উৎপাদন ব্যয় হ্রাসের লক্ষে সেচ ব্যবস্থা বিদ্যুতায়নের তাগিদ উৎপাদন ব্যয় হ্রাসের লক্ষে সেচ ব্যবস্থা বিদ্যুতায়নের তাগিদ - ajkerparibartan.com
উৎপাদন ব্যয় হ্রাসের লক্ষে সেচ ব্যবস্থা বিদ্যুতায়নের তাগিদ

4:09 pm , April 9, 2025

বরিশালে ১৮ লাখটন বোরো চাল ঘরে তুলতে শতভাগ আবাদ সম্পন্ন

বিশেষ প্রতিবেদক ॥ বরিশালে প্রায় ১৮ লাখ টন চাল পাবার লক্ষ্য নিয়ে এযাবৎকালের সর্বোচ্চ প্রায় ৪ লাখ হেক্টরে বোরো আবাদ সম্পন্ন করেছেন কৃষিযোদ্ধাগন। গত ১৫ মার্চ বোরো আবাদের সময়সীমা থাকলেও বৃষ্টির অভাবে আবাদ কিছুটা বিলম্বিত হওয়ায় এপ্রিলের প্রায় প্রথম সপ্তাহ পর্যন্তই আবাদ চলেছে। এবার শীত মৌসুমে বরিশাল অঞ্চলে কুয়াশার প্রকোপ কম থাকায় বোরো বীজতলা ‘কোল্ড ইনজুরী’র শিকার না হওয় বীজের কোন সংকট ছিলনা। ফলে লক্ষ্য পুরনে মৌসুম পেরিয়েও বোরো আবাদ চলেছে অন্তত ১৫ দিন।
ফলে এখন বরিশালের মাঠে মাটে সবুজ বোরো ধানের সমারোহ সবার নজর কাড়ে। অনেক এলাকায় ধানের ছড়াও বেরিয়েছে। তবে আবাদকৃত অন্তত অর্ধেক জমির ধান এখন থোর পর্যায়ে। এসময়টিতে সেচ ব্যবস্থা সহ সার ও বালাই ব্যবস্থাপনার প্রতি অত্যন্ত নিবিড় নজরদারী করতে হচ্ছে কৃষকদের। আগামী একমাসের মধ্যেই বরিশালের বোরো ফসলী জমিতে পূর্ণ হয়ে যাবে ধানের ছড়ায়।
চলতি মৌসুমে কৃষি মন্ত্রনালয় দেশে ৫০ লাখ ৬৯ হাজার ৪শ হেক্টর জমিতে আবাদের মাধ্যমে এযাবৎকালের সর্বোচ্চ, ২ কোটি ২৬ লাখ ২২ হাজার টন বোরো চাল উৎপাদনের লক্ষ্য স্থির করেছে। ইতোমধ্যে সারাদেশেই বোরো আবাদে শতভাগ লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে বলে কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তর-ডিএই’র সরেজমিন উইং-এর দায়িত্বশীল সূত্রে জানিয়েছে। ফলে বড় ধরনের প্রাকৃতিক কোন দূর্যোগ না ঘটলে চলতি বোরো মৌসুমে দেশে সর্বাধিক পরিমান বোরো চাল উৎপাদনের লক্ষ্যে পৌছবে দেশ।
বাংলাদেশ পৃথিবীর চতুর্থ ধান উৎপাদনকারী দেশ। অনাদীকাল থেকেই ধান আমাদের প্রধান খাদ্যশষ্য। এখনো আমাদের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি ধান। যদিও জনসংখ্যা বিস্ফোরনের সাথে পাল্লা দিয়ে ধানের উৎপাদন নিশ্চিত করা যায়নি। উপরন্তু অব্যাহত নগরায়ন ও শিল্পায়নের ফলে প্রতিনিয়ত কৃষি জমির পরিমানও হৃাস পাচ্ছে। ফলে গোটা বিশ্বের সাথে মিল রেখেই  “কম জমিতে বেশী উৎপাদন”কে লক্ষ নিয়ে আমাদের ধান গবেষনা ইনষ্টিটিউটের বিজ্ঞানীগন কাজ করছেন। ফলে স্বাধীনতার পরে দেশে যেখানে ধানের উপাদন ছিল ১ কোটি টনেরও কম, সেখানে এখন প্রায় পৌনে ৪ কোটি টন ধান উৎপাদন হচ্ছে। আর বোরো এখন আমাদের প্রধান দানাদার খাদ্য ফসল। অথচ নিকট অতীতেও আমনই ছিল প্রধান ফসল। এমনকি বরিশাল অঞ্চলে এখনো আমনের আবাদ উৎপাদন বোরোর চেয়ে বেশী।
