4:00 pm , March 18, 2025

ঐতিহ্য ধরে রেখেছে চারশত বছরের পুরানো
আরিফ আহমেদ, বিশেষ প্রতিবেদক ॥ প্রতিদিন কিশোর, যুবক ও প্রবীণসহ প্রায় ২০০ মানুষের মিলনমেলা এখানে। এদের মধ্যে বিভিন্ন বয়সের এতিম হাফেজি শিক্ষার্থী ৭০ জন। যাদের বয়স ৭ থেকে ২০ এর মধ্যে। এছাড়াও রয়েছে পথচারী মুসাফির। কয়েকজন গ্রামবাসীও আছেন যারা নিজেদের ঘর থেকে বিভিন্ন ইফতার সামগ্রী নিয়ে শরীক হয়েছেন এতিম ও পথচারী মুসাফিরদের সাথে ইফতার করতে। প্রতিবছর রমজান মাসের এই মিলনমেলা সৃষ্টি হয় বাংলাদেশের বেশিরভাগ মসজিদকে কেন্দ্র করে। বরিশালের মসজিদগুলোও এর ব্যতিক্রম নয়। ইতিহাস ঐতিহ্যের সাক্ষী প্রায় সাড়ে চারশ বছরের পুরাতন মুগা খান জামে মসজিদেও যুগ যুগ ধরে এভাবেই ইফতার আয়োজন সাজানো হয় প্রতিবছর। আর গ্রামবাসী সম্মিলিতভাবে এমন আয়োজন অব্যাহত রেখেছেন। নামের সাথেই রয়েছে যার ঐতিহাসিক ঘ্রাণ। এই মসজিদটির অবস্থান বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলার চরামদ্দি ইউনিয়নের মিয়ার হাট এলাকায়। বরিশাল থেকে কীর্তনখোলা নদী পার হলেই ওপারে চরকাউয়া বাস টার্মিনাল। বাসে চেপে গোমা-দুমকী সড়কের চরামদ্দি বাজার বা মিয়ার হাট। এই মিয়ার হাট বা মিয়া বাড়ির হাটকে ঘীরেই বাকেরগঞ্জ উপজেলার চরামদ্দি ইউনিয়ন পরিষদের কার্যক্রম। এখানে মিয়ার হাটের একটু আগে ১০/১২ গজ দূরত্বে সড়কের পূর্ব পাশে প্রাচীন মুসলিম স্থাপত্যশিল্পের অন্যতম নিদর্শন মুগা খান জামে মসজিদটি এই সড়কে চলাচলকারী সকলের কাছে খুবই পরিচিত।
প্রায় সাড়ে ৪শ বছর আগে স্থানীয় জমিদার মুঙ্গা খান এই মসজিদটি নির্মাণ করেন। ১৭০০ খৃষ্টাব্দে মুসলিম শাসনামলে স্থাপিত এই মুগা খান মসজিদ, যা আজও স্মরণ করিয়ে দেয় মুসলিম স্থাপত্য ও ঐতিহ্যের কথা। তবে বহুবার সংস্কারের ফলে অনেক নিদর্শন মুছে ফেলা হয়েছে। অনেকগুলো নিজে থেকেই ক্ষয় হতে হতে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আবার অনেক দামী উপকরণ চুরি হয়ে যাওয়ায় মুগা খান মসজিদের ঐতিহ্য নষ্ট হয়েছে বলে জানালেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
১৫ মার্চ শনিবার বিকালে গোমা যাওয়ার পথে মুগা খান মসজিদের সৌন্দর্য দেখে থমকে যেতে হয়। বাদ আছর মসজিদটি ঘুরে দেখার অবসরে পরিচয় হয় মসজিদের ঈমাম মাওলানা আবুল বাসার এবং মসজিদ কমিটির সভাপতি মিজানুর রহমান চুন্নু সিকদার এর সাথে। তাদের আমন্ত্রণে এতিমশিশু কিশোর ও যুবকসহ চরামদ্দি গ্রামের মানুষের সাথে ইফতার করার সুযোগ হয় এই মুগা খান মসজিদের দ্বিতীয় তলায়। স্থানীয়দের সাথে কথা বলে ও
