4:05 pm , May 25, 2025

বিশেষ প্রতিবেদক ॥ সদ্য সমাপ্ত রবি মৌসুমে দেশে গমের আবাদ ও উৎপাদন লক্ষ্য অর্জিত হয়নি। এমনকি তা পূর্বের ৪টি রবি মৌসুমের তুলনায় অনেকটা পিছিয়ে। ২০১৭ সালে ব্লাষ্ট সংক্রমন পরবর্তি সময় থেকে গতবছর পর্যন্ত গমের আবাদ ও উৎপাদন কিছুটা আশার আলো দেখালেও সদ্যসমাপ্ত রবি মৌসুমে পরিস্থিতি অনেকটাই পাল্টে গেছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল মহল বলছে, গত মৌসুমে বোরো আবাদ বৃদ্ধির ফলে গমের আবাদ কিছু হ্রাস পেলেও আগামী বছরগুলোতে পরিস্থিতি উন্নতির লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তর-ডিএই’র চূড়ান্ত হিসেবে সদ্যসমাপ্ত রবি মৌসুমে দেশে ৩ লাখ ১৫ হাজার ২শ হেক্টর জমিতে গম আবাদ লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে প্রকৃত আবাদ ছিল ২ লাখ ৮৭ হাজার ৪শ হেক্টরে। যা লক্ষ্যমাত্রার ৯১.১৮%। ফলে ১২ লাখ ৩৫ হাজার টন উৎপাদন লক্ষ্যের বিপরীতে গত রবি মৌসুমে দেশে গম উৎপাদনের পরিমান ছিল ১১ লাখ ৯ হাজার ৩৬৪ টন। যা প্রকৃত লক্ষ্যমাত্রা থেকে ১ লাখ ২৫ হাজার ৬৩৬ টন পিছিয়ে। গত বছর দেশে ৩ লাখ ১৬ হাজার হেক্টরে ১১ লাখ ৭২ হাজার টন গম উৎপাদন হয়। যা ২০২২-২৩’এ ছিল ৩.১৬ হাজার হেক্টরে ১১.৭০ লাখ টন। ২০২১-২২’এ ছিল ৩.১৪ লাখ হেক্টরে ১০.৮৫ লাখ টন এবং ২০২০-২১’এ ৩.২৮ লাখ হেক্টরে ১০.৮৫ লাখ টন। তবে সদ্য সমাপ্ত রবি মৌসুমে দেশে গমের ফলন সামান্য বেড়ে হেক্টর প্রতি ৩.৮৬টনে উন্নীত হয়েছে। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে দশমিক ১টন বেশী। ২০২৩-২৪’এ দেশে গমের গড় ফলন ছিল হেক্টর প্রতি ৩.৭৬ টন।
বরিশাল কৃষি অঞ্চলেও এবার গমের আবাদ কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। বিদায়ী রবি মৌসুমে বরিশাল কৃষি অঞ্চলে ৫৫ হাজার ৩৫০ হেক্টরে ১ লাখ ৮২ হাজার ৫৭৫ টন গম উৎপাদন হয়েছে। যা আগের বছর ছিল ৫৮ হাজার ১৫৮ হেক্টর। উৎপাদন ছিল ১ লাখ ৯৩ হাজার ৫শ টনের মত। গড় ফলন ছিল ৩.৩৪ টন। সদ্য সমপ্ত রবি মৌসুমেও গড় ফলন গত বছরের প্রায় সমানই ছিল তবে জাতীয় পর্যায়ে তা গত বছরের চেয়ে দশমিক ১০ ভাগ বেশী ছিল।
কম শীত প্রধান আমাদের দেশে গম আবাদের ইতিহাস খুব বেশী দিনের না হলেও ‘দানাদার খাদ্য ফসল’ হিসেবে তা ইতোমধ্যেই তৃতীয় শীর্ষস্থান দখল করেছে। গম উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান সারাবিশে^ প্রথম ২০টি দেশের মধ্যে।