আন্তর্জাতিক ধান গবেষনা ইনষ্টিটিউট-ইরি’র সহযোগীতায় ১৯৬৬ সাল থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে উচ্চ ফলনশীল জাতের “আইআরÑ৮” জাতের ধান সংগ্রহ করে তার আবাদ শুরু হয় । সে থেকেই আমাদের দেশে ইরি ধানের প্রচলন শুরু হয়। ঐ ধানের ফলন হেক্টরপ্রতি ৫Ñ৬টন পর্যন্ত হওয়ায় কৃষকরা তখন থেকে ইরি আবাদে ব্যাপক উৎসাহী হয়। ১৯৭০ সালের ১ অক্টোবর ‘বাংলাদেশ ধান গবেষনা ইনষ্টিটিউট-ব্রি’ প্রতিষ্ঠিত হবার পরে এর বিজ্ঞানীগন ইতোমধ্যে একাধিক হাইব্রীড সহ প্রায় ১১৫টি উচ্চফলনশীল বোরো, আমন ও আউশ ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন। এমনকি ব্রি’র বিজ্ঞানীগন ধানচাষের বিভিন্ন কলা কৌশল ও কৃষক বান্ধব নানা কৃষি যন্ত্রপাতিও উদ্ভাবন করেছেন। যা সীমিত আকারে হলেও মাঠ পর্যায়ে ইতোমধ্যেই বিকাশ লাভ করতেও শুরু করেছে।
সুগন্ধী-চিকন  ‘বরিশালের বালাম চাল’ খ্যাত এ কৃষি অঞ্চলে এখনো আমন প্রধান দানাদার খাদ্যফসল হলেও বোরো ধানের আবাদ এবার আরো এগিয়েছে। বিগত খরিপ-২ মৌসুমে বরিশালে প্রায় ৯ লাখ হেক্টরে ২৪ লাখ টন  আমনের উৎপাদনের পরে রবি মৌসুমে প্রায় ৪ লাখ হেক্টরে ১৮ লাখটন বোরো চাল পাবার লক্ষে শতভাগ আবাদ সম্পন্ন করেছেন কৃষিযোদ্ধাগন।
তবে এবার লাগাতার অনাবৃষ্টির কারণে জমিতে অতিরিক্ত সেচ প্রদানের ফলে বোরো ধানের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবার আশাংকার কথা জানিয়েছেন মাঠ পর্যাযের কৃষিবীদ ও কৃষকগন। গত নভেম্বর থেকে বরিশাল অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমান স্বাভাবিকের ৯০-৯৫ভাগ পর্যন্ত কম। উপরন্তু তাপমাত্রার পারদ স্বাভাবিকের ৪-৫ ডিগ্রী ওপরে উঠে যাওয়ায় ব্লাষ্ট রোগের আশংকায় বোরো জমিতে সব সময় ৩ইঞ্চি পরিমান পানি রাখার তাগিদ দিয়েছেন কৃষিবীদগন।
এরসাথে সারের দাম গত তিন বছরে দু দফায় বৃদ্ধির ফলে বোরো আবাদ ব্যয় এবার প্রতিমনে প্রায় সাড়ে ১২শ টাকায় উন্নীত হবার আশংকার কথা জনিয়েছেন কৃষকগন। বরিশাল অঞ্চলে বোরোর জমিতে সেচ যন্ত্রের প্রায় ৮০ভাগই ডিজেল চালিত। বিদ্যুতের চেয়ে ডিজেলে সেচ ব্যায় প্রায় দেড়গুন বেশী । উপরন্তু ২০০২ সাল থেকে দেশে সেচযন্ত্রে ব্যবহ্রত বিদ্যুৎ বিলের ওপর সরকার থেকে ২০ভাগ ভর্তূকি প্রদান করা হলেও অতিরিক্ত জ¦ালানী ব্যায়ের ডিজেল নির্ভর সেচযন্ত্রে কোন ভর্তুকি নেই। বরিশালের অপেক্ষাকৃত দরিদ্র কৃষকদের পক্ষে বিদ্যুৎ চালিত সেচযন্ত্র ক্রয় করে জমিতে সেচ দেয়াও সম্ভব হচ্ছেনা। যার বিরূপ প্রভাব পড়ছে এ অঞ্চলের কৃষি উৎপাদনেও।
