অহরিত জাটকার এক-দশমাংশ রক্ষা পেলেও ইলিশের উৎপাদন আরো ১ লাখ টন বাড়বে  অহরিত জাটকার এক-দশমাংশ রক্ষা পেলেও ইলিশের উৎপাদন আরো ১ লাখ টন বাড়বে  - ajkerparibartan.com
অহরিত জাটকার এক-দশমাংশ রক্ষা পেলেও ইলিশের উৎপাদন আরো ১ লাখ টন বাড়বে 

2:54 pm , April 7, 2025

বিশেষ প্রতিবেদক ॥ মূল প্রজননকালে ইলিশের ডিম থেকে লার্ভা পরিস্ফুটনের মাধ্যমে পোনা উৎপাদন নিশ্চিত করতে গত ১ নভেম্বর থেকে সারা দেশে জাটকা আহরণ,পরিবহন ও বিপণনে ৮ মাসের নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হওয়ার পরে ৮ এপ্রিল থেকে ‘জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহ’ পালিত হচ্ছে। আজ মঙ্গলবার বরিশালের বেলস পার্কে জাতীয় পর্যায়ের এ সপ্তাহের উদ্বোধন করবেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি থাকবেন মন্ত্রণালয়ের সচিব তোফাজ্জেল হোসেন। ‘জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহ’র আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন শেষে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা জাটকা সংরক্ষনের আহবান জানিয়ে বরিশাল নদীবন্দর থেকে চরমোনাই পর্যন্ত এক নৌ-র‌্যালীতেও অংশ নেবেন। অনুষ্ঠানে বিভাগীয় কমিশনার রায়হান কাওসার ছাড়াও মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মো. আবদুর রউফও উপস্থিত থাকবেন বলা জানা গেছে। মৎস্য অধিদপ্তরের মতে দেশে উৎপাদিত ইলিশের প্রায় ৭০ভাগই বরিশাল সহ সন্নিহিত উপকূলে আহরণ হয়ে থাকে। ইলিশের নিরাপদ প্রজনন নিশ্চিত করতে গত ১৩ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত ইলিশের মূল প্রজননকালে উপকূলের ৭ হাজার ৩৪৩ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় ২২ দিনের জন্য সব ধরনের মৎস্য আহরণ সহ সারাদেশে পরিবহন ও বিপণনে নিষেধাজ্ঞা ছিল। এরইমধ্যে ১ নভেম্বর থেকে আগামী ৩০জুন পর্যন্ত জাটকা অধহরণে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হয়েছে। নিষেধাজ্ঞাকালে সরকার ঘোষিত ৬টি অভয়াশ্রম সহ সারা দেশে ১০ ইঞ্চি পর্যন্ত ইলিশ পোনা-জাটকা আহরণ, পরিবহন ও বিপণন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ রয়েছে। মৎস্য বিজ্ঞানীদের সুপারিশের আলোকে প্রতিবছরই মূল প্রজননকাল হিসেবে  আশি^নের বড় পূর্ণিমার আগে পরে ২২দিন উপকূলীয় প্রজনন এলাকা সহ সারা দেশে ইলিশ আহরণ নিষিদ্ধ থাকছে। এসময়কালে মা ইলিশের নির্গত ডিম  থেকে লার্ভা হয়ে বাচ্চা পরিস্ফুটনের পরে তা জাটকা থেকে পূর্ণাঙ্গ ইলিশে রূপান্তর নির্বিঘœ ও সহজত করতে নভেম্বর থেকে জুন পর্যন্ত জাটকা আহরণ নিষিদ্ধ থাকছে। মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, প্রজনন মৌসুমে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা সহ সাগরে ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা এবং জাটকা আহরণে টানা ৮ মাসের এ নিষেধাজ্ঞার ফলে দেশে গত দুই দশকে ইলিশের উৎপাদন ও সহনীয় আহরণ ২ লাখ টন থেকে প্রায় ৬ লাখ টনে উন্নীত হয়েছে।
