4:43 pm , March 4, 2025

বিশেষ প্রতিবেদক ॥ ব্যাপক সাফল্যের মধ্যে দিয়ে মৎস্য সম্পদ রক্ষায় ক্ষতিকর বেহুন্দি জাল নিষিদ্ধ, কারেন্ট জাল সহ ক্ষতিকর আহরণ উপকরনের বিরুদ্ধে বরিশালে বিশেষ কম্বিং অপারেশনের সম্পন্ন হয়েছে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে জেলা এবং উপজেলা প্রশাসন সহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় মৎস্য অধিদপ্তর গত ১২ জানুয়ারী থেকে মোট ৪টি ধাপে বিশেষ কম্বিং অপারেশন শুরু করে। জেলা ও মহানগর পুলিশ ছাড়াও নৌ পুলিশ, কোষ্টগার্ড, নৌ বাহিনী এবং র্যাব ও আনসার বাহিনী এ কম্বিং অপারেশনে অংশ নেয়। জানুয়ারীর শুরু থেকে ফেব্রুয়ারীর শেষদিন পর্যন্ত এ অপারেশনে ব্যাপক সাফল্যের কথা জানিয়েছে মৎস্য অধিদপ্তরের বরিশাল দপ্তরের কর্মকর্তারা। একইসাথে দেশের ৬ষ্ঠ অভায়শ্রম, বরিশালের হিজলা, মেহদিগঞ্জ এবং সদর উপজেলার কালাবদর, গজারিয়া ও মেঘনা নদীর প্রায় ৮২ কিলোমিটার এলাকায় ১ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত সবধরনের মৎস্য আহরণে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হয়েছে। একইভাবে গত নভেম্বর থেকে ষাটনল থেকে চর আলেকজান্ডার পর্যন্ত ১শ কিলোমিটার, মদনপুর থেকে চর ইলিশা হয়ে চর পিয়াল পর্যন্ত শাহবাজপুর চ্যানেলের ৯০ কিলোমিটার, চর ভেদুরিয়া থেকে চর রুস্তম পর্যন্ত তেতুুলিয়া নদীর ১শ কিলোমিটার এবং নড়িয়া থেকে ভেদরগঞ্জ নি¤œ পদ্মার ১২০ কিলোমিটার এলাকার অভয়াশ্রমগুলোতে পর্যায়ক্রমে সব ধরনের মৎস্য আহরণ নিষিদ্ধ ছিল। খেপুপাড়ার আন্ধারমানিক নদীর ৪০ কিলোমিটার এলাকায়ও জানুয়ারীÑফেব্রুয়ারী মাসে ইলিশ সহ সব ধরনের মৎস্য আহরন নিষিদ্ধ থাকায় প্রতি বছরই আমাদের জাতীয় মাছ ইলিশ সহ অন্যান্য মাছের উৎপাদন বাড়ছে।
অপরদিকে গত ১ নভেম্বর থেকে বরিশাল সহ সারা দেশেই জাটকা আহরনে নিষেধাজ্ঞা আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত বহাল থাকছে। এসব পদক্ষেপের ফলে গত অক্টোবর-নভেম্বরের ২২ দিনের মূল প্রজনন মৌসুমে ইলিশের নিষিক্ত ডিম থেকে লার্ভা হয়ে যে জাটকা উৎপাদন হয়েছে, তার পাশাপাশি অন্যান্য মাছও অতি আহরন থেকে রক্ষা পাবে বলে আশার কথা জানিয়েছে বরিশাল মৎস্য অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় উপ পরিচালক।
ইলিশের প্রজনন ক্ষেত্র ও মাইগ্রেশন পথ নির্বিঘœ রাখা সহ অন্যান্য মাছের আবাসস্থল এবং বিচরন নিরাপদের পাশাপাশি সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদের মজুত ও জীব বৈচিত্রকে আরো সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে ইতোমধ্যে নিঝুম দ্বীপ সংলগ্ন ৩ হাজার ১৮৮ বর্গ কিলোমিটার এলাকাকে দেশের প্রথম ‘সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা বা মেরিন রিজার্ভ এরিয়া’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। জাতীয় অর্থনীতিতে ইলিশের একক অবদান এখন ১%-এরও বেশী। আর মৎস্য খাতে অবদান প্রায় ১২%। সারা বিশ্বে আহরিত ইলিশের প্রায় ৬০% এখন বাংলাদেশে উৎপাদন ও আহরিত হচ্ছে।