তবে ১৪ লাখটন খাদ্য উদ্বৃত্ত বরিশাল কৃষি অঞ্চলে সহজ শর্তে ও স্বল্প সুদে বিদ্যুৎ চালিত ও সৌর বিদ্যুতের সেচযন্ত্র ক্রয়ে ঋণ প্রদান করলে বোরো সেচাবাদে কৃষকদের আরো আগ্রহী করা সম্ভব বলে মনে করছেন কৃষি অর্থনীতিবীদগন।
এমনকি বরিশালের মাঠ পর্যায়ে ব্যবহ্রত সেচযন্ত্রের অর্ধেকও বিদ্যুতায়িত করতে পারলে এ অঞ্চলের উদ্বৃত্ত খাদ্যের পরিমান অনায়াসে ২০ লাখ টনে উন্নীত করা সম্ভব বলে মনে করছেন কৃষিবীদগন। এতেকরে এ অঞ্চলে লাগাতর লোকাশানে থাকা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিগুলোও আর্থিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে পাড়বে বলে মনে করছেন জ¦ালানী বিশেষজ্ঞগন।
অপরদিকে বিগত রবি মৌসুমে বরিশালে প্রায় আড়াই লাখ হেক্টর জমিতে সেচাবাদ হলেও তার মধ্যে বিএডিসি’র অবদান ছিল ২০ হাজার হেক্টরেরও কম। উপরন্তু বিগত রবি মৌসুমে এ অঞ্চলে বিভিন্ন  মাপের যে প্রায় সাড়ে ১৮ হাজার সেচ পাম্প মাঠে ব্যবহ্রত হয় তার মাত্র সাড়ে ৯শর মত ছিল বিদ্যুৎ চালিত।
এসব বিবেচনায় বিএডিসি চলতি অর্থ বছর থেকে ‘বরিশাল অঞ্চলে সেচ কার্যক্রম উন্নয়ন প্রকল্প’র আওতায় আড়াইশ বিদ্যুৎ চালিত সেচযন্ত্র সংগ্রহ ছাড়াও ১ কিউসেক ক্ষমতা সম্পন্ন ২০টি সোলার লো-লিফট পাম্পসেট সংগ্রহ করে কৃষকদের সরবরাহ করবে বলে জানিয়েছে।
তবে প্রায় ১৪ লাখ টন উদ্বৃত্ত একসময়ের ‘শষ্যভান্ডার’ বরিশালে বোরো সেচাবাদে ব্রি উদ্ভাবিত হাইব্রিড ও উফশী জাতের ধানবীজ সরবরাহ সহ ধানের উৎপাদন ব্যায় হ্রাসের লক্ষ্যে সার ও কীটনাশকের মূল্য ৪ বছর আগের পর্যায়ে নামিয়ে আনার পাশাপাশি সেচ ব্যবস্থাকে ডিজেলের পরিবর্তে বিদ্যুতায়িত করার তাগিদ দিয়েছেন মাঠ পর্যায়ের কৃষিবীদগন। আর এ লক্ষ্যে ডিএই, বিএডিসি ও  ব্রী’র পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট এলাকার পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি’র এবং কৃষি ব্যাংক সহ কৃষিঋণ প্রদানকারী ব্যাংকগুলোর সমন্বয়ের তাগিদ দিয়েছেন ওয়াকিবাহাল মহল।

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন    
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী মিরাজ মাহমুদ
 
বার্তা ও বানিজ্যিক কার্যালয়ঃ কুশলা হাউজ, ১৩৮ বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সড়ক,
সদর রোড (শহীদ মিনারের বিপরীতে), বরিশাল-৮২০০।
© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
Developed by NEXTZEN-IT