3:02 pm , May 11, 2025

বিশেষ প্রতিবেদক ॥ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বৃষ্টিপাতের ঘাটতির সাথে তাপমাত্রার পারদ লাগাতার স্বাভাবিকের ওপরে অবস্থানের পাশাপাশি সীমান্তের ওপারে উজানে নদ-নদীর প্রবাহ নিয়ন্ত্রনে নাব্যতা সংকট বৃদ্ধি সহ শিল্প ও মনুষ্য বর্জ্য অপসারণের ফলে এবার উপকূলভাগে ইলিশের বিচরন আশংকাজনকহারে কম লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এরফলে ইলিশ উপকূল অভ্যন্তর সহ অভ্যন্তরীণ নদ-নদীর পরিবর্তে গভীর সমুদ্রে চলে যাবার শংকার কথা বলেছেন অনেকে। এমনকি প্রকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট নানা বিরূপ পরিস্থিতির কারণেই ইলিশের উৎপাদন আগের অর্থ বছরের ৫.৭১ লাখ থেকে গত অর্থ বছরে প্রায় ৪২ হাজার টন হ্রাস পেয়ে ৫.২৯ লাখ টনে স্থির ছিলো।
মৎস্য অধিদপ্তরের মতে, দেশে উৎপাদিত ও আহরিত ইলিশের ৭০ভাগই বরিশালে। মৎস্য গবেষনা ইনস্টিটিউট এবং পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের গবেষকদের মতে, অত্যন্ত সম্ভাবনাময় ইলিশ উৎপাদনে ভবিষ্যতে পরিবেশ ও প্রাকৃতিক নানা সমস্যা বিরূপ পরিস্থিতি তৈরী করতে পারে’। মনুষ্য সৃষ্ট নানামুখি বিরূপ প্রভাবের সাথে গত কয়েক বছর ধরে গ্রীষ্মের শুরু থেকেই স্বাভাবিকের বেশী তাপপ্রবাহ ইলিশের ইতোপূর্বের বিচরন স্থল সহ গতিপথ ও আবাস্থলের কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ফলে অবস্থান পরিবর্তনের ফলে উপকূল অভ্যন্তর সহ অভ্যন্তরীণ বিচরনস্থল গুলোতে এবার ইলিশের উপস্থিতি আশংকাজনক হারে কম থাকায় আহরণ ঘাটতির ফলে বাজারেও বিরূপ প্রভাব লক্ষ্যনীয়।
মৎস্য গবেষনা ইনস্টিটিউট-এর একাধিক বিজ্ঞানীর মতে, ইলিশ বিচরণের জন্য যেখানে অভ্যন্তরীন নদ-নদীর পানির তাপমাত্রা ২৮-৩০ ডিগ্রী সেলসিয়াস থাকা প্রয়োজন, সেখানে তা ৩৪-৩৫ ডিগ্রী অতিক্রম করছে। রোববার বরিশালে তাপমাত্রার পারদ স্বাভাবিকের ৫.৩ ডিগ্রী বেশী, ৩৮.৩ ডিগ্রীতে উঠে যায়। এদিন সর্বনি¤œ তাপমাত্রা ছিল ২৭.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস। যা ছিল স্বাভাবিকের ২.৫ ডিগ্রী ওপরে। মূলত লাগতার বৃষ্টির ঘাটতি স্থলভাগের সাথে নদ-নদীর পানির তাপমাত্রাকেও বৃদ্ধি করছে। অত্যাধিক তাপ প্রবাহে জেলেরা মাছ ধরতে নদীতেও নামতে পারছে না। সাথে সীমান্তের ওপারে উজানে প্রবাহ নিয়ন্ত্রনের ফলে দক্ষিণাঞ্চলের নদ-নদীর তলদেশ ভরাট করে পানির তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে আরো তরান্বিত করছে। এরসাথে অতিমাত্রায় শিল্প ও মনুষ্যবর্জ্য অভ্যন্তরীণ নদ-নদীতে অত্যন্ত স্পর্শকাতর মাছ ইলিশের বিচরনকে নিরুৎসাহিত করছে।
মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, এবার গত কয়েকমাস ধরে বৃষ্টিপাতের ঘাটতি সহ জীব বৈচিত্রের নানা পরিবর্তনের সাথে ‘হাইড্রো-মেট্রোলজিক্যাল’ নানা সমস্যায় ইলিশের বিচরনস্থল পরিবর্তন হচ্ছে। ইতোপূর্বে খেপুপাড়া, গলাচিপা, রাঙ্গাবালি, মনপুরা,ঢালচর, চরকুকরী-মুকরি, চর কচ্ছপিয়া ও সংলগ্ন এলাকায় ইলিশের মূল বিচরনস্থলে উপস্থিতি এবার লক্ষ্যণীয় মাত্রায় কম। উজানে কালাবদরের শ্রীপুর,লাহারহাট, মেঘনার ইলিশা ও হিজলাতেও একই পরিস্থিতি। এর পেছনে উজানে পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রনের সাথে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের অভাবে পদ্মা-মেঘনা ও এর শাখা নদ-নদীগুলোতে তাপমাত্রা বৃদ্ধি সহ প্রবাহ হ্রাস এবং পানির দূষনও কাজ করছে বলে মৎস্য বিজ্ঞানীরা মনে করছেন।
