3:13 pm , January 11, 2025
বরিশাল-ঢাকা নৌ-রুট
আরিফ আহমেদ, বিশেষ প্রতিবেদক ॥ যাত্রী সংকটের অজুহাত তুলে রোটেশন করে বরিশাল ঢাকা নৌরুটে দুটি করে লঞ্চ চলাচল করে প্রতিদিন। আর প্রতিদিনই এসব লঞ্চের কোনো কেবিন খালি পায়না সাধারণ যাত্রীরা। লঞ্চের পাইলট ও ইঞ্জিন স্টাফ ছাড়াও লঞ্চ স্টাফদের কেবিনও ভাড়া দেয়ার প্রতিযোগিতা দেখা যায় প্রতিদিন সন্ধ্যার পর। এমনকি ডেকে ঢালাও বিছানার যাত্রীদের উপচেপড়া ভিড় থাকার পরও লঞ্চ ব্যবসা লোকসান গুনছে বলে দাবী একাধিক মালিকের। যদিও বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ ও যাত্রীদের দাবী, ব্যাংক ঋণের চাপ এড়াতে ও আরো ঋণ পেতে এজাতীয় প্রচারণা চালাচ্ছে লঞ্চ মালিকরা। পাশাপাশি রোটেশন করে নির্দিষ্ট কয়েকটি লঞ্চ সুবিধা পাচ্ছে। যে কারণে রোটেশন তুলতে নারাজ মালিক সমিতির নেতারা।
সরেজমিনে ১১ জানুয়ারি শনিবার সকালে ও সন্ধ্যায় এ চিত্র দেখা গেছে বরিশাল নৌ-বন্দরে অপেক্ষমান ঢাকাগামী এমভি সুরভী-৭ ও এমভি শুভরাজ-৯ লঞ্চ ঘুরে।
সকাল সকাল না আসলে কেবিন পাওয়া যায়না দাবী করে সদর উপজেলার কড়াপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা আজমল হোসেন প্রথমে শুভরাজ ও পরে সুরভী লঞ্চে কেবিনের জন্য ছুটোছুটি করলেন। বললেন, স্টিমারঘাট জামে মসজিদের সামনে শুভরাজ অফিস থেকে বলা হলো তাদের কাছে ১০টি টিকেট দেয়া হয়, তা বিক্রি হয়ে গেছে। লঞ্চের ভিতর টেবিল পেতে টিকিট কাউন্টার করা আছে ওখানে যান। এখানে এসে শুনি কোনো কেবিন খালি নেই তাদের। আবার সুরভী লঞ্চের ভিতর যেয়ে দেখি টেবিল আছে, লোক নেই। স্টাফদের একজন জানালেন অফিসে যোগাযোগ করতে। ফোন নম্বর নিয়ে অফিসে যোগাযোগ করে জানলাম, তাদেরও কোনো কেবিন ফাঁকা নেই।
দুটি বড় লঞ্চে কম হলেও সাড়ে তিনশ কেবিন রয়েছে। এরমধ্যে ৭০/৭৫টি ডাবল ও ১২৫ থেকে ১৩০টি সিঙ্গেল কেবিন। যার ভাড়া যথাক্রমে ২২০০ ও ১১০০ টাকা। এছাড়াও রয়েছে ৬ থেকে ৮টি ভিআইপি ও ৭/৮টি ফ্যামিলি কেবিন। এতো কেবিন যাদের পরিপূর্ণ থাকে তারা কি করে লোকসান হওয়ার কথা বলে? এমন প্রশ্ন সাধারণ যাত্রী সহ নৌ বন্দর কর্তৃপক্ষেরও।
সকালে দু-চারজন কেবিন বা সোফার যাত্রী আসা-যাওয়া করলেও ভিড়টা চোখে পড়ে বিকেল পাঁচটার পর। যাত্রীদের কোলাহল ও ছুটোছুটির পাশাপাশি নৌ-বন্দর এলাকায় লঞ্চ শ্রমিকদের হাঁকডাকে মহাব্যস্ত একটা পরিস্থিতি তৈরি হয় এখানে। দুটো লঞ্চ ছাড়ার সময় একটি সাড়ে আটটা অন্যটি নয়টা। সন্ধ্যা হওয়ার সাথে সাথে এই ব্যস্ততা আরো বেড়ে যায়। কেউ ভাড়া হাঁকে, কেউ স্টাফ কেবিন বিক্রির জন্য খরিদ্দার খোঁজে। আবার কেবিনের পাশে বিছানা পেতে সেই বিছানা বিক্রির জন্য চেষ্টা। শীতের রাতে একটু আরামদায়ক যাত্রা চেয়ে স্টাফ কেবিন ডাবল ১৫০০/১৮০০ টাকা, সিঙ্গেল ৬০০/৮০০ টাকা আর কেবিন যাত্রীদের ভোগান্তি সৃষ্টি করে বিছিয়ে রাখা বিছানা বিক্রি হয় টিকিটসহ ৪০০/৫০০ টাকায়। এ দৃশ্য দেখে পরিষ্কার বোঝা যায়, নৌপথের যাত্রী যথেষ্ট রয়েছে।