প্রতিদিন ¯্রােতের বিপরীতে ৭১ কিলোমিটার পর্যন্ত ছুটে চলা অভিপ্রয়াণী মাছ ইলিশ জীবনচক্রে স্বাদু পানি থেকে সমুদ্রের নোনা পানিতে এবং সেখান থেকে পুনরায় স্বাদু পানিতে অভিপ্রয়াণ করে। মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, উপকূলের ৭ হাজার ৩৩৪ বর্গ কিলোমিটারের মূল প্রজনন ক্ষেত্রে গত আশি^নের বড় পূর্ণিমার আগে পড়ে মুক্ত ভাসমান অবস্থায় ছাড়া ডিম থেকে ফুটে বের হয়ে ইলিশের লার্ভা, স্বাদু পানি ও নোনা পানির নার্সারী ক্ষেত্রসমূহে বিচরন করে খাবার খেয়ে বড় হচ্ছে। বরিশাল সহ সন্নিহিত ৬টি অভয়াশ্রমের ‘নার্সারী ক্ষেত্র’সমূহে ৭Ñ১০ সপ্তাহ ভেসে বেড়াবার পরে এরা জাটকা হিসেব সমুদ্রে গিয়ে পরিপক্কতা অর্জন করে থাকে। বঙ্গোপসাগরের বিভিন্ন এলাকায় ১২Ñ১৮ মাস অবস্থানের পরে পরিপক্ক হয়েই পূর্র্ণাঙ্গ ইলিশ হিসেবে প্রজননের লক্ষ্যে আবার স্বাদু পানির নার্সারী ক্ষেত্রে ফিরে এসে ডিম ছাড়বে।
২০১৬ সাল থেকে বরিশাল সহ উপকূলীয় এলাকায় ‘বিশেষ কম্বিং অপারেশন’ পরিচালিত হলেও এবার ইলিশ সহ অন্যান্য মৎস্য সম্পদের অধিকতর সুরক্ষায় ৪টি ধাপে এ অপারেশন শুরু হয়েছিল গত ১২ জানুয়ারী থেকে। প্রথম ধাপে ১২ থেকে ১৯ জানুয়ারীর পরে ২৫ থেকে ৩১ জানুয়ারীর দ্বিতীয় ধাপ এবং পরবর্তিতে ৯ থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারী এবং সর্বশেষ ২১ থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত এ কম্বিং অপারেশন অব্যাহত ছিল।
এ কম্বিং অপারেশনে ক্ষতিকর বেহুন্দি জাল, খুটা জাল, কারেন্ট জাল এবং সাম্প্রতিককালে মৎস্য সম্পদের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর ‘চায়না দেউরী’ জাল ধ্বংস করা হয়েছে বলে মৎস্য অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক জানিয়েছেন।
মৎস্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রায় ২হাজার অভিযানের পাশাপাশি ৩ শতাধিক ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার নিষিদ্ধ বেহুন্দী জাল ছাড়াও প্রায় ১ কোটি ২ লাখ মিটার কারেন্ট জাল সহ আরো প্রায় ১০ হাজার অন্যান্য নিষিদ্ধ জাল আটক ও বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। আইন অমান্যের অভিযোগে এসময়ে প্রায় পৌনে ৩শ মামলা দায়ের ছাড়াও ভ্রাম্যমান আদালত ২৩ জেলেকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ডাদেশ দিয়েছে। অভিযানকালে ৭টন নিষিদ্ধ জাটকা ছাড়াও আরো ৬ টনের মত বিভিন্ন ধরনের মাছ আটক করে বাজেয়াপ্ত করা হয়।
বরিশালের ৬টি অভয়াশ্রম সহ ১৩২টি নদ-নদীর প্রায় আড়াই হাজার কিলোমিটার নদ-নদীর সাড়ে ১২শ কিলোমিটার নৌপথেও এ কম্বিং অপারেশনের আওতায় ছিলো বলে মৎস্য অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল মহল জানিয়েছে।
মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, বাংলাদেশের ইকাসিষ্টেমে সারা বছরই ৩০% ইলিশ ডিম বহন করে পরিপক্ক হয়ে তা নিষিক্ত করে থাকে। যে ডিমগুলো পুরুষ ইলিশ দ্বারা নিষিক্ত, তা নতুন প্রজন্ম গঠন করে। নজরদারী বৃদ্ধির ফলে দেশে ইলিশপোনা-জাটকা’র উৎপাদন ২০১৫ সালে ৩৯ হাজার ২৬৮ কোটি থেকে ২০১৭ সালে ৪২,২৭৪ কোটিতে উন্নীত হয়। এমনকি ২০২২ সালের প্রজনন মৌসুমে বরিশাল উপকূল সহ সংলগ্ন অভ্যন্তরীণ নদ-নদীতে প্রায় ৮৪% মা ইলিশ ডিম ছাড়ে। এরমধ্যে ৫২ ভাগ মা ইলিশ ২২ দিনের মূল প্রজননকালীন সময়ে এবং আরো ৩২% ডিম ছাড়ারত ছিল । যা আগের বছরের প্রজননকালের চেয়ে প্রায় ২.৪৫% বেশী বলে মৎস্য গবেষনা ইনস্টিটিউট-এর দায়িত্বশীল মহল জানিয়েছে । ফলে ওই বছর ৪৩ হাজার কোটিরও বেশী জাটকা ইলিশ পরিবারে যুক্ত হয় বলে ইনস্টিটিউট এর দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে।