3:17 pm , December 26, 2024
আরিফ আহমেদ, বিশেষ প্রতিবেদক ॥ এসেছেন বিএনপির মিডিয়া সেলের প্রধান গৌরনদী আগৈলঝারা আসনের সাবেক সংসদ সদস্য জহির উদ্দিন স্বপন ও তার ভাই মোহন আহমেদসহ পরিবারের সদস্যরা। বরিশাল পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির সাবেক চেয়ারম্যান প্রয়াত শামসুল আলম তালুকদার, বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত সরোয়ার আলম তালুকদার, বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত নুরু মৃধার পরিবারের সদস্য ও নাতিপুতিসহ এসেছেন জিল্লুর রহমান কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ও ক্যামব্রিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের খন্ডকালীন শিক্ষক জাকির হোসাইন, সাবেক এনবিআর সদস্য সাইফুল ইসলাম মিল্লাত, