2:43 pm , April 26, 2025

উদ্যানের সৌন্দর্য রক্ষায় সর্বোচ্চ ২০/২৫টি দোকান থাকতে পারে
বিশেষ প্রতিবেদক ॥ ছোট বড় প্রায় ২৫০টি দোকান। ছোট দোকান থেকে ৩০টাকা এবং বড় দোকান থেকে ৫০ টাকা করে আদায় হচ্ছে। এভাবেই প্রতিদিন প্রায় লাখ টাকা আয় এই পার্ক থেকে। তবে এতো দোকান কে বা কারা বসিয়েছে তা জানেনা কেউ।
যদিও সিটি কর্পোরেশনের দাবী তারা ১৭৮টি দোকান বসার অনুমতি দিয়েছেন এবং এসব দোকানের জন্য পানীয় জল ও বিদ্যুৎ সুবিধা নিশ্চিত করে রক্ষণাবেক্ষণ খরচ নিচ্ছেন তারা। তবে বাস্তবে তা ২৫০ প্রায় এবং বাকী ৮০টি দোকান ইতিমধ্যেই মাঠের অর্ধেক দখল করে নিয়েছে। এ চিত্র বরিশালের ঐতিহাসিক বেলস পার্কের। এখানে ঘুরতে আসা দর্শনার্থীদের দাবী, এই উদ্যানের সৌন্দর্য রক্ষায় সর্বোচ্চ ২০/২৫টি দোকান থাকতে পারে। মানবিকতার দোহাই দিয়ে এভাবে দোকান বসিয়েছে প্রশাসন নিজেই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছেন বলে জানালেন অনেকে।
২৬ এপ্রিল শনিবার বিকালে বেলস পার্ক ঘুরে দেখা গেছে এই চিত্র। মহিলা ক্লাবের সামনে দিয়ে শুরু হয়েছে সারি সারি দোকান বসানোর প্রতিযোগিতা। বেলস পার্কের ওয়াকওয়ে ও মডেল স্কুল এন্ড কলেজের দেয়াল ঘেঁষে দু’পাশেই থরে থরে সাজানো দোকান। আবার উম্মুক্ত শিশুপার্কের প্রবেশপথে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে ১০ টাকা প্রবেশ মূল্যের নোটিশ। সাধারণ মানুষ ও দর্শনার্থীদের দাবী, শিশুপার্কের জন্য ১০ টাকা প্রবেশ মূল্য নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। কারণ এটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য এর প্রয়োজন আছে। তবে বেলস পার্ক জুড়ে এতো দোকান হওয়া উচিত নয়। এটি করে প্রশাসনের দিকে আঙ্গুল তুলছেন দর্শনার্থীরা। এখানে সকাল-সন্ধ্যা ওয়াকওয়ে ব্যবহারকারী বরিশাল বিভাগীয় প্রাতঃভ্রমণ ও শরীরচর্চা পরিষদের কয়েকজন সিনিয়র সিটিজেনও বিরক্তি প্রকাশ করলেন। বেলস পার্কের মাঠ জেলা প্রশাসনের। আর পার্কের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব বরিশাল সিটি করপোরেশনের।
বরিশালের ইতিহাস ঐতিহ্যের সাক্ষী এবং সভা সমাবেশের অন্যতম স্থান হিসেবে পরিচিত বেলস পার্কে গজিয়ে ওঠা এসব দোকানপাটকে ঘীরে কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য বাড়ছে বলেও অভিযোগ করেন তারা। ইতিমধ্যেই ঘটেছে মারাত্মক দুটি ঘটনা। আশেপাশের বাসিন্দা ও প্রাতঃভ্রমণকারীদের দাবী এখানে মডেল স্কুল ও কলেজের দেয়াল সংলগ্ন ফুটপাত দখল করে গজিয়ে ওঠা এসব পথ খাবারের দোকান, কিশোর গ্যাং ও বিবেকহীন কতিপয় মানুষের নানা অনৈতিক কর্মকান্ডে পার্কের স্বাভাবিক পরিবেশ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এখানে ডিসি লেক সংলগ্ন তাদের নিজস্ব বসার স্থানটিও এখন বেদখল হয়েছে বলে জানান তারা। বলেন, স্থানটিও এখন সন্ধ্যার পর মাদকাসক্ত কিশোরদের দখলে চলে যায়। শুধু মাঠ ও মডেল স্কুল এন্ড কলেজের ফুটপাতই নয় পার্কের মাঠ দখল করেও চা ফুসকা, চটপটিসহ বেশ কিছু খাবারের দোকান চোখে পড়ে। এসব দোকানের নানা বর্জ্য মাঠের অভ্যন্তর সহ পাশের ডিসি লেকে ফেলায় লেকটির পানিও দুষিত হতে শুরু করেছে। রক্ষনাবেক্ষনের অভাবে পুরো পার্কের নানা অবকাঠামো বিনষ্ট হচ্ছে। যদিও সম্প্রতি মাঠের লাইট, পাবলিক টয়লেট, ওয়াকওয়ে ও বাউন্ডারী দেয়ালের কাজ শুরু হয়েছে। মাঠের পাশের মসজিদটি সংস্কার ও উপরে টিন দেওয়া হয়েছে। বিভাগীয় কমিশনার ও সিটি প্রশাসক মোঃ রায়হান কাওছার মাঝে মধ্যেই কাজ তদারকি করছেন এবং নিজে উপস্থিত থেকে দিক নির্দেশনা দিচ্ছেন।
তবে মাত্রাতিরিক্ত বিভিন্ন ধরনের দোকানের কারণে বেলস্ পার্কের পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে। চলাচলের পথে শত শত মোটরসাইকেল রাখা হচ্ছে। বিপুল অর্থ ব্যয়ে মাঠের চারদিকের ওয়াকওয়ে ব্যবহার করতে পারছেন না বৈকালীন ও প্রাতঃভ্রমন সংঘের লোকজন। স্থানীয় চা বিক্রেতারা জানালেন, স্কুল কলেজ পড়ুয়া ছেলে-মেয়েদের ভিড় বেশি এখানে। বিকেল থেকে রাত আটটা দশটা পর্যন্ত ওদের ভিড় ও আড্ডা হয়। ছোটখাটো মারামারি প্রায় প্রতিদিনই হচ্ছে। গত বছর ৩০ সেপ্টেম্বর এখানে হত্যার মতো ঘটনাও ঘটেছে বলে জানান তারা।
যদিও এই বেলস পার্কের রয়েছে গর্বিত ইতিহাস। বৃটিশ শাসনামলের শেষ দিকে তৎকালীন বাকেরগঞ্জ জেলার জেলা প্রশাসক মিঃ বেল প্রায় পৌনে ৯ একর সরকারী খাস জমির ওপর এই পার্ক বা উদ্যানটি গড়ে তুলেছিলেন। তখন তার নাম অনুসারেই উদ্যানটির নামকরণ হয়েছিল ‘বেলস পার্ক’। পাকিস্তান আমলে গণপূর্ত বিভাগ এ পার্কটির মালিকানা সহ তার তত্বাবধানের দায়িত্ব লাভ করে। বছর কয়েক আগে উদ্যানটির দুই দিকে জেলা প্রশাসন থেকে নকশা খচিত বিশাল প্রস্তর খন্ডে ভূমির মালিক ‘বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে জেলা প্রশাসক’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বিশাল এ ময়দানে ইতোপূর্বে দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধান মন্ত্রী সহ বিভিন্ন জাতীয় নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রেখেছেন।
২০০৪ সালে তৎকালীন সিটি মেয়র মজিবর রহমান সারোয়ারের উদ্যোগে সরকারী প্রায় ৩ কোটি টাকা সংগ্রহ করে গণপূর্ত অধিধপ্তরের মাধ্যমে উদ্যানটির চারিধারে ওয়াকওয়ে, বসার জন্য বেঞ্চি, ছাতা সহ শৌচাগার ও বিশ্রামাগার নির্মাণ ছাড়াও পুরো উদ্যানটি জুড়ে দৃষ্টি নন্দন লাইটিং-এর ব্যবস্থা করা হয়। পাশাপাশি শোভা বর্ধনের জন্য পুরো মাঠের চারধারে বৃক্ষ রোপন করা হয়েছিল। সে থেকে উদ্যানটির পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা ও রক্ষনাবেক্ষনের দায়িত্ব গ্রহন করে সিটি করপোরেশন। প্রতিদিনই এ উদ্যানে সকাল-বিকেল প্রচুর লোক হাঁটতে ও সান্ধ্যকালীন বিনোদনে আসেন।
২০১১ সালে তৎকালীন সিটি মেয়র শওকত হোসেন হিরন গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে তহবিল সংগ্রহ করে উদ্যানটিতে দ্বিতীয় ওয়াকওয়ে এবং পূর্বপার্শ্বে প্রধান সড়ক ঘেঁষে মুড়াল স্থাপনের পাশাপাশি উদ্যানটির পূর্বপাশের নালাটি সংস্কার করে সেখানে শাপলার আবাদ করেন। এছাড়াও সংলগ্ন বাঁধ রোডে পাকা ফুটপাথ নির্মান সহ সোনালি গাছ লাগান হয়। যা এখনো নগরবাসীর চোখ জুড়িয়ে দেয়।
দ্বিতীয় দফায় সংস্কারের পরে উদ্যানে প্রাতঃ ও বৈকালিক ভ্রমনকারীর সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পেলেও গত কয়েক বছর ধরে ভ্রমনকারীর চেয়ে আড্ডাবাজদের ভীড় আশংকাজনক হারে বেড়ে গেছে। সাথে উদ্যানটির পুরো উত্তর পাশ জুড়ে নানা ধরনের পথ খাবারের দোকান আড্ডাবাজদের জন্য বাড়তি সুবিধা সৃষ্টি করছে বলে জানান বিভাগীয় প্রাতঃভ্রমণ ও শরীরচর্চা পরিষদের সদস্য আলমগীর হোসেন।
তিনি জানান, শুধু এই উদ্যানেই নয় নগরীর প্রতিটি বিনোদন স্থানে কিশোরদের দৌরাত্ম্য বেড়েছে। এজন্য তিনি অভিভাবকদের দায়ী করেন।
অন্যদিকে বেলস পার্কের অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও ফুটপাতে দোকান বসানো এগুলো জেলা প্রশাসনের কাজ নয় জানিয়ে বরিশালের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) লুসিকান্ত হাজং বলেন, বেলস পার্কের মাঠটুকু এবং ডিসি লেকটা জেলা প্রশাসনের অধিনে। এখানে উদ্যানের অবকাঠামোগত উন্নয়ন পুরোপুরি সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব বলে জানান তিনি।