এসময় ঝালকাঠি থেকে আগত একজন যাত্রী ইয়াছিন হাওলাদার ডেকের ইঞ্জিন রুমের পাশে বিছানা পাততে গেলে বাধা দেন লঞ্চের একজন স্টাফ। বলেন, এখানে বিছানা করা যাবেনা। আরেকজন আগেই করে গেছে বলে সে একটি দঁড়ি পেচিয়ে জায়গাটুকু দখল করে নেয়।
যাত্রীর সাথে স্ত্রী ও শিশু সন্তান রয়েছে। তিনি বলেন, এই ঠা-ার দিনে ইঞ্জিনরুমের পাশে একটু গরম থাকে, শীত কম লাগে। তাই এ জায়গা এখন বিক্রি করবে এরা।
আরেকজন যাত্রী নিজের বিছানা পাততে পাততে বললেন, সড়কে দুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় লঞ্চে যাত্রী বেড়েছে। আর এই সুযোগে আবারও স্বেচ্ছাচারীতা শুরু করেছে লঞ্চ শ্রমিকরা।
পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর থেকে লঞ্চ যাত্রী কমে যাওয়ার যে কথা শোনা যাচ্ছিল তা আর এখন নেই বলে জানালেন একাধিক যাত্রী।
ঢাকার সদরঘাট এলাকা থেকে পণ্য আনা-নেওয়া করা কয়েকজন নিয়মিত যাত্রী বলেন, সপ্তাহে তিনদিন আসা-যাওয়া করি। কোনোদিন কেবিন ফাঁকা দেখিনি। এরা ইচ্ছা করে লঞ্চ আটকে রেখে যাত্রীদের কষ্ট দিচ্ছে আর নিজেদের লোকসানে হচ্ছে বলে বেড়ায়। আসলে মোটেও লোকসানে নেই কোনো লঞ্চ। লোকসানে থাকলে নতুন নতুন বড় বড় লঞ্চ নামানো যায় নাকি বলে উল্টো প্রশ্ন তোলেন তারা।
যাত্রীদের বক্তব্যের সাথে সহমত পোষণ করেন নৌ-বন্দর এর উপপরিচালক আব্দুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, লঞ্চ মালিক সমিতির সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাচারীতায় এই রোটেশন চলছে। আমরা আরো একটি লঞ্চ বাড়িয়ে নিয়মিত তিনটি করার অনুরোধ জানিয়েছিলাম। এ নিয়ে গত ডিসেম্বরে বৈঠকও হয়েছে। তারা সরকার ও যাত্রী উভয়ের সাথে প্রতারণা করছে বলে জানান আব্দুর রাজ্জাক।
যদিও লঞ্চ মালিকদের দাবী যাত্রীদের এই চাপ সাময়িক। এটা শীতকালীন ছুটিকে কেন্দ্র করে। আর কেবিন যাত্রী দিয়ে লঞ্চ চলেনা। লঞ্চ চলে ডেকের যাত্রী নিয়ে এমটাই বললেন প্রিন্স আওলাদ ও শুভরাজ লঞ্চের মালিক যুবরাজ। তবে তিনি স্বীকার করেন-এখন লোকসান নেই। বলেন, সড়কে অহরহ দুর্ঘটনার কারণে গত কয়েক মাস ধরে লঞ্চের যাত্রী বেড়েছে। কিন্তু ৫ই আগস্ট এর পর নতুন কিছু লঞ্চ রোটেশনের মধ্যে ঢুকে যাওয়ায় তাদের সেবার মান নিয়ে সমস্যা তৈরি হয়েছে।
এদিকে সুরভী লঞ্চের মালিক রিয়াজুল কবির এবং সুন্দরবন লঞ্চের ব্যবস্থাপক জাকির হোসেন বলেন, বর্তমান এই রোটেশন আছে বলেই গত ডিসেম্বর থেকে এখন পর্যন্ত কিছুটা লাভের মুখ দেখছি । রোটেশন তুলে দিলে এটি আর থাকবে না।
গত ডিসেম্বর থেকে এখন পর্যন্ত যাত্রীর যে চাপ এটি স্কুল-কলেজ ছুটি হওয়ার কারণে। শীতের এই সময়টায় সব সময় এরকম চাপ থাকে। শীত গেলেই আবার আগের অবস্থা হবে।
অন্যদিকে সুরভী লাঞ্চের মালিক রিয়াজুল কবির বলেন, রোটেশন আছে বলেই দুটি করে লঞ্চ চলছে এবং কিছুটা যাত্রীদের চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। তাছাড়া কেবিনের যাত্রী দিয়ে লঞ্চ ব্যবসা টিকিয়ে রাখা যায় না।