2:55 pm , April 5, 2025

বিশেষ প্রতিবেদক ॥ চাঁদ রাত থেকে ঈদের ৩য় দিন পর্যন্ত বরিশাল জেলার নৌপথ ও অভ্যন্তরীণ পরিবহনে ছিলো বাড়তি ভাড়া আদায়ের প্রতিযোগিতা। এ নিয়ে ঘাটে ঘাটে হয়রানির শিকার হয়েছেন বরিশালের বিভিন্ন উপজেলার অসংখ্য যাত্রী। এমন কি অভ্যন্তরীণ সড়কে গণপরিবহন এবং ইজিবাইক ও অটোরিকশার ভাড়াও গুনতে হয়েছে দ্বিগুণ হারে। সকলের একটাই অজুহাত – ঈদ উপলক্ষে বকশিস নিচ্ছি। সরেজমিনে ৩০ মার্চ চাঁদরাত থেকে ২ এপ্রিল বুধবার পর্যন্ত এই ভাড়তি ভাড়া আদায় করতে দেখা গেছে বরিশাল জেলাধীন নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনালের আটটি, রূপাতলী বাস টার্মিনালের ১৩ টি এবং চরকাউয়া বাস টার্মিনালের সাতটি রুটে। এছাড়াও নগরীর সড়কে ইজিবাইক ও অটোরিকশায় ঈদ বখশিশ আদায় হয়েছে। চরকাউয়া, বেলতলা, চাঁদমারি ও দপদপিয়া খেয়াঘাটে হঠাৎ করেই দ্বিগুণ ভাড়া হয়েছে। ২০ জনের পরিবর্তে ১৭ জন যাত্রী তুলে বলা হয়েছে, যাত্রী কম নিয়ে ভাড়া বেশি নেওয়া হয়েছে, এটা ঈদ উপলক্ষে শুধু। আবার বহুল আলোচিত বাবুগঞ্জের মীরগঞ্জ খেয়াঘাট ও বাকেরগঞ্জ উপজেলার দুধল ইউনিয়নের গোমা সেতু সংলগ্ন খেয়াঘাটে বাড়তি ভাড়া আদায় না করে অতিরিক্ত যাত্রী ও মোটরসাইকেল বহন করে চরম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা। সেখানে দুটি ট্রলার ও একটি ফেরী থাকলেও যাত্রীদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে বলে একাধিক অভিযোগ জানিয়েছেন এলাকাবাসী ও যাত্রীরা।
বরিশাল নগরীতে নথুল্লাবাদ থেকে চরকাউয়া খেয়াঘাট পর্যন্ত স্বাভাবিক ইজিবাইক ভাড়া মাথাপিছু ১৫ টাকা হলেও চাঁদ রাত থেকে তা ৩০ টাকা হয়েছে। আর অটোরিকশা ভাড়া হয়েছে আশি টাকা যা স্বাভাবিক সময়ে পঞ্চাশ টাকা বলে জানালেন টুঙ্গিবাড়িয়া ইউনিয়নের একজন যাত্রী ইকবাল। আবার নথুল্লাবাদ থেকে রূপাতলী ২০ টাকার পরিবর্তে ৩০ টাকা ভাড়া দিয়েছেন অনেকেই। তবে ইজিবাইক বা অটোরিকশার ঈদ উপলক্ষে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় যাত্রীদের ততটা কষ্ট দেয়নি, যতটা কষ্ট পেয়েছেন বাসচালক ও খেয়াঘাটের মাঝিদের আচরণে। খেয়া পারাপারে ইজারাদারদের স্বেচ্ছাচারিতার একাধিক অভিযোগ করেছেন হিজলা, মুলাদি ও বাকেরগঞ্জের ফরিদপুর ও দুধল ইউনিয়নের বাসিন্দারা। ঈদের দিন দুপুরে বাকেরগঞ্জের ডিসি রোড ও গোমা বাসস্ট্যান্ড থেকে আগত বরগুনার পথের দুজন যাত্রী মামুন তালুকদার ও মনি সিকদার বলেন, ঈদ উপলক্ষে ইজিবাইক ও অটোরিকশা চালকরা একটু বেশি ভাড়া চায়, এটা তারা বলেই নেয়। কিন্তু বাসচালক ও খেয়াঘাটের মাঝিদের আচারণতো রীতিমতো সন্ত্রাসী আচরণ। তারা সি-িকেট করে ভাড়া রেট করে নিয়েছে। মামুন বলেন, বাকেরগঞ্জের গোমা বাস টার্মিনাল থেকে চরকাউয়া খেয়াঘাট পর্যন্ত বাস ভাড়া ৪০ টাকা। গত ১ মার্চ থেকে তারা তা পাঁচ টাকা বাড়িয়ে ৪৫ টাকা করে রেখেছে। আর আজ ঈদের দোহাই দিয়ে ৫০ টাকা ভাড়া নিয়েছে।
মনি সিকদার বলেন, চরকাউয়া খেয়াঘাটেও পাঁচ টাকা বাড়তি ভাড়া দিয়ে পার হলাম। এখন রূপাতলী বাস টার্মিনালে যাবো। ইজিবাইকেও বাড়তি দিতে হবে এবং বরগুনা পৌঁছে সেখান থেকে গ্রামে ঘর পর্যন্ত আরো কত বাড়তি দিতে হবে তা বলা মুশকিল। আমরা দুজনেই বাহেরচরে ইটভাটার শ্রমিক। উপার্জন যা করেছি সবইতো বাড়তি ভাড়া দিতে শেষ হয়ে যাচ্ছে বলে জানালেন মনি সিকদার।
এদিকে গোমা সেতু সংলগ্ন খেয়াঘাটে চরম বিশৃঙ্খলার অভিযোগ জানালেন দুধল ইউনিয়নের সুন্দরকাঠী গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল হক। তিনি স্থানীয় মোল্লা বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন। বললেন, গত ডিসেম্বরের আগেও একটা শৃঙ্খলা ছিলো ওখানে। চরাদি ইউনিয়ন অংশে টোলঘর ছিলো। ১০ টাকা ভাড়া আদায় হয় মাথাপিছু। এখনো তাই হচ্ছে, তবে আগে যাত্রী যে-কজনই হোক কাউকে ঘাটে বেশি সময় দাঁড় করিয়ে রাখা হতোনা। ১০-১৫ জন হলেই ট্রলার ছেড়ে দেওয়া হতো। বর্তমানে টোলঘর নিয়ন্ত্রণ করছে ওপারে গোমা অংশের দুধল ইউনিয়নের নেতারা। তারা ৩০/৪০ জন না হলে ট্রলার ছাড়ছেনা, আবার ফেরীও চার-পাঁচটি গাড়ি নিয়ে পার হতে দেয়না। উপচে পরা ভিড় না হলে ট্রলার বা ফেরী কোনাটাই চলতে দেয়না বলে একাধিক অভিযোগ পাওয়া গেলো গোমা সেতু সংলগ্ন এই খেয়াঘাটের ইজারাদারদের বিরুদ্ধে।
সরজমিনে ২ মার্চ দুপুরের পর এই অভিযোগের সত্যতার প্রমাণও পাওয়া গেল। প্রতিবেদকের চোখের সামনেই ফেরী প্রায় পরিপূর্ণ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। তারপরও চাপাচাপি করে আরো দুটি গাড়ির জায়গা তৈরি করা হয়েছে। পাশেই ট্রলারে উপচে পরা ভিড়ের মধ্যেই যাত্রীদের নীচে ইঞ্জিনের পাশে মুড়িবস্তা বানিয়ে দাঁড় করে রাখা হয়েছে। উপরে চারটে মোটরসাইকেল নেওয়া হয়েছে। আরো দুটো মোটরসাইকেল এর জায়গা তৈরি করার চেষ্টা যাত্রীদের ঠেলে নীচে ইঞ্জিনের কাছে পাঠানো হচ্ছে। যেখানে আগে থেকেই মহিলা যাত্রীদের দাঁড়িয়ে থাকা। এসব দেখে একজন যাত্রী প্রতিবাদ জানালেন। তিনি ট্রলার ছাড়তে বলা মাত্রই মাঝি রীতিমতো তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন। মাঝি বললেন, আপনার পছন্দ না হলে নেমে যান, টোলঘর থেকে না বললে আমি যেতে পারবোনা। তাহলে আমার ট্রলার বাদ দিয়ে অন্য ট্রলার দেবে।
এসময় ঐ যাত্রীসহ কয়েকজন নেমে ফেরীতে উঠলেন। এভাবে মোটরসাইকেল বোঝাই ঝুকিপূর্ণ নদী পার হতে চাননা তারা। এটি নিয়ে কেন লেখেন না আপনারা বলে উল্টো প্রশ্ন তোলেন। এসময় আরো কয়েকজন বলেন, এ-ই ব্রীজ টি গতবছর ডিসেম্বরে যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়ার কথা ছিলো। অথচ এখন পর্যন্ত দুটো স্পাম বসেনি। দুইপাশে সড়কসহ সব কাজ শেষ শুধু এই স্পাম দুটোর জন্য আমাদের এতো ভোগান্তি বলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন বক্তা।
এদিকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় ও ইজারা দেওয়া বাতিল করার দাবীতে ঈদের পরদিন সকালে চরমোনাই ইউনিয়নের বাসিন্দারা মানববন্ধন করেছে বেলতলা খেয়াঘাটের চরমোনাই অংশে দাঁড়িয়ে। এখানে প্রায় প্রতিদিনই সন্ধ্যার পর ভাড়া চারগুণ বেড়ে যায় এবং ফেরী চলাচল বন্ধ রেখে ইজিবাইক ও তিনচাকার যানবাহন ট্রলারে পারাপার করা হয়। একই অভিযোগ বাবুগঞ্জ উপজেলার মীরগঞ্জ খেয়াঘাটের ইজারা নিয়ে। এরা ট্রলারে অতিরিক্ত যাত্রী পারাপার ও চারগুণ বেশি ভাড়া আদায় করছে। প্রশাসন এসে জরিমানা করে যাওয়ার পর পরই দ্বিগুণ ভাড়া আদায় করে তা পুঁছিয়ে নেয়ার অভিযোগ মীরগঞ্জ খেয়াঘাটের ইজারাদারদের বিরুদ্ধে।