3:01 pm , April 19, 2025

মৎস্য অধিদপ্তরের অভিমত
বিশেষ প্রতিনিধি ॥ বরিশালের পোর্টরোড বেলতলা কিংবা পোর্টরোড ইলিশ মোকামের কোথাও ইলিশের দেখা না থাকলেও মৎস্য অধিদপ্তর বলেছে এখানে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে। ইলিশ আড়তদার, পাইকার ও রপ্তানীকারকরা সবাই এ তথ্যকে অস্বীকার করে বলেছেন বরিশালে ইলিশের উৎপাদন তলানিতে এসেছে। ইলিশ মাছ সংকটে ইতিমধ্যে বরিশালের ৬০% ইলিশ আড়ত বন্ধ হয়ে গেছে।
মৎস্য অধিদপ্তরের মতে বরিশালের ৯০টি নদীর সবগুলোতেই ইলিশ মাছ ধরা পড়ছে। ইলিশের বড় ক্ষেত্র হিসেবে ইতিমধ্যেই হিজলা, ভোলা, হাইমচর, মেহেন্দিগঞ্জসহ মেঘনা থেকে কারখানা নদী পর্যন্ত ১৭টি স্থানকে নির্ধারিত করা হয়েছে। বলা হচ্ছে খাবার, উপযুক্ত পরিবেশ ও স্বাভাবিক স্রোতের প্রাপ্তি বেশি থাকায় বরিশালে ইলিশের উৎপাদন বেশি হচ্ছে।
মৎস্য অধিদপ্তরের সিনিয়র সহকারি পরিচালক মোঃ জহিরুল ইসলাম বলেছেন বরিশাল অঞ্চলে ইলিশে ভরা স্পট ১৭টি। ইলিশের প্রজনন হয় সাগর নদীর মিলন স্থলে। সাথে রয়েছে ৫টি অভয়াশ্রম। এর পর ইলিশের বাচ্চাগুলো রক্ষার জন্য স্যালো ওয়াটার লাগবে। শিশু ইলিশের খাবার (প্লংটন) ও হালকা স্রোত দরকার হয়। এগুলোর সব কিছুই বরিশালের নদী ও মোহনায় রয়েছে বলে এখানে ইলিশের উৎপাদন সবচেয়ে বেশি।
মৎস্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী গত ১০ বছরে বরিশালে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে ২ লাখ ২ হাজার টন। ১০ বছর আগে বরিশালে ইলিশের উৎপাদন যেখানে ছিলো ১ লাখ ৭০ হাজার টন সেখানে গত বছর উৎপাদন হয়েছে ৩ লাখ ৭২ হাজার টন।
মৎস্য বিভাগের এমন তথ্যের সাথে সরাসরি বিরোধিতা করেছে বরিশালের পোর্টরোড, চন্দ্র মোহন ও বেলতলা ইলিশ মোকামের ব্যবসায়ী আড়তদার, পাইকার ও রপ্তানীকারকরা। তারা এমন তথ্যকে মৎস্য কর্মকর্তাদের চাকুরি রক্ষাকারি মনগড়া তথ্য দাবি করে বলেছেন ইলিশের উৎপাদন তলানীতে এসে ঠেকেছে। বরিশালের ১৬৩টি ইলিশ আড়তের মধ্যে মাছ সংকটে ১০৩টি আড়ত বন্ধ হয়ে গেছে। মহাজনরা জীবন বাচাতে ইলিশ ছেড়ে তরমুজসহ অন্য ব্যবসা শুরু করেছে। ইলিশ মোকামগুলোতে রীতিমত ইলিশের হাহাকার চলছে। একটা সময় মধ্যবিত্তরা বাসায় মেহমান এলে ইলিশ মাছ দিয়ে আপ্যায়ন করতো। বর্তমানে অবস্থা এমন হয়েছে মাসে তো দুরের কথা বছরেও ইলিশ মাছ কেনার সাহস করছে না বেশিরভাগ মধ্যবিত্তরা। গত ৫ বছরে ইলিশের দাম আকাশ চুম্বি হয়েছে।
