4:01 pm , January 15, 2025

তিন্নি হত্যা মামলায় খালাস পেয়ে আলোচনায় !
জসিম জিয়া ॥ বহুল আলোচিত মডেল কন্যা তিন্নি হত্যা মামলা থেকে খালাস পাওয়ায় দীর্ঘ ২২ বছর পর নতুন করে আলোচনায় এসেছেন সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক অভি। বর্তমানে তিনি কানাডায় অবস্থান করছেন। তাকে ঘিরে এখন বরিশালে চলছে নানা গুঞ্জন। অনেকেই বলছেন হত্যা মামলায় অব্যাহতি পাওয়ায় বাংলাদেশে আসতে কোন ধরণের বাধা নেই সাবেক এ ছাত্রনেতার। আর দেশে এসেই হয়তো রাজনীতির মাঠে সক্রিয় হবেন, প্রস্তুতি নেবেন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের। গোলাম ফারুক ১৯৯৬ সালের সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তৎকালীন উজিরপুর-বাবুগঞ্জ উপজেলা নিয়ে গঠিত বরিশাল-২ আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। এরপর ২০০১ সালের অস্টম সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও বর্তমান বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের কাছে হেরে যান। ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আসন পুনর্বিন্যাস করা হয়। এরফলে উজিরপুরের সাথে যুক্ত হয় বানারীপাড়া আর বাবুগঞ্জ চলে যায় মুলাদীর সাথে।
সাবেক এমপি গোলাম ফারুক অভিকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা চলছে উজিরপুর-বানারীপাড়ায়। কারণ তার গ্রামের বাড়ী উজিরপুর উপজেলার ধামুরা গ্রামে। সঙ্গত কারণে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি এখান থেকে প্রার্থী হতে পারেন। যদি গোলাম ফারুক অভি বরিশাল-২ আসন থেকে নির্বাচন করেনই তাহলে কোন দল থেকে করবেন বিএনপি নাকি জাতীয় পার্টি এসব নিয়েও চলছে চুলছেড়া বিশ্লেষন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন সবশেষ অভি এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন জাতীয় পার্টি থেকে। কিন্তু এরশাদবিহীন দলটির অবস্থা এখন অনেকটাই নাজুক। ফলে নির্বাচনী মাঠে টিকতে হলে বিএনপির মত বড় কোন দলে ভীড়তে হবে সাবেক এ সংসদ সদস্যকে। এক্ষেত্রে বিএনপিতে আসারই সম্ভাবনা বেশি দেখছেন কেউ কেউ। কারণ গোলাম ফারুক অভির রাজনীতির হাতেখড়ি হয়েছিল ৯০দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায়। ওই সময় তিনি ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। কিন্তু ১৯৯০ সালে ডাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ছাত্রদল দুইভাগে বিভক্ত হয়। এর একটি অংশের নেতৃত্বে ছিলেন অভি। তার সাথে তৎকালীন সরকারের গোপন যোগাযোগ রয়েছে এই অভিযোগে একই বছরের ২৫ নভেম্বর তাকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়। এর ৬ বছর পর ১৯৯৬ সালের ৯ মে তিনি জাতীয় পার্টিতে যোগদান করেন এবং একই বছর অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বরিশাল-২ আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হন গোলাম ফারুক। তিনি ছিলেন সপ্তম সংসদের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য। যেহেতু ছাত্রদলের তকমা অভির গায়ে ছিলো সেহেতু তাকে ঘরে ফিরিয়ে আনার বিষয়টিকে অস্বাভাবিক হিসেবে দেখছেন না নেতাকর্মীরা। যদি এমনটা হয় তাহলে বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য এস সরফুদ্দীন আহমেদ সান্টুর কি হবে এ প্রশ্নের উত্তরও খুঁজতে শুরু করেছেন তার সমর্থকরা।
কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে গুঠিয়ায় দৃষ্টিনন্দন মসজিদ করার মধ্য দিয়ে আলোচনায় আসেন সরফুদ্দীন আহমেদ সান্টু। ২০০৮ সালের আগে তাকে ওইভাবে কেউ চিনতেন না। তৎকালীন সেনা সমর্থিত সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত বরিশাল সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অংশ নেওয়ার মধ্য দিয়ে আলোচনায় আসেন তিনি। নির্বাচন করে মাত্র ৫শ ভোটের ব্যবধানে প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা শওকত হোসেন হিরণের কাছে হেরে যান সরফুদ্দীন সান্টু। যদিও ঐ নির্বাচন নিয়ে অনেকটাই প্রশ্ন ছিলো সেই সময়। একই বছর তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপিতে যোগ দেন এবং নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বরিশাল-২ আসন থেকে প্রথমবারের মত ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেন। কিন্তু সেবার নৌকার প্রার্থী সাবেক জাতীয় পার্টির নেতা মনিরুল ইসলামের কাছে পরাজিত হন বিএনপি নেতা সরফুদ্দীন আহমেদ সান্টু। এরপর ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একই আসনে দ্বিতীয়বারের মত বিএনপি থেকে মনোনয়ন পেলেও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তালুকদার মোহাম্মদ ইউনুসের কাছে পরাজিত হন তিনি। এরপর হামলা-মামলা এড়াতে দেশ ছাড়েন সান্টু। ফেরেন ৫ই আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর।
একাধিক সূত্র বলছে সংসদ নির্বাচনের আগে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যদি এমনটা হয় তাহলে বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের মেয়র পদে লড়ার ইচ্ছা আছে সরফুদ্দীন সান্টুর। আর এ সুযোগে কপাল খুলে যেতে পারে গোলাম ফারুক অভির।
১৯৯৮ সালে সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ বিএনপির সাথে সংসদ বয়কটের সিদ্ধান্ত নিলে জাতীয় পার্টির তৎকালীন মহাসচিব আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বে গোলাম ফারুক অভিসহ দলের ১০ জন সংসদ সদস্য ভিন্নমত পোষণ করেন এবং এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন। পরবর্তীতে ১৯৯৯ সালে জাতীয় পার্টি (মঞ্জু) গঠিত হলে গোলাম ফারুক অভি এই দলের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গোলাম ফারুক অভি পরাজিত হন।
১৯৮৯ সালে একটি হত্যা মামলার অভিযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এছাড়াও ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে তার বিরুদ্ধে আটকাদেশ দেওয়া হয়। ১৯৯০ সালের ২৭ নভেম্বর ডা. মিলন হত্যায়ও তিনি অভিযুক্ত ছিলেন। ১৯৯২ সালের ১৮ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের গেস্টরুম থেকে একটি কাটারাইফেল ও বিদেশি পিস্তল সহ গ্রেফতার হয়েছিলেন। ১৯৯৩ সালের ২১ আগস্ট ওই মামলায় ১৭ বছরের কারাদ- হলে তিন বছর কারাভোগের পর উচ্চ আদালতে আপিল করে জামিন পান তিনি। পরবর্তী সময়ে ডা. মিলন হত্যাসহ দুটি হত্যা মামলায় খালাস পান জাতীয় পার্টির সাবেক এ নেতা।
মডেল ও অভিনয়শিল্পী সৈয়দা তানিয়া মাহবুব তিন্নি হত্যা মামলায় চার্জশিটভুক্ত আসামি তিনি। হত্যার ঘটনায় ২০০২ সালের ১১ নভেম্বর মামলা হয়। এজাহারে তার নাম না থাকলেও চার্জশিটে তাকে আসামি করা হয়। ২০০২ সালে তিনি দেশত্যাগ করে কানাডায় চলে যান। তিনিই মামলার একমাত্র আসামি। ২০০৭ সালে ও ২০১৮ সালে ইন্টারপোল তার বিরুদ্ধে লাল নোটিশ জারি করে। ২০০৮ সালের ৮ নভেম্বর এ হত্যা মামলার একমাত্র আসামি গোলাম ফারুক অভিকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দেয় অপরাধ তদন্ত বিভাগ। ২০১০ সালের ১৪ জুলাই ঢাকার ৭ম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ এই মামলায় অনুপস্থিত অভির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। অভির পক্ষে রাষ্ট্র নিয়োজিত আইনজীবী মডেল তিন্নি আত্মহত্যা করেছেন, এই মর্মে মামলাটি খারিজ করার জন্য বিচারাধীন আদালতে আবেদন করেন। হাইকোর্টের নির্দেশে এই মামলার বিচার প্রক্রিয়া প্রায় পাঁচ বছর স্থগিত থাকার পরে ২০১৫ সালে মামলাটির বিচার কার্যক্রম পুনরায় শুরু হয়। ২০১৯ সালের ১৯ অগাস্ট মামলাটি রায়ের জন্য ধার্য্য ছিল। রায়ের তারিখ ৩১ বার পরিবর্তন করার পর ২০২১ সালের ১৫ নভেম্বর আদালত স্বাক্ষীদের স্বাক্ষ্য পুনরায় নেয়ার সিদ্ধান্ত জানায়। ২০২২ সালে মামলাটির স্বাক্ষ্য পর্ব আবার নতুন করে শুরু হয়।