4:10 pm , December 27, 2024
বিশেষ প্রতিবেদক ॥ নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে ছুটে আসা যানবাহনগুলো কিছুদূর এসেই হুমড়ি খেয়ে গতি শ্লথ করতে বাধ্য হচ্ছে সড়কের মাঝখানে গড়ে ওঠা অবৈধ শিশুপার্কের কারণে। পার্কটির একটু পিছনেই বরিশালের সৌন্দর্য বৃদ্ধির অনন্য প্রচেষ্টা নিয়ে বাঁচার আকুতি জানাচ্ছে চৌমাথা লেকটি। এই লেকের চারপাশে ভ্রমণ পিপাসু সাধারণ মানুষের জন্য বসার স্থান, ভিতরে পানির ফোয়ারা সবকিছু এখন অকেজো হয়ে আছে। চারপাশে গজিয়ে উঠেছে অসংখ্য খাবারের দোকান ও মনোহারি বাণিজ্যিক পসরা। এছাড়াও রয়েছে ইজিবাইক, অটোরিকশা সহ বিভিন্ন যানবাহনের ভিড়। এসব নিয়ন্ত্রণের কোনো পদক্ষেপ আজ পর্যন্ত নিতে পারেনি বরিশাল সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ।
প্রায় ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে বরিশাল মহানগরীর সৌন্দর্য বর্ধনকৃত ‘নবগ্রাম রোড-চৌমাথা সড়কের এই লেকটি এখন নগরবাসীর গলার কাটা। নতুন নগর প্রশাসকও বিষয়টি নিয়ে চরম বিব্রত।
এই লেকের উত্তর প্রান্তে সড়ক অধিদপ্তরের জমি দখল করে জাতীয় মহাসড়কের ওপর অবৈধভাবে নির্মিত শিশু পার্কটি ভাঙার অনুমোদন হলেও সিটি করপোরেশন আর সড়ক বিভাগের মধ্যে এ নিয়ে চলছে রশি টানাটানি। কে ভাঙবে তা নির্ধারণ করতে না পারায় আজ পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়েনি। সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ বলছে, অনুমোদন যারা দিয়েছে এবং জায়গা যাদের তারাই ভাঙবে এটি। আবার সড়ক ও জনপথ বিভাগ বলছে, পার্ক বানিয়েছে সিটি করপোরেশন, তাই ভাঙার দায়িত্ব তাদেরই। চলমান এই দ্বন্দ্ব নিয়ে সংবাদ শিরোনাম হলেও নিরব উভয় প্রশাসন। এদিকে তাদের এই দ্বন্দ্বের ফাঁকে নগরীর অন্যতম দুর্ঘটনা ও যানজটের স্থলে পরিণত হয়েছে চৌমাথা এলাকা ।
সরেজমিনে বরিশাল নগরীর নবগ্রাম রোডের চৌমাথা কাজীপাড়া ঘুরে যে বিশৃঙ্খলা চোখে পড়ে তা থেকে এটা নিশ্চিত বলা যায় যে পুরো এলাকাজুড়ে এখন নৈরাজ্যের জয় জয়কার। প্রায় ৬ কোটি টাকায় তৈরি অবৈধ শিশুপার্কটির সৌন্দর্যবর্ধনে খরচ হয়েছে আরও ৫ কোটি টাকা। আর এটি এখন রীতিমতো কিশোর গ্যাংয়ের দখলে। চলছে সব অনৈতিক কর্মকা- এটির ভিতর। সাথে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ নিয়ে গভীর রাত পর্যন্ত আলো ঝলমলে পথে খাবার ও মনোহারি বাণিজ্যের প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত নতুন নতুন চাঁদাবাজ। যার দখল নিয়ে সংঘর্ষে ইতিমধ্যেই আহত ও নিহতের ঘটনা ঘটেছে নগরীতে।
যতদূর জানা গেছে, বরিশাল সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র প্রয়াত শওকত হোসেন হিরণ নগরীর কাশিপুর থেকে আমতলা মোড় পর্যন্ত প্রায় ৫৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫ কিলোমিটার মহাসড়ক প্রশস্তকরণসহ ‘নবগ্রাম রোড-চৌমহনী লেকটির উন্নয়ন কাজ শুরু করেছিলেন। ২০১৩ সালে প্রয়াত মেয়র আহসান হাবীব কামাল এই প্রকল্পটির কাজ শেষ করেন। প্রকল্পের আওতায় লেকটির পূর্ব এবং উত্তর-দক্ষিণ পাড় আরসিসি রিটেইনিং ওয়ালসহ ওয়াকওয়ে নির্মাণ এবং বসার বেঞ্চ স্থাপনসহ দৃষ্টিনন্দন লাইটিং করা হয়। পূর্ব পাড়ে জাতীয় মহাসড়কের পাশে অনেকটা শূন্যের ওপর সুদৃশ্য গাছও লাগানো হয়েছিল। পশ্চিম পাড়ের রাজকুমার ঘোষ রোডটি মেকাডমসহ বিটুমিনাস কার্পেটিং ছাড়াও স্থানীয় এলাকাবাসী ও মারকাজ মসজিদের মুসুল্লীদের জন্য বিশাল ঘাটলা নির্মাণ করে পুরো লেকটির চারিপাশে একটি দৃষ্টিনন্দন ও ব্যবহার উপযোগী পরিবেশ তৈরী করা হলেও তা পরবর্তীতে আর স্থায়ী হয়নি। কিছুদিনের মধ্যেই বিসিসির সাবেক কাউন্সিলর শেখ সাঈদ আহমেদ মান্না পূর্বপাড়ে ওয়াকওয়ে দখল করে পথ খাবারের দোকান বসাতে শুরু করে। পরবর্তীতে একের পর এক পথ খাবারের দোকানে মধ্যরাত পর্যন্ত আড্ডাবাজির পাশাপাশি অবৈধ ও গোপনীয় পণ্যের বেঁচাকেনাও