাঁদপুর হয়ে ঢাকায় পৌছছে। অনেকে চাঁদপুর হয়ে সেখান থেকে ট্রেনে করে চট্টগ্রামে যাচ্ছেন। বিপুল সংখ্যক যাত্রী বরিশাল থেকে নৌপথে ইলিশাঘাট হয়ে মজুচৌধুরীর হাট পৌঁছে সেখান থেকে সড়ক পথে চট্টগ্রাম অঞ্চলে যাচ্ছেন। সব মিলিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের প্রতিটি নৌপথেই জন¯্রােত।
ঈদের আগের ৫ দিন ঢাকা থেকে প্রতিদিন ৫-৭টি বেসরকারী নৌযানে বিপুল সংখ্যক মানুষ বরিশালে আসেন ঈদ করতে। এসময় ৯-১০টি নৌযান প্রতিদিন ডাবল ট্রিপ দিয়েছে।
তবে স্বাধীনতার ৫৪ বছর পর এবারই প্রথম রাষ্ট্রীয় নৌ-বানিজ্য প্রতিষ্ঠান বিআইডব্লিউটিসি রাজধানী ঢাকা এবং চট্টগ্রাম বন্দর সহ দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের সাথে বরিশাল অঞ্চলের কোন যাত্রীবাহী স্টিমার সার্ভিস পরিচালন করেনি। রাষ্ট্রীয় সড়ক পরিবহন সংস্থা বিআরটিসি’ও তার পুরনো কিছু যাত্রীবাহী বাসের সাহায্যে সম্ভব সর্বোচ্চ ট্রিপে যাত্রী পরিবহন করলেও তা ঈদ কেন্দ্রীক যাত্রীদের খুব বেশী উপকারে আসেনি। ফলে বরিশাল অঞ্চলের মানুষ বেসরকারী সড়ক ও নৌপরিবহন সেক্টরের মর্জির ওপরই নির্ভরশীল আছে। জাতীয় পতাকাবাহী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ঈদের আগে পরে ব্যাপক জন চাহিদার মধ্যেও স্বেচ্ছা অন্ধত্বেই ভুগছে।
২০২২ সালের জুনে পদ্মা সেতু চালুর পর থেকে রাজধানীর সাথে বরিশাল সহ দক্ষিণাঞ্চলের নৌ যোগাযোগের গুরুত্ব অনেকটাই কমে আসে। অনেকে নৌপথের ওপর থেকে মুখ ফিরিয়ে সড়ক পথমুখি হয়। ফলে একের পর এক বিলাসবহুল নৌযান বন্ধ হয়ে যায়। অনেক নৌযান স্ক্র্যাপ হিসেবে বিক্রীও হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। কোন কোন নৌযানের মালিক ব্যাংকের দেনা শোধ করতে গিয়ে যেমনি পথে বসে গেছেন, তেমনি নৌপথের ওপর নির্ভরশীল অন্তত ৫০ হাজার কর্মজীবি ও শ্রমিক বেকার হয়ে গেছেন। শুধু বরিশাল-ঢাকা নৌপথে রুট পারমিটধারী প্রায় ২৯টি নৌযানের মধ্যে এখন ১০টির কোন হদিস নেই।
তবে ঢাকা সহ দেশের পূর্ব, পূর্ব-উত্তর ও দক্ষিণ-পূর্বের সাথে বরিশাল সহ দক্ষিণাঞ্চলের সড়ক যোগাযোগ রক্ষাকারী বরিশাল-ভাঙ্গা ৯১ কিলোমিটার অপ্রশস্ত মহাসড়কটি অতিক্রমে এখন ৪ ঘন্টা সময় লাগছে। ১৮-২৪ ফুট প্রশস্ত ঐ মহাসড়কের তুলনায় যানবাহনের আধিক্য যাত্রীদের দুর্ভোগের সাথে নিরাপত্তাও বিঘিœত করছে। মহাসড়কটির দুপাশের অবৈধ দখলদাররা যানবাহনের নির্বিঘœ চলাচলকে বাধাগ্রস্ত করছে। ফলে ঈদের আগে ও পরের বাড়তি যানবাহনের চাপে গত দিন দশেক ধরে এ মহাসড়কটিতে দুর্ঘটনা নিত্যকার ঘটনায় পরিনত হয়েছে। গত সপ্তাহ জুড়েই বরিশাল-ফরিদপুর মহসড়কটির বরিশাল-ভূরঘাটা ও ভূরঘাটা-ভাঙ্গা অংশে বারবারই দুর্ঘটনায় সড়ক যোগাযোগ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে । প্রতিদিনই মহাসড়কে ৩-৪ ঘন্টা পর্যন্ত যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকছে।
তবে বিগত দুটি ঈদকে কেন্দ্র করে বরিশাল সহ সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলজুড়ে সাধারন মানুষ কর্মস্থলে ফিরতে নৌযানকেই নিরাপদ ও তুলনামূলকভাবে ব্যায় সাশ্রয়ী সহ নির্বিঘেœ গন্তব্যে পৌছার নির্ভরযোগ্য বাহন মনে করছেন। ঈদের আগে পরের স্বল্পতম সময়ে ১০ লাখ যাত্রী বহনের সক্ষমতা দেশের কোন সড়ক পথের নেই ।
ফলে সবার কাছেই নৌপথই প্রধান এবং নির্ভরযোগ্য ও অপরিহার্য অবলম্বন। তবে নৌপথে এখনো বেশকিছু বিড়ম্বনা যাত্রী সাধারনের দুর্ভোগ বৃদ্ধি করছে। বিশেষ করে ঢাকার যেকোন প্রান্ত থেকে সদরঘাটে পৌঁছার বিড়ম্বনা এখনো যাত্রী সাধারণকে নৌপথে ভ্রমণে অনাগ্রহী করছে। বরিশাল থেকে নৌযানগুলো প্রত্যুষে ঢাকা পৌছে যাত্রীদের নামিয়ে দেয়ার পরেই পুরো সদরঘাট এলাকায় নারী-পুরুষ ও শিশুরা চরম বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন।
এরসাথে বরিশাল ও ঢাকার সদরঘাট নৌ টার্মিনালে ব্যাগেজ নিয়েও ঘাট শ্রমিকদের অত্যাচারে প্রতিনিয়ত হেনস্থা হতে হচ্ছে যাত্রীদের। বরিশাল ও ঢাকার নৌ টার্মিনাল দুটিতে গাড়ী পার্কিং থেকে শুরু করে যাত্রীদের ন্যূনতম কোন সুযোগ সুবিধা নেই। এসব টার্মিনালে অসুস্থ রোগীদের পরিবহনে কোন সচল স্ট্রেচার ও হুইল চেয়ার পর্যন্ত নেই। পাশাপশি বরিশাল টার্মিনালের গ্যাংওয়ে এবং অভ্যন্তরীণ রাস্তাঘাট ছাড়াও গাড়ী পার্কিং সহ নানা অব্যবস্থাপনায় ভোগান্তি শুধু বাড়ছে। যা যাত্রীদের নৌপথে ভ্রমনে নিরুৎসাহিত করছে। এরসাথে যুক্ত হয়েছে টার্মিনাল ফি। রেল ভ্রমনে যেখানে যাত্রীদের কোন টার্মিনাল ফি দিতে হয়না, সেখানে নৌ টার্মিনালে প্রবেশ করতেই যাত্রীপ্রতি টার্মিনাল ফি এখন ১০ টাকা। যা পদ্মা সেতু চালুর আগে ছিল ৫টাকা।
অপরদিকে বিপুল সম্ভাবনা ও নির্ভরতার নৌপথে রাষ্ট্রীয় নৌ-বানিজ্য প্রতিষ্ঠান বিআইডব্লিউটিসি’র অবহেলা ও উদাসীনতাও সাধারন মানুষকে নৌপথ বিমুখ করে তুলছে। ‘জনগণের নিরাপদ নৌভ্রমণ নিশ্চিত করার দায়িত্ব নিয়ে গঠিত রাষ্ট্রীয় নৌ-বানিজ্য প্রতিষ্ঠানটির কাছে ৭টি যাত্রীবাহী নৌযান থাকার পরেও গত কয়েকটি বছর ধরে সংস্থাটি রাজধানীর সাথে দক্ষিণাঞ্চলের নিরাপদ যাত্রী পরিবহনে চরম উদাসীন।
দক্ষিণাঞ্চলের নিরাপদ যোগাযোগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নৌ পরিবহনের হৃত গৌরব ফিরিয়ে আনতে বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণের তাগিদ দিয়েছেন সবাই।
একইসাথে বরিশাল-ফরিদপুর-ঢাকা জাতীয় মহাড়কটির বরিশাল-ভাঙ্গা অংশ ৬ লেনে উন্নীতকরণের প্রকল্পটি দ্রুত বাস্তবায়ন সহ প্রস্তাবিত বরিশাল-ভাঙ্গা রেলপথ নির্মান ও বরিশাল সেক্টরে নিয়মিত বিমান ফ্লাইট পুনর্বহালের দাবী জানান হয়েছে সর্ব মহল থেকে।