মৎস্য গবেষনা ইনস্টিটিউট-এর জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী ড. আশরাফুল আলমের মতে, অতিমাত্রায় শিল্প ও মনুষ্য বর্জ্য অপসারণের ফলে নদ-নদীতে ইলিশের প্রধান খাবার ফাইটো প্লাঙ্কটন ও জু-প্লাঙ্কটনের ঘাটতি অতীতের যেকোন সময়ের তুলনায় প্রকট আকার ধারন করেছে। তারমতে, যেখানে প্রতি লিটার পানিতে ফাইটো প্লাঙ্কটন ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার থাকার কথা, সেখানে তা দেড় হাজারের নিচে এবং জিও প্লাঙ্কটন ১৫শর স্থলে কোন কোন নদীতে ২-৩শতে নেমে এসেছে। ফলে খাবারের অভাবেও ইলিশ সাগর উপকূল অতিক্রম করে অভ্যন্তরীণ নদ-নদীতে আসছেনা।
মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, সীমান্তের ওপার হয়ে উজানের সব নদ-নদীর প্রায় ৭০ ভাগ পানি মেঘনা ও এর শাখা নদী দিয়ে বঙ্গোপসাগরে প্রবাহিত হয়। কিন্তু সীমান্তের ওপারে বিবেকহীন নিয়ন্ত্রনে প্রবাহ যেমনি বাধা গ্রস্ত হচ্ছে, তেমনি শিল্প ও মনুষ্য বর্জ্যরে কারণে দূষনের মাত্রাও ক্রমশ বাড়ছে। পাশাপাশি গত কয়েক বছর ধরে অতিরিক্ত তাপ প্রবাহের ফলেও ভরা বর্ষা ছাড়া ইলিশ সাগর থেকে নদীমুখি হচ্ছে না।
জীবনচক্রে অভিপ্রয়াণী মাছ ইলিশ স্বাদু পানি থেকে সমুদ্রের নোনা পানিতে এবং সেখান থেকে পুনরায় স্বাদু পানিতে অভিপ্রয়াণ করে। পূর্ণাঙ্গ ইলিশ প্রতিদিন ¯্রােতের বিপরিতে ৭১ কিলোমিটার পর্যন্ত ছুটে চলে উপকূলের প্রায় সাড়ে ৭ হাজার বর্গ কিলোমিটারের মূল প্রজনন ক্ষেত্রে মুক্তভাবে ভাসমান ডিম ছাড়ার পরে তা থেকে ফুটে বের হয়ে ইলিশের লার্ভা স্বাদু পানি ও নোনা পানির নার্সারী ক্ষেত্রসমূহে বিচরন করে। এরা খাবার খেয়ে নার্সারী ক্ষেত্রসমূহে ৭Ñ১০ সপ্তাহ ভেসে বেড়িয়ে জাটকা হিসেব কিছুটা বড় হয়ে সমুদ্রে গিয়ে পরিপক্কতা অর্জন করে। বঙ্গোপসাগরের বিভিন্ন এলাকায় ১২Ñ১৮ মাস অবস্থানে প্রজননক্ষম হয়ে ইলিশ আবার স্বাদু পানির নার্সারী ক্ষেত্রে ফিরে এসে ডিম ছাড়ে।
কিন্তু  বৃষ্টির অভাবে তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে প্রবাহ হ্রাসে নদ-নদীর তলদেশ ভরাটে পানির উষ্ণতা ক্রমাগত বৃদ্ধির ফলে সাম্প্রতিককালে উপকূল অভ্যন্তর সহ অভ্যন্তরীণ নদ-নদীতে বিচরনে ইলিশ ক্রমাগত নিরুৎসাহিত হচ্ছে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করছেন।
এবার গত নভেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত কোন বৃষ্টি হয়নি বরিশালে। এপ্রিলে কিছু বৃষ্টি হলেও তা ছিল স্বাভাবিকের প্রায় ৪৫% কম। আবহাওয়া বিভাগ মে মাসে ২৪৫-৩১০মিলিমিটার বৃষ্টিপাতের কথা বললেও মাসের প্রথম ১০ দিনে কোন বৃষ্টি হয়নি বরিশালে।
অপরদিকে, বরিশালের হিজলা সংলগ্ন মেঘনার উজানে চাঁদপুর থেকে সাগর মোহনা পর্যন্ত দেড়শর’ও বেশী ডুবোচর সৃষ্টি হয়েছে বলে উল্লেখ করে মৎস্যগবেষনা ইনস্টিটিউট’এর আশরাফুর আলম জানান, ‘এরফলে ইলিশের গতিপথ রুদ্ধ হচ্ছে। আবার যেখানে নদীর গভীরতা বেশী সেখানে নৌপথের মূল চ্যানেল হওয়ায় জেলেরা জাল ফেলতে পারছে না’। তবে গত কয়েক মাসের ঘাটতির পর মূল বর্ষা মৌসুমে স্বাভাবিক বৃষ্টি হলে, তা ইলিশ সহ উম্মুক্ত জলাশয়ের মাছের জন্য ইতিবাচক ফল দেবে।
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যলয়ের মৎস্য অনুষদের অধ্যাপক ড. সাজেদুল ইসলাম বলেন ‘ইলিশের বংশ বিস্তারে অবাধ বিচরন ও নিরাপদ প্রজনন নিশ্চিত করণে, নদ-নদীর সুষ্ঠু প্রবাহ নিশ্চিত করা সহ দূষন রোধের পাশাপাশি হাইড্রো-মেট্রোলজিক্যাল বিষয়গুলোর প্রতি নজরদারী দরকার।