চলে এই লেকের চারপাশে। অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ থেকে শুরু করে সরকারি জমি দখল করে পুরো এলাকার পরিবেশ বিপন্ন করলেও বিগত প্রায় সব নগর পরিষদই বিষয়টি নিয়ে নীরব ভূমিকা পালন করেছে। ৫ আগস্টের পরও প্রভাবশালী ওই কাউন্সিলরের অনুসারীদের নিয়ে বিএনপির একটি গ্রুপ যৌথভাবে এই সিন্ডিকেট বাঁচিয়ে রেখেছে এবং লেকপাড়ে তাদের দখল বাণিজ্য অব্যাহত রয়েছে। ফলে নগরবাসীর বিনোদনের জন্য সরকারি ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত দৃষ্টনন্দন এ লেক ও তার চারিপাশের সুষ্ঠু পরিবেশকে গলাটিপে হত্যা করা হয়েছে। লেকটির চারধারে যেসব অবৈধ খাবারের দোকান গড়ে উঠেছে, প্রতি রাতে তার বর্জ্য লেকটিতে ফেলা হচ্ছে। লেকটির পয়ঃনিষ্কাশনের জন্য দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে একটি ড্রেন নির্মাণ করা হলেও তার অধিকাংশই ভরাট হয়ে গেছে এই দোকানগুলোর ছুড়ে ফেলা ময়লা আবর্জনায়। এমনকি ড্রেনটি নিয়মিত পরিষ্কারও হচ্ছে না। এলাকাবাসীসহ দক্ষিণাঞ্চলের সর্ববৃহৎ মার্কাজ মসজিদের মুসুল্লীদের অজু-গোসলের জন্য যে ঘাটলা নির্মাণ করা হয়েছে, তার প্রবেশ ও বহির্গমনের পথটি পর্যন্ত বন্ধ করে চলছে এসব খাবারের দোকান। আজো কিন্তু কেউ মুখ খুলতে পারছে না সিন্ডিকেটের ভয়ে।
সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকটি দুর্ঘটনার কারণে আবারও আলোচনায় উঠে এসেছে মহাসড়কে দাঁড়িয়ে থাকা ঝুকিপূর্ণ শিশুপার্কটি। যেটি শাহানারা আব্দুল্লাহ শিশুপার্ক হিসেবে নামকরণ করেছিলেন বরিশাল সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ।
২০২২ সালে পার্কটির নির্মাণ চলাকালে তৎকালীন সড়ক ও সেতুমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে এটি বন্ধ করার অনুরোধ জানানো হলে দুদিন কাজ বন্ধ ছিলো। কিন্তু তারপরই দ্বিগুণ উৎসাহে অতিদ্রুত কাজটি শেষ করা হয় এবং জনগণের জন্য উম্মুক্ত করে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে জানা যায়, সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের নিজেই পার্ক তৈরির জন্য ডিউলেটার দিয়েছিলেন। যে কারণে এলাকাবাসীর শত অভিযোগ পেয়েও কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি বরিশাল সড়ক বিভাগ। তখন কাজে বাধা দিতে না পারার দায় স্বীকার করলেও পার্কটির বিষয়ে এখনো তাদের কিছু করার নেই বলে জানান সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মাসুদ মাহবুব সুমন। কিছুদিন আগে এ বিষয়ে তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, এটা তৈরি করেছে সিটি করপোরেশন। তাই তাদেরকেই এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে।
তবে এলাকাবাসীর দাবী মহাসড়ক থেকে যত দ্রুত সম্ভব এই ঝুকিপূর্ণ শিশুপার্ক সরিয়ে নিতে হবে। এখানে সড়ক পারাপর ও শিশুদের নিয়ে আতঙ্কিত থাকতে হয় বলে জানান স্থানীয় বাসিন্দারা। ঢাকা বরিশাল ও কুয়াকাটা মহাসড়কের ফোরলেনে উন্নিত করার কাজও এই অংশে এসে থমকে গেছে। এখানে কোনোরকম বর্ধিতকরণ প্রক্রিয়ার স্থানে দাঁড়িয়ে আছে এই শিশুপার্ক। যা শিশুদের কোনো উপকারতো করেনা বরং জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে দাবী করেন একাধিক এলাকাবাসী। তাদের দাবী স্কুল, কলেজ, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ছাড়াও এখানে রয়েছে কয়েকটি বেসরকারি কিন্ডারগার্টেন স্কুল। প্রতিদিন শতশত শিক্ষার্থীর চলাচল ও পারাপার এই সড়কে। মহাসড়ক হওয়ার কারণে এ সড়কে সবসময় ভারী যানবাহন চলাচল করে। তাই এই শিশুপার্ক দ্রুত সরিয়ে নেওয়ার দাবী তাদের।
যদিও বিষয়টি সম্পর্কে কিছুই জানেন না বিসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রেজাউল বারী। বললেন, আগামী প্রথম কার্যদিবসে আমি নিজে স্থান দুটি ঘুরে দেখবো। এরপর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।