‘কৃষি গবেষনা ইনস্টিটিউট-বারি’ ও ‘গম গবেষনা ইনস্টিটিউট’এর বিজ্ঞানীরা ইতোমধ্যে উচ্চ ফলনশীল ও পরিবেশ উপযোগী একাধীক গম-এর উন্নত জাত উদ্ভাবন করেছেন। এমনকি ছত্রাকবাহী ‘ব্লাষ্ট’ প্রতিরোধী জাতের গম বীজ এবং আমাদের দেশের মত কম শীত প্রধান অঞ্চলের জন্য ‘শতাব্দী’ নামের গম বীজ উদ্ভাবন করেছেন বারি’র বিজ্ঞানীরা। বারি উদ্ভাবিত গম বীজের মধ্যে ‘কাঞ্চন, আকবর, অঘ্রানী, শতাব্দী’ ছাড়াও ‘সৌরভ-বারি-১৯ ও গৌরব-বারি-২০’ নামের উচ্চ ফলনশীল গম বীজও উদ্ভাবন করা হয়েছে। এসব বীজ থেকে হেক্টর প্রতি সাড়ে ৪ টন পর্যন্ত গম উৎপাদন সম্ভব বলে ‘বারি’র দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে। এছাড়া গম গবেষনা ইনস্টিটিউট-এর বিজ্ঞানীরাও আরো একাধীক উচ্চ ফলনশীল গম বীজ উদ্ভাবন করেছেন।
তবে ২০১৭ সালে দেশের ৫টি জেলায় ছত্রাকবাহী রোগ ‘ব্লাষ্ট’এর সংক্রমনের পরে সরকার গমের আবাদ ও উৎপাদন কিছুটা নিরুসাহিত করে। ফলে অত্যন্ত সম্ভবনাময় এ দানাদার খাদ্য ফসলের ভবিষ্যত নিয়ে কিছুটা অনিশ্চয়তা তৈরী হয়। এমনকি ব্যায় সাশ্রয়ী এ খাদ্য ফসলের ভাল দাম পেয়ে কৃষকরা আশার আলো দেখলেও তা নিয়ে নতুন শংকা তৈরী করে ছত্রাকবাহী রোগ ‘ব্লাষ্ট’।
নদ-নদীবহুল বরিশাল অঞ্চলের মাটিও গম আবাদের জন্য যথেষ্ট উপযোগী। তবে আশার কথা, ২০১৭ সালের পরে বরিশাল কৃষি অঞ্চল সহ দেশের কোথাও ব্লাষ্ট-এর সংক্রমন না থাকায় কৃষি যোদ্ধারা আবার আশাবাদী হয়ে গম আবাদে মনোনিবেশ করছে বলে ডিএই’র দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে। ফলে গত বছর রবি মৌসুমে সারাদেশের মত বরিশাল কৃষি অঞ্চলেও গম আবাদ ও উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।
তবে দেশে এখনো গমের মোট আবাদ ৫ লাখ হেক্টরে উন্নীত করতে না পারাকে হতাশাব্যাঞ্জক বলে মনে করছেন কৃষিবীদরা। এ লক্ষ্যে কৃষক পর্যায়ে উন্নত বীজ ও আবাদ প্রযুক্তি হস্তান্তরের মাধ্যমে গমের গড় উৎপাদন হেক্টর প্রতি ন্যূনতম ৪ টনে উন্নীত করার লক্ষ্যে ‘নিবিড় কর্মসূচী’ গ্রহণের তাগিদ দিয়েছেন মাঠ পর্যায়ের কৃষিবীদরা। পাশাপাশি ‘আবাদ অন্তত ৫ লাখ হেক্টরে উন্নীত করে দেশে গমের মোট উৎপাদনও ২০ লাখ টনে নিয়ে যাওয়া খুব কঠিন নয়’ বলে মনে করছেন মাঠ পর্যায়ের কৃষিবীদরা।
এক্ষেত্রে বরিশাল কৃষি অঞ্চলেও আবাদ অন্তত দ্বিগুন করার সুযোগকে কাজে লাগাতে পরামর্শ দিয়েছেন কৃষিবীদরা। তাদের মতে, এখনো গমের উচ্চ ফলনশীল ও উন্নতবীজ সহ এর আবাদপ্রযুক্তি মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের কাছে যথাযথভাবে পৌঁছছে না। এ বিষয়গুলো নিশ্চিত করার পাশাপাশি গম অবাদে প্রনোদনা সহ ন্যায্যদাম নিশ্চিত করার দাবী কৃষকদের। এতে বরিশালের কৃষকরাও গম আবাদ ও উৎপাদনে আগ্রহী হবেন।
বরিশাল অঞ্চলে রবি মৌসুমে অনাবাদী বিপুল পরিমান জমির একটি অংশকে গম আবাদের আওতায় আনার সুযোগকে কাজে লাগানোরও তাগিদ দিয়েছেন অনেকে।