সরেজমিনে দেখা যায়, বরিশাল-গোমা-দুমকি সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এই মুগা খান জামে মসজিদ বরিশালের প্রাচীন ঐতিহাসিক নিদর্শনের অন্যতম একটি নিদর্শন। অনিন্দ্য সুন্দর মসজিদটির প্রধান আকর্ষণ মসজিদের পূর্ব ও পশ্চিমপাশের দেয়ালে রয়েছে ৪টি করে ৮টি মিনার। গম্বুজ ও মিনারের শিরোভাগে একটি করে পিতলের কলস সংযুক্তি ছিল। কিন্তু বর্তমানে মাত্র ৩ টি কলস লক্ষ্য করা যায়। ৫টি চুরি হয়ে গেছে। মসজিদের কলসগুলোতে এক সময় স্বর্ণের প্রলেপ ছিল বলে জানা যায়। কিন্তু কালের স্রোতে তা মুছে গেছে। সেই আমলের একটি রেহাবিও মসজিদের ভিতরে সংরক্ষিত আছে। রেহাবির মধ্যাংশে ক্যালিওগ্রাফি স্টাইলে সূরা ইখলাস লিখিত। তিন গম্বুজবিশিষ্ট এই মসজিদের মাঝেরটি অপেক্ষাকৃত বৃহৎ। মেঝ থেকে এর উচ্চতা প্রায় ২৫ ফুট। মসজিদের ঠিক ওপরে একই সারিতে অবস্থিত। মূল মসজিদটি আয়তাকার। উত্তর দক্ষিণে এর দৈর্ঘ্য ৩৬ ফুট, পূর্ব পশ্চিমে প্রস্থ ১৮ ফুট। দেয়ালের প্রশস্ততা ৩৫ ইঞ্চি। ইট, চুন, সুরকি দিয়ে নির্মিত। মসজিদের পূর্বদিক দিয়ে ৩টি খিলান বা প্রবেশ পথ আছে। দরজার উপরিভাগে চমৎকার নকশাখচিত রয়েছে। এর উচ্চতা ৬ ফুট, চওড়া ৩ ফুট। উত্তর ও দক্ষিণ দিকে দু’টি জানালা আছে। আলো বাতাস প্রবেশের জন্যই এরূপ ব্যবস্থা। জানালার উপর-নীচের দৈর্ঘ্য সাড়ে ৪ ফুট এবং চওড়া ৪ ফুট। পশ্চিম দেয়ালে একটি মিহরাব। এর উপরিভাগ ফুল পাতার নকশায় আচ্ছাদিত। এছাড়াও বিভিন্ন জায়গায় অলঙ্করণের ছাপ রয়েছে। মসজিদটির প্রধান আকর্ষণ ভিতরের চার দেয়ালের মাঝবরাবর এক ফুট চওড়া বেড় দিয়ে তার ভিতর পবিত্র কুরআনের আয়াত লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। সূরা ফাতিহা, ইখলাস এবং সূরা আর রহমান লিপিবদ্ধ দেয়ালের বর্তমান সংস্করণ। আগের পুরাতন দেয়াল ভেঙে টেরিকাটাগুলো সরিয়ে ফেলা হয়েছে বলে জানান বাসিন্দারা। তাদের দাবী টেরিকাটা বা অলংকৃত নকশায় নামাজীদের দৃষ্টি আকর্ষণ হতো, তাই সেগুলো সরিয়ে নতুন নকশা করা হয়েছে। তাছাড়া মসজিদও আগের চেয়ে বড় করা হয়েছে এখন।