ব্যবসায়ী, আড়তদার, রপ্তানীকারক ও পাইকাররা বলেন ৫০ বছর থেকে ইলিশের ব্যবসা করছি। ১০ হাজার টাকা যে ইলিশের মন ছিলো তা এখন একলাখ ১০ হাজার টাকা। সেই হিসেবে দিন যত যাচ্ছে ইলিশের দাম বাড়ছে মাছ কমছে। আগে এই মোকাম থেকে প্রতিদিন ১০০ থেকে ১৫০টি ট্রাকে ইলিশ বিভিন্ন স্থানে যেতো, এখন দুই গাড়িও যায় না। এ অবস্থায় মৎস্য বিভাগের হিসেবের সাথে আমাদের বাস্তবতা মেলে না। কোথাওতো ইলিশ নেই। মৎস্য বিভাগ স্পটে না গিয়ে অফিসে বসে উৎপাদনের হিসেব কষে।
অন্যজন জানান আশির দশকে থেকে মাছের আমদানি বেড়েছে। এই মোকামে প্রতিদিন ৫ হাজার মন ইলিশ এসেছে। এখন দৈনিক ৩০/৪০ মন মাছ পাওয়া যাচ্ছে সব মোকাম মিলে। মৎস্য বিভাগ বাজারে ভীড় ও মাছ দেখে মনেহয় তাদের উৎপাদনের হিসাব করে। উনারা চাকরি বাচানোর জন্য মনগড়া হিসেব দিচ্ছে।
এক পাইকারের মতে ওরা বলে মাছের উৎপাদন বেড়েছে, আমরাতো মাছ দেখছি না। আগে এই সময় আমরা এক কিংবা দেড় হাজার মন মাছ পেতাম, এখন ৫০ মনও আসে না। ঋন নিয়ে ইলিশ ধরতে দুই কোটি টাকা দাদন দিয়েছি। বোট পাঠাই নদীতে সাগরে, জাল ফেলে আবার টেনে শুন্যহাতে ফিরে আসে। গত এক বছরে দূর্যোগের কারনে একটাও ইলিশ মৌসুম ধরতে পারিনি, এর পর আবার জাটকা, মা ইলিশের নিষেধাজ্ঞাতো আছেই।
অন্যজন জানান এই ঘাটে ৩ থেকে ৫ হাজার ইলিশ শ্রমিক ছিলো যারা ট্রলার থেকে ইলিশ নিয়ে ট্রাকে তুলতো। মাছ এতো বেশি হতো তে কাজের ভয়ে অনেক শ্রমিক পাওনা না নিয়েই পালিয়ে যেতো। যেখানে ইলিশ মোকামগুলোতে এখন কোন মাছই নেই, শ্রমিকও নেই। বরিশালের সব বাজার মিলিয়ে এখন ৫ মন ইলিশও মিলবে না। আড়তদারেরা ব্যবসা ছেড়ে বাড়িতে জমিজমার কাজ করছে কেউ তরমুজ বিক্রি করছে।
মৎস্য অধিদপ্তর নিজেদের তথ্য নির্ভুল দাবি করে বলেছে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হওয়ায় ইলিশের উৎপাদন আগের মতো দৃশ্যমান হচ্ছে না। ইলিশ ধরা পড়ার পর কেন্দ্র স্থল থেকে দেশের বিভিন্ন স্থান ও বিদেশে চলে যাচ্ছে। তাদের মতে ইলিশের উৎপাদন জরিপ অনুযায়ি ১০ বছরে দু লাখ মেট্রিক টন বেড়েছে।
মৎস্য অধিদপ্তরের উপপরিচালক নৃপেন্দ্র নাথ বিশ্বাস বলেন, আমরা জানি যা এক সময় বরিশালে ইলিশের ছড়াছড়ি ছিলো। তখন চাহিদা ছিলো কম যার ফলে ইলিশ দৃশ্যমান ছিলো। সড়ক পথের উন্নয়ন ও সারা বিশ্বের সাথে বরিশালের যোগাযোগ ভালো হওয়ায় এই ইলিশ সারাদেশসহ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে যাচ্ছে। যার ফলে বরিশালের ইলিশ বরিশালে দৃশ্যমান কম হচ্ছে। ইলিশ রক্ষায় সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের কারনে গত দশ বছরে ইলিশের উৎপাদন ২ লাখ টন বেড়ে এখন বছরে ৩ লাখ ৭২ হাজার টনে এসে পৌছেছে। সবার আন্তরিকতায় এটা সম্ভব হয়েছে। আগামীতে ইলিশের উৎপাদন আরো বাড়বে এবং দামও কমবে। আমাদের তথ্য নির্ভুল।