3:52 pm , January 27, 2025

বিশেষ প্রতিবেদক ॥ প্রকৃতিক দুর্যোগ ও পরিবেশগত ঝুঁকিপূর্ণ বরিশালে দেড় শতাধিক বছরের পুরনো ‘ধাপ’ ও ‘সারজন’ পদ্ধতির সাথে কৃষি গবেষনা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত ‘মাচান পদ্ধতির কৃষি প্রযুক্তি ক্রমে জনপ্রিয়তা অর্জন করছে। এ পদ্ধতিতে পতিত জলাশয় সহ পুকুর ও দীঘিতে বছরের যেকোন সময়ে বিভিন্ন ধরনের বীজ উত্তোলন সহ সবজি উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে। ফলে বরিশালের বদ্ধ জলাভূমি ও জলাশয় কৃষিকাজে অধিকতর ব্যবহার নিশ্চিত হচ্ছে। কৃষকদের স্বচ্ছলতা বাড়ছে। চলতি রবি মৌসুমে বরিশালে যে ১৬ লক্ষাধীক টন শীতকালীন সবজি উৎপাদনের লক্ষ্যে প্রায় ৮০ হাজার হেক্টরে সবজি আবাদ সম্পন্ন হচ্ছে তার অনেকটাই কৃষকরা ভাসমান পদ্ধতি অনুসরণ করছেন।
গত অক্টোবরে ঘূর্ণিঝড় ‘রিমাল’এর বয়ে আনা প্রবল বর্ষণে আমন ও অউশের ক্ষতির সাথে শীতকালীন সবজির আবাদকে বিলম্বিত করে। অনেক সবজি বীজতলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু ধাপ, মাচান ও সারজান পদ্ধতিতে যেসব বীজতলা তৈরী হয়েছিল তা প্রায় অক্ষত ছিল।
এমনকি এ পদ্ধতি অনুসরন করায় এখন ভাটি এলাকা বরিশাল কৃষি অঞ্চলে শীতকালীন সবজির আবাদ আগের মত বিলম্বিত হচ্ছেনা। অতীতে বর্ষা ও প্লাবনমুক্ত হওয়ার পরেও শীতকালীন সবজির বীজ উত্তোলন করে আবাদ থেকে ফসল উৎপাদন পর্যন্ত অনেক বাড়তি সময় লেগে যেত। ফলে কৃষকরা সবজির ভাল দাম পাচ্ছিলেন না।
অসংখ্য নদী-খাল বেষ্টিত বরিশাল কৃষি অঞ্চল দেশের অন্য এলাকার তুলনায় কিছুটা নিচু হওয়ার পাশাপাশি এখান থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু দেরীতে বিদায়ের কারণে বর্ষাও বিলম্বিত হয়ে থাকে। ফলে শীতকালীন সবজি আবাদের সময় পেরিয়ে গেলেও অনেক জমিতে পানি আটকে থাকায় আবাদ বিলম্বিত হয়।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষনা কাউন্সিলের মতে, দেশে মধ্য-নিচু থেকে অতি নিচু জমির পরিমান প্রায় ৩০ লাখ হেক্টর। যা মোট আবাদী জমির প্রায় ২১ ভাগ। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েই ‘বাংলাদেশ কৃষি গবেষনা ইনস্টিটিউট-বারী’ ‘ভাসমান বেড ও মাচা পদ্ধতি’ উদ্ভাবন করেছে। ইতোমধ্যে বরিশাল অঞ্চলের বিভিন্ন এলকায় এ পদ্ধতিতে বিভিন্ন ধরনের বীজ উৎপাদন সহ শীতকালীন সবজি উৎপাদনে আশার আলো দেখাচ্ছে।
কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের মতে, জলবায়ুর বিরুপ প্রভাবে অনিয়মিত ও অসময়ের বৃষ্টিপাতে প্লাবন সহ নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশংকা বাড়ছে। তাই প্রতিকূল পরিবেশে চাষযোগ্য এ পদ্ধতির সম্প্রসারণ জরুরী বলে মনে করছেন কৃষি বিজ্ঞানীরা।
গত দেড়শ বছর ধরে বরিশালের বানরীপাড়া, উজিরপুর ও নেছারাবাদ সহ পাশ^বর্তি কোটালীপাড়ার কয়েকটি বিল অঞ্চলে ‘ভাসমান ধাপ পদ্ধতিতে সবজিসহ নানা ধরনের বীজ উত্তোলন হচ্ছে। ফলে এসব বীজতলা থেকে বর্ষা বিদায়ের সাথেই শীতকালীন সবজির চারা উত্তোলন করে রোপন সম্ভব হওয়ায় অপেক্ষাকৃত কম সময়ে সবজির আবাদ ও উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে। এতে করে জমিতে আদ্রতা বিরাজ করার সাথে শীতকালীন সবজি সহ বিভিন্ন রবি ফসলের আবাদ সহজতর হচ্ছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মতে প্রতিবছর দেশে যে ২ কোটি টনেরও বেশী শীতকালীন ও গ্রীষ্মকালীন সবজি উৎপাদন হচ্ছে তারমধ্যে বরিশাল কৃষি অঞ্চলে উৎপাদিত সবজির পরিমান প্রায় ২৫ লাখ টনের কাছাকাছি। বিশে^র শতাধীক দেশে বর্তমানে বাংলাদেশের যে কৃষি পণ্য রপ্তানী হচ্ছে সেখানে বরিশাল অঞ্চলের সবজি রয়েছে। এরমধ্যে শীতকালীন সবজিই অন্যতম প্রধান কৃষিপণ্য। আগামীতে এ বাজার আরো সম্প্রসারণের লক্ষ্যে সরকার দেশে সবজির আবাদে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে আসছে।
চলতি রবি মৌসুমে বরিশাল অঞ্চলে অন্তত ১৪ লাখ হেক্টরে বোরোধান ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের শীতকালীন সবজি এবং তেলবীজ, গোল আলু, মিষ্টি আলু, গম ও ভুট্টার পাশাপাশি নানা ফসল আবাদ হয়েছে। এরমধ্যে শুধু ৪ লক্ষাধিক হেক্টরে বোরো ধান আবাদের মাধ্যমে প্রায় ১৬ লাখ টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্য রয়েছে। সবজি বীজের একটি বড় অংশই উত্তোলন হয়েছে ধাপ ও মাচান পদ্ধতিতে।