4:28 pm , May 8, 2025

বিশেষ প্রতিবেদক ॥ ভূমি অধিগ্রহণে তিনগুন ব্যায় বৃদ্ধির কারণে রাজধানী সহ সারা দেশের সাথে বরিশাল অঞ্চলের সড়ক যোগাযোগের মূল সেতুবন্ধন ৮ নম্বর জাতীয় মহাসড়কটি ৬ লেনে উন্নীতকরন প্রকল্পটি আপাতত বরিশাল সীমান্ত পর্যন্ত সীমিতকরণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। অর্থ বরাদ্দ থাকার পরেও নানা জটিলতায় নির্ধারিত সময়ের ৩ বছর পরেও ভূমি অধিগ্রহন সম্ভব না হওয়ায় ৩গুন ব্যায় বৃদ্ধির প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে আটকে যাবার পরে বুধবার একনেক বৈঠকে পূর্বের বরাদ্দকৃত ১,৮৫৭ কোটি টাকা ব্যায় ঠিক রেখে প্রাথমিকভাবে ফরিদপুর থেকে বরিশাল হয়ে লেবুখালীর পায়রা সেতু পর্যন্ত ভূমি হুকুম দখলের প্রস্তাবনা অনুমোদন করে ২০২৬ সালের ৩০ জুনের মধ্যে তা সম্পন্ন করতে বলা হয়েছে।
ইতোপূর্বে ১,৮৫৭ কোটি টাকার ভূমি অধিগ্রহন প্রকল্প-প্রস্তাবটি প্রায় সাড়ে ৬ হাজার কোটিতে উন্নীত করার প্রস্তাবনা একনেক-এর সভায় উপস্থাপনের কথা থাকলেও পরিকল্পনা কমিশন তা অনুমোদন করেনি। পরিকল্পনা উপদেষ্টা পূর্বেও বরাদ্দকৃত ব্যায়ের মধ্যেই আপাতত ফরিদপুর থেকে বরিশাল হয়ে লেবুখালী পর্যন্ত সীমিত করার সিদ্ধান্ত প্রদান করেন। এ প্রেক্ষিতে বুধবার একনেক-এর সভায় তা অনুমোদন দেয়া হয়েছে।
ভূমি অধিগ্রহনে নতুন সিদ্ধান্তের ফলে ফরিদপুর থেকে বরিশাল মহানগরীর অদূরে গড়িয়ার পাড় পর্যন্ত এবং দপদপিয়া সেতুর পাড় হয়ে জিরো পয়েন্ট থেকে লেবুখালীতে পায়রা সেতু পর্যন্ত ৬ লেন মহাসড়ক প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহন আগামী বছরের ৩০ জুনের মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে। এলক্ষ্যে সব প্রস্তুতি ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে বলে বরিশাল সড়ক জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী জানিয়েছেন। তারমতে নতুন সময় অনুযায়ী ভূমি অধিগ্রহন সম্ভব হবে। তবে বুধবার একনেক সভায় অনুমোদিত ডিপিপি’তে ১৬ কিলোমিটার বরিশাল বাইপাস নির্মানের ভূমি অধিগ্রহনও বাদ দেয়া হয়েছে। পরবর্তিতে মহাসড়টির বরিশাল বইপাস সহ পটুয়াখালী-পায়রা বন্দর হয়ে কুয়াকাটা অংশের ভূমি অধিগ্রহনের প্রক্রিয়া শুরু করা সম্ভব হবে বলে আশা করছেন কর্তৃপক্ষ।
উল্লেখ্য,বরিশাল-ফরিদপুর ও বরিশাল-পটুয়াখালী-পায়রাবন্দর-কুয়াকাটা মহাসড়কটির ওপরই সারা দেশের সাথে দক্ষিণাঞ্চলের ১১টি জেলার সড়ক পরিবহন নির্ভরশীল। প্রায় ৫৫ হাজার কোটি টাকা ব্যায়ে নির্মিত ‘পদ্মা সেতু ও সংযুক্ত এক্সপ্রেসওয়ে’র সুফলও নির্ভর করছে ফরিদপুর-বরিশাল-পায়রা-কুয়াকাটা জাতীয় মহাসড়কটির উন্নয়নের ওপর। ২০২২-এর জুনে পদ্মা সেতু চালু হবার পরে বরিশাল অঞ্চলের জাতীয় এ মহাসড়কটি ও আঞ্চলিক মহাসড়কগুলোতে যানবাহনের বাড়তি চাপ ইতোমধ্যে দুর্ঘটনার সংখ্যা বৃদ্ধি সহ নানা বিড়ম্বনার সৃষ্টি করছে। এমনকি বাড়তি যানবাহনের কারণে এ মহাসড়কের ভাঙ্গা থেকে বরিশাল পর্যন্ত ৯১ কিলোমিটার মহাসড়কে যানবাহনের গতি এখন অনেক ধীর। ফলে আগের চেয়ে বাড়তি সময় লাগছে। দক্ষিণাঞ্চলের ৬ জেলার মানুষ এখনো পদ্মা সেতুর সুফল থেকে বঞ্চিত।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় ২০১৫ থেকে ’১৮ সালে ২১১ কিলোমিটার দীর্ঘ বরিশাল-ফরিদপুর ও বরিশাল-পায়রা-কুয়াকাটা জাতীয় মহাড়কটি ৬ লেনে উন্নীতকরণের লক্ষ্যে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা সহ পথনকশা তৈরী করা হয়। পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সুপারিশ ও সমীক্ষার পথনকশা অনুযায়ী প্রায় সাড়ে ৩ হাজার হেক্টর ভূমি অধিগ্রহনে ১,৮৫৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়ে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারীতে একটি আলাদা প্রকল্প অনুমোদন করা হয়। ঐ প্রকল্পের আওতায় ২০২১ সালের জুনের মধ্যে ভূমি অধিগ্রহনের কাজটি শেষ করার কথা থাকলেও ২০২৫ সালের জুন চলে এলেও চাহিদার অর্ধেকের বেশী ভূমি অধিগ্রহন সম্পন্ন হয়নি। ইতোমধ্যে জমির দামও প্রায় ৩গুন বেড়েছে। ফলে অধিগ্রহনকৃত জমির মূল্য পরিশোধে বাড়তি টাকার প্রয়োজন হচ্ছে বলে জানা গেছে।
অপরদিকে বাস্তবতার আলোকে বরিশাল মহানগরীর পরিবর্তে প্রায় ১৬ কিলোমিটার বাইপাস নির্মানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ায় বাড়তি প্রায় ২শ হেক্টর জমি অধিগ্রহন করতে হচ্ছে। পটুয়াখালীতেও পথনকশায় কিছু পরিবর্তন সহ বরিশাল বিমানবন্দর ডাইভার্শন ও ফরিদপুরে একটি প্রতিবন্ধি স্কুলের পুনর্বাসনেও অতরিক্ত অর্থ ব্যায় হবে। সব মিলিয়ে আরো অন্তত ২শ হেক্টর বাড়তি ভূমি অধিগ্রহন সহ মূল্য বৃদ্ধির ফলে অধিগ্রহনে ইতোমধ্যে ১,৮৫৭ কোটি টাকার প্রকল্প ব্যায় সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকার প্রাক্কলন করা হয়েছে।
তবে এপর্যন্ত বরিশাল সড়ক বিভাগের প্রায় ৩৫ কিলোমিটার ও মাদারীপুর অংশে মাত্র ১০ কিলোমিটার অংশে ভূমি অধিগ্রহন সম্পন্ন হয়েছে বলে জানা গেছে। ইতোমধ্যে অধিগ্রহনকৃত ভূমির অর্থ পরিশোধ হলেও গত অর্থবছরে অধিগ্রহন বাবদ বরাদ্দকৃত ৮৯০ কোটি টাকার পুরোটাই ফেরত গেছে বলে জানা গেছে।
সড়ক অধিদপ্তরের বরিশাল জোনের দায়িত্বশীল মহলের মতে ভূমি অধিগ্রহন একটি জটিল বিষয় হলেও এত দীর্ঘ সময় ব্যায় হওয়া উচিৎ ছিল না। তাদের মতে ৬টি জেলা প্রশাসন এ ভূমি অধিগ্রহনের সাথে জড়িত। বিভিন্ন জেলা প্রশাসনের ল্যান্ড এক্যুইজিশন দপ্তর সংশ্লিষ্টদের অবহেলা ও উদাসীনতার কারণেও অনেক কিছু পিছিয়ে গেছে।
অপরদিকে এডিপি’র অর্থে ২০১৫ থেকে ’১৮ সালের মধ্যে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ও পথনকশা অনুযায়ী ২১১ কিলোমিটার মহাসড়কটি ৬ লেনে উন্নীতকরণে ২১ হাজার কোটি টাকার সম্ভাব্য ব্যায় ধরা হলেও প্রতিষ্ঠানটি আবার নতুন করে সবকিছু করতে বলেছে। দাতা সংস্থাটি ইতোপূর্বে এ প্রকল্পে আর্থায়নের আগ্রহ দেখিয়ে আসলেও এখন তাতে ভাটা পড়েছে।
অধিগ্রহন এবং পরিপূর্ণ ডিপিপি প্রনয়ন সহ চূড়ান্ত অনুমোদেন না করায় এডিবি’র পক্ষ থেকেও বাড়তি কোন আগ্রহ দেখান হচ্ছে না। নতুন পথনকশা ও সম্ভাব্যতা সমীক্ষার লক্ষে গত এক বছরেরও বেশী সময় ধরে ধীরালয়ে কাজ চললেও কবে নাগাদ এসব বিষয় চূড়ান্ত হবে তা বলতে পারেনি সংশ্লিষ্ট মহল। পাশাপাশি সাম্প্রতিক দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরে উন্নয়ন প্রকল্পগুলো নিয়ে বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে কিছুটা ঢিলেঢালা ভাব লক্ষণীয়।
তবে পরিকল্পনা কমিশনের উচ্চ পর্যায় থেকে ইতোপূর্বে সরেজমিনে প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করে জনগুরুত্বপূর্ণ এ প্রকল্পটির বিষয়ে ইতিবাচক মনভাব প্রদর্শন করা হয়েছে। তবে এখনা কোন বাস্তব অগ্রগতি নেই। আগামী অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী-এডিপি’র সবুজ পাতায় ‘ফরিদপুর-বরিশাল-পায়রা-কুয়াকাটা জাতীয় মহাসড়ক ৬ লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পটি অন্তর্ভূক্তির ব্যাপারে সড়ক অধিদপ্তর সহ সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল মহল আশাবাদী।