এবারো এ নিষেধাজ্ঞাকালীন সময়ে দেশের দক্ষিণ উপকূলের ৩৭টি জেলার ১৫৫টি উপজেলার ৫ লাখ ৬৬ হাজার ৫৬৫ জেলেদের মাঝে মানবিক খাদ্য সহায়তা হিসেবে পরিবার প্রতি ২৫ কেজি করে ১৪ হাজার ১৬৫ টন চাল বিতরণ করা হয়েছে। এবারো জাটকা আহরণে নিষেধাজ্ঞা বলবত করতে বরিশাল সহ সন্নিহিত উপকূলীয় এলাকায় প্রশাসনের সহায়তায় ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা সহ মৎস্য বিভাগের নানা ধরনের অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। এসব অভিযানের পাশাপাশি জাটকা নিধন বন্ধে পুলিশ ছাড়াও নৌ বাহিনী, কোস্টগার্ড, র‌্যাব ও নৌ-পুলিশ অভ্যন্তরীণ নদ-নদী ও উপকূলীয় এলাকায় নজরদারী অব্যাহত রাখছে। গত কয়েক মাসে বরিশাল সহ দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা প্রশাসন ও  আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় প্রায় সাড়ে ৫শ মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে সাড়ে ১২ লাখ টাকা জরিমানা ও ৬৫জন জেলেকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ডাদেশ প্রদান করা হয়েছে। এসময় প্রায় ২.২০ কোটি মিটার নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল ছাড়াও আরো প্রায় ১৫ হাজার ক্ষতিকর জাল আটক করে বাজেয়াপ্ত করা হয়। যার বাজার মূল্য প্রায় ৬৫ কোটি টাকা। এসব জাল ব্যবহার সহ আহরণ নিষিদ্ধ জাটকা ধরার অপরাধে প্রায় সাড়ে ৩শ মামলাও দায়ের করেছে মৎস্য বিভাগ। এসময় সাড়ে ৩ হাজার অভিযানকালে ২০ টন জাটকা সহ অন্যান্য আরো ১৫ টন বিভিন্ন মাছ আটক করা হয়।
মৎস্য অধিদপ্তরের মতে, দেশে এখনো নিষিদ্ধ ঘোষিত কারেন্ট জাল ও বেহুন্দি জাল সহ অন্যান্য ক্ষতিকর মৎস্য আাহরণ উপকরনের সাহায্যে যে পরিমান জাটকা আহরণ হয়, তার এক-দশমাংশ রক্ষা করা গেলেও বছরে আরো অন্তত ১ লাখ টন ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি পেত। জাটকা আহরণ ও বিপণন নিষিদ্ধকালীন সময়ে দেশের ৬টি অভয়াশ্রমে পর্যায়ক্রমে সব ধরনের মৎস্য আহরণও নিষিদ্ধ থাকছে। মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, ¯্রােতের বিপরীতে প্রতিদিন ৭১ কিলোমিটার পর্যন্ত ছুটে চলতে সক্ষম ‘অভিপ্রয়াণী ইলিশ’ জীবনচক্রে স্বাদু পানি থেকে সমুদ্রের নোনা পানিতে এবং সেখান থেকে পুনরায় স্বাদু পানিতে অভিপ্রয়াণ করে। উপকূলের ৭ হাজার ৩৪৩ বর্গ কিলোমিটারের মূল প্রজনন ক্ষেত্রে মুক্তভাবে ভাসমান ডিম ছাড়ার পরে তা থেকে ফুটে বের হওয়া ইলিশের লার্ভা, স্বাদু পানি ও নোনা পানির নর্সারী ক্ষেত্রসমূহে বিচরন করে। এরা খাবার খেয়ে বড় হতে থাকে। নার্সারী ক্ষেত্রসমূহে ৭Ñ১০ সপ্তাহ ভেসে বেড়াবার পরে জাটকা হিসেব সমুদ্রে চলে যায় পরিপক্কতা অর্জনে। বঙ্গোপসাগরের বিভিন্ন এলাকায় ১২Ñ১৮ মাস অবস্থানের পরে পরিপক্ক হয়েই প্রজননক্ষম ইলিশ হিসেবে আবার স্বাদু পানির নার্সারী ক্ষেত্রে ফিরে এসে ডিম ছাড়ে।
মৎস্য বিজ্ঞানীদের সুপারিশে সমুদ্রে যাবার সময় পর্যন্ত যেসব এলাকায় জাটকা বিচরন করে খাদ্য গ্রহন সহ বেড়ে ওঠে, সেগুলোকে ‘গুরুত্বপূর্ণ নার্সারী ক্ষেত্র’ হিসেবে চিহিৃত করে ‘অভয়াশ্রম’ ঘোষনা করা হয়েছে। ষাটনল থেকে চর আলেকজান্ডার পর্যন্ত ১শ কিলোমিটার, মদনপুর থেকে চর ইলিশা হয়ে চর পিয়াল পর্যন্ত মেঘনার শাহবাজপুর চ্যানেলের ৯০ কিলোমিটার, ভেদুরিয়া থেকে চর রুস্তম পর্যন্ত তেতুুলিয়া নদীর ১শ কিলোমিটার, খেপুপাড়ার আন্ধারমানিক নদীর ৪০ কিলোমিটার, নি¤œ পদ্মার ১২০ কিলোমিটার এবং হিজলা ও মেহেন্দিগঞ্জের লতা, নয়া ভাঙ্গনী ও ধর্মগঞ্জ নদীর মিলনস্থলের ৬০ কিলোমিটার সহ মোট ৬টি অভয়াশ্রমে নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে মৎস্য আহরণ নিষিদ্ধ করায় উৎপাদন বাড়ছে। পাশাপাশি ইলিশের প্রজনন ক্ষেত্র ও মাইগ্রেশন পথ নির্বিঘœ রাখা সহ সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদের মজুত ও জীব বৈচিত্রকে সমৃদ্ধ করতে ইতোমধ্যে নিঝুম দ্বীপ সংলগ্ন ৩ হাজার ১৮৮ বর্গ কিলোমিটার এলাকাকে দেশের প্রথম ‘সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা বা মেরিন রিজার্ভ এরিয়া’ ঘোষণা করা হয়েছে। মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, বাংলাদেশের ইকাসিষ্টেমে সারা বছরই ৩০% ইলিশ ডিম বহন করে। এসব ইলিশ পরিপক্ক হয়ে ডিম ছাড়ে। যে ডিমগুলো পুরুষ ইলিশ দ্বারা নিষিক্ত হয়ে থাকে, তা নতুন প্রজন্ম গঠন করে। গবেষনায় দেখা গেছে, নজরদারী বৃদ্ধির ফলে দেশে ইলিশপোনা-জাটকা’র উৎপাদন ২০১৫ সালে ৩৯ হাজার ২৬৮ কোটি থেকে ২০১৭ সালে ৪২,২৭৪ কোটিতে উন্নীত হয়। ২০২২ সালের প্রজনন মৌসুমে দক্ষিণ উপকূল সহ সংলগ্ন অভ্যন্তরীন নদ-নদীতে প্রায় ৮৪% মা ইলিশ ডিম ছাড়ে। এরমধ্যে ৫২ ভাগ মা ইলিশ ২২ দিনের মূল প্রজননকালীন সময়ে এবং আরো ৩২% ডিম ছাড়ারত ছিল। যা ছিল অগের বছরের প্রজননকালের চেয়ে প্রায় ২.৪৫% বেশী। ফলে ঐ বছর ৪৩ হাজার কোটিরও বেশী জাটকা ইলিশ পরিবারে যুক্ত হয়েছে বলে মৎস্য গবেষনা ইনস্টিটিউট এর দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে। জাটকা আহরণ বন্ধে মৎস্য অধিদপ্তর থেকে বরিশাল সহ উপকূলভাগের সবগুলো উপজেলা থেকে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে।

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন    
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী মিরাজ মাহমুদ
 
বার্তা ও বানিজ্যিক কার্যালয়ঃ কুশলা হাউজ, ১৩৮ বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সড়ক,
সদর রোড (শহীদ মিনারের বিপরীতে), বরিশাল-৮২০০।
© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
Developed by NEXTZEN-IT