2:51 pm , April 15, 2025

বিশেষ প্রতিবেদক ॥ চিংড়ি সহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছের প্রজনন প্রক্রিয়া নিরাপদ ও নিশ্চিত করণের পাশাপাশি আহরন প্রবৃদ্ধি টেকসই করার লক্ষ্যে বঙ্গোপসাগরে দেশের নিজস্ব অর্থনৈতিক অঞ্চলে ৫৮ দিনের মৎস্য আহরণে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হয়েছে মঙ্গলবার রাতের প্রথম প্রহর থেকে। ইতোপূর্বে সমুদ্র এলাকায় ৬৫ দিন সব ধরনের মৎস্য আহরণে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হওয়ায় দেশের সামুদ্রিক জলাশয়ে গত কয়েক বছরে মাছের উৎপাদন প্রায় এক লাখ টন বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানা গেছে। তবে প্রতিবেশী দেশের সাথে সমন্বয় সহ জেলেদের দাবীর প্রেক্ষিতে এবার নিষেধাজ্ঞাকাল ৫৮ দিনে নামিয়ে আনার পাশপাশি ২০ মে এর পরিবর্তে তা ১৫ এপ্রিল থেকে কার্যকর হল। দেশের মৎস্য সম্পদে সামুদ্রিক মাছের অবদান প্রায় ৮Ñ১০%।
ইতোপূর্বে জেলে ও মৎস্যজীবীদের অভিযোগ ছিল, বাংলদেশের সমুদ্র এলাকায় মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকলেও এসময়ে ভারতে নিষিদ্ধ না থকায় সেদেশের জেলরা অবাধে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় প্রবেশ করে মাছ লুটে নিচ্ছে। মৎস্য বিজ্ঞানীরাও প্রতিবেশী দেশের সাথে সমতা রেখে সাগরে মৎস্য আহরণ নিষিদ্ধ ঘোষনার সময় পুন:বিবেচনার কথা বলে আসছিলেন। ভারতে সর্বপ্রথমে ১৯৮৮ সালে ১৫ জুন থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত সমুদ্রে মৎস্য আহরণ নিষিদ্ধ ছিল। তবে ২০০০ সাল থেকে দেশটির পূর্ব উপকূল অর্র্থ্যাৎ পশ্চিমবঙ্গে বঙ্গোপসগরের সাগরসীমায় ১৫ এপ্রিল থেকে ৩১ মে পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা কার্যকর রয়েছে। অপর প্রতিবেশী মিয়ানমারেও জুন থেকে আগষ্ট পর্যন্ত সাগরে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা কার্যকর রয়েছে।
দেশে ২০১৫ থেকে ’১৮ সাল পর্যন্ত কার্যক্রমটি শুধুমাত্র বাণিজ্যিক ট্রলারের ক্ষেত্রে কার্যকর হলেও ২০১৯ সাল থেকে তা সব মৎস্য নৌযানের ক্ষেত্রেই কার্যকর হয়। এছাড়াও প্রতিবছর আশি^নের বড় পূর্ণিমার আগে-পরের ২২ দিন উপকূলের ৭ হাজার ৩৪৩ বর্গ কিলোমিটারের মূল প্রজনন ক্ষেত্রে সব ধরনের মৎস্য আহরন সহ দেশের অভ্যন্তরীণ ও উপকূলীয় নদ-নদীতে ইলিশ আহরণে নিষেধাজ্ঞার ফলে গত দুই দশকে জাতীয় এ মাছের উৎপাদন প্রায় তিনগুন বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া ১ নভেম্বর থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত জাটকা আহরনও নিষিদ্ধ থাকছে।
বিভিন্ন বৈশিষ্ট ও বৈচিত্রপূর্ণ মৎস্য সম্পদে সমৃদ্ধ বঙ্গোপসাগর বিশে^র একমাত্র উপসাগর যেখানে সবচেয়ে বেশী নদী বিধৌত পানি প্রবেশ করে। ৭১০ কিলোমিটার উপকূলীয় তটরেখা এবং সমুদ্রের ২শ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত ‘একান্ত অর্থনৈতিক এলাকা’র পরিমান ১ লাখ ১৮ হজার ৮১৩ বর্গ কিলোমিটার। ছোট-বড় নানা আকার-প্রকারের ৪৭৫ প্রজাতির মৎস্য সম্পদ ছাড়াও ৩৬ প্রজাতির চিংড়ি, ৫ প্রজাতির লবস্টার, ১৫ প্রজাতির কাঁকড়া, ৫ প্রজাতির কচ্ছপ ও ১৩ প্রজাতির প্রবাল সহ বিভিন্ন জলজ সম্পদে সমৃদ্ধ আমাদের সমুদ্র এলাকা।
এছাড়া দেশে অহরিত প্রায় সাড়ে ৫লাখ টন ইলিশের প্রায় পুরোটার প্রজনন উৎস্যই বঙ্গোপসাগর এলাকা। নার্সারী ক্ষেত্রসমূহে ৭Ñ১০ সপ্তাহ ভেসে বেড়াবার পরে এসব পোনা সমুদ্রে চলে যায় পরিপক্কতা অর্জনে। বঙ্গোপসাগরের বিভিন্ন এলাকায় ১২Ñ১৮ মাস অবস্থানের পরে পরিপক্ক হয়েই পূর্র্ণাঙ্গ ইলিশ হিসেবে প্রজননের লক্ষ্যে আবার উপকূলের নার্সারী ক্ষেত্রে ফিরে এসে ডিম ছাড়ে।
এসব বিবেচনায় বিজ্ঞানীদের সুপারিশের আলোকেই ১৫ এপ্রিল রাতের প্রথম প্রহর থেকে বঙ্গোপসাগরে দেশের একান্ত অর্থনৈতিক অঞ্চলে সব ধরনের বানিজ্যিক মাছধরা নৌযানের আহরন নিষেধাজ্ঞা বলবৎ হয়েছে। আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত দেশের অভ্যন্তরীণ ও উপকূলীয় এলাকায় জাটকা আহরন নিষেধাজ্ঞার মধ্যে সাগরে মাছধরা বন্ধের এ সিদ্ধান্তকে জেলে ও মৎস্যজীবীরা খুব খুশি মনে না নিলেও বিগত বছরের চেয়ে আহরন নিষেধাজ্ঞা ৭দিন কমিয়ে আনায় তারা কিছুটা স্বস্তিতে। তবে মৎস্য অধিদপ্তরের মতে দুর্যোগপূর্ণ মৌসুমেই সাগরে এ আহরন নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হওয়ায় জেলেদের খুব ক্ষতি হবার কথা না। কারণ, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার বেশীরভাগ সময়ই জেলেরা সাগরে যেতে পারেননা। পাশাপাশি দেশের মৎস্য সম্পদ সমৃদ্ধ করা সহ জেলে ও মৎস্যজীবীদের ভবিষ্যত জীবন-জীবিকা নিরাপদ করার লক্ষেই এ পদক্ষেপ বলেও জানিয়েছে মৎস্য অধিদপ্তর।
এবারো আহরন নিষিদ্ধকালীন সময়ে উপকূলের প্রায় ৩লাখ জেলে পরিবারকে বিগত বছরগুলোর মত খাদ্য সহায়তা প্রদান করা হবে। যারমধ্যে বরিশালেরই প্রায় দেড় লাখ জেলে খাদ্য সহায়তা পাবেন।
পাশাপাশি সাগরে আহরন নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে পুলিশ ও নৌ পুলিশের পাশাপাশি কোষ্টগার্ড সহ নৌবাহিনীরও সহায়তা গ্রহণ করবে মৎস্য অধিদপ্তর।
মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, সাম্প্রতিককালে বিশ^ব্যাপী সামুদ্রিক ও উপকূলীয় মৎস্য সম্পদ অতি আহরনজনিত ক্রমহ্রাসমানতা, ভূমি ও সমুদ্র হতে সৃষ্ট দুষণ এবং জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তন সহ নানামুখি সংকটের সম্মুখিন। ফলে মৎস্যকুলের প্রাচুর্য, বিস্তৃতি ও প্রজাতির ওপর বিরূপ প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে।
এমনকি বিশে^র সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ অসীম হলেও অফুরন্ত নয়। তাই সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ ব্যবস্থাপনায় সম্ভাব্য সকল ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তাকে বিবেচনায় নিয়ে বিগত বছরগুলোতে আহরন পরিমান বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রজাতির গুনগতমান অবনমন লক্ষ্য করেছেন বিজ্ঞানীরা। ফলে মৎস্য সেক্টরের ওপর নির্ভরশীল বিভিন্নস্তরের অংশীজনের মাছের সীমিত সম্পদ নিয়ে অসম প্রতিযোগীতা এবং আয় বৈষম্যও লক্ষ্যণীয়।
মৎস্য বিজ্ঞানীরা বিশাল এলাকার জলরাশির মৎস্য সম্পদ সংরক্ষন, ব্যবস্থাপনা এবং সুষ্ঠু ও বিজ্ঞানসম্মত সহনশীল আহরন নিশ্চিত করে বছরের পর বছর সামুদ্রিক মৎস্য উৎপাদন অব্যাহত এবং বংশ বৃদ্ধি ও মজুত অক্ষুন্ন রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করে একান্ত বাস্তবতা ও পরিবেশকে বিবেচনায় নিয়ে সামুদ্রিক মৎস্য ব্যবস্থাপনা নীতি ও কৌশল প্রণয়নের কথাও জানিয়েছেন। এ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হবার আগে অর্থাৎ ২০১২-১৩ থেকে ’১৪-১৫ সময়ের তুলনায় ২০১৫-১৬ থেকে ’১৭-১৮ পর্যন্ত বানিজ্যিক ট্রলার থেকে আহরিত মাছের ক্যাচলগ পর্যালোচনায় মৎস্য আহরনের পরিমান বৃদ্ধি পাবার সুস্পষ্ট প্রবনতা পরিলক্ষিত হয়েছে বলে মৎস্য বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন।
মৎস্য গবেষনা ইনস্টিটিউট-এর সাবেক মহাপরিচালক ড. জুলফিকার বলেন, সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদের কার্যকরি ব্যবস্থাপনার একটি সহজ ও অত্যন্ত ফলদায়ক পদ্ধতি নির্দিষ্ট সময়ে মৎস্য আহরন বন্ধ রাখা। বিশে^র বিভিন্ন দেশে এ পদ্ধতি কার্যকর রয়েছে বলে জানিয়ে এবার প্রতিবেশী দেশের সাথে সমন্বয় করে আমাদের নিষেধাজ্ঞাকাল নির্ধারনের ফলে ভারতীয় জেলেদের অবৈধ অনুপ্রবেশ বন্ধ হবারও আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।