জানা যায়, ২০০১ সালে পুরাতন মসজিদের পলেস্তারা খসে পড়ার উপক্রম হলে এটিকে প্রথম সংস্কারের প্রয়োজন হয়। মুল মসজিদ ভবনের সবকিছু ঠিক রেখে এটি ঐসময় সংস্কার করা হয়। তখনও ভিতরের টেরিকাটা বা ক্যালিগ্রাফি ঠিক ছিলো। পরবর্তীতে ২০১১ সালে বর্ধিত ভবন ও তৃতীয় তলা পর্যন্ত মসজিদের নির্মাণ করা হয়। এসময় ভিতরের ক্যালিগ্রাফিও বদলে দেয়া হয় এবং পবিত্র কুরআন থেকে আয়াতগুলো নতুন করে লেখা হয়েছে বলে জানা যায়।
বর্তমানে মুগা খান মসজিদের সামনে পুকুরটি আরো সুন্দর করা হয়েছে। উত্তরে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসন ব্যবস্থা, শ্রেণীকক্ষ, শিক্ষকদের কক্ষ ইত্যাদি সাজানো হয়েছে। তৈরি হয়েছে পৃথক তিনতলা প্রশাসনিক ভবন। ঈমাম মাওলানা আবুল বাসার জানালেন, এখন পর্যন্ত এই মাদ্রাসা থেকে হাফেজি শেষ করে উচ্চ শিক্ষার জন্য গিয়েছেন ৮৫ জন শিক্ষার্থী। এদের কেউ ছারছিনা, কেউ চরমোনাই, আবার হাটহাজারী মাদ্রাসায় পড়াশুনা করছেন বলে জানান তিনি।
মসজিদ কমিটির সভাপতি মিজানুর রহমান চুন্ন সিকদার বলেন, ২০০১ সালে মসজিদ সংলগ্ন ক্বেরাতুল কোরআন হাফিজিয়া মাদরাসা স্থাপিত হয়। মাদরাসার বর্তমান ছাত্রসংখ্যা ৭৫ জন। কয়েকবছর আগে পূর্ব, উত্তর, দক্ষিণ দিকে মসজিদের জায়গা সম্প্রসারণ করে মসজিদের একটি দোতলা ভবন করা হয়েছে যেখানে এখন একসাথে ১২০০ মুসল্লী নামাজ আদায় করতে পারে। আর মুল মসজিদের ভিতরে দুটো সারিতে ৫০ জন মুসল্লী নামাজ আদায় করেন। মসজিদের উত্তর-পূর্ব পাশেই ইমাম, মোয়াজ্জেনের থাকার জন্য ভবন নির্মাণ করে গেছেন মুগা খান।
মসজিদের দক্ষিণ পাশে প্রধান প্রবেশদ্বার। এখানেই রয়েছে মুগা খান সহ দক্ষিণ বাংলার বিখ্যাত দরবেশ ইয়াকীন শাহ, দানবীর হাজী আছমত আলী খানসহ অনেকে কবর। মসজিদের পূর্ব ফটক বরাবর আঙিনা। এখানে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। আঙিনার পূর্ব দিকেই পুকুর। শান বাঁধানো ঘাট রয়েছে পুকুরে। পুকুরটি মুঙ্গা খান নিজ তত্ত্বাবধানে খনন করেন। পুকুরটি আয়তনে ছোট হলেও নানা বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। সূচনালগ্নে এর চারপাশ উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা ছিল। তবে বর্তমানে দেয়াল নিশ্চিহৃ প্রায়। ভগ্নাবশেষ অবশিষ্ট আছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো মসজিদের এই পুকুরের তলদেশও পাকা করা হয়েছিল। এর কারণ সম্পর্কে সঠিক কিছু জানা যায়নি। তবে বর্তমানে পুকুরের নি¤œভাগের পাকা ফ্লোরের ওপর কাদামাটির আস্তরণ পড়েছে। তাই পাকা অংশ দেখতে হলে কর্দমাক্ত মাটি উঠিয়ে আরো গভীরে যেতে হবে বলে জানান গ্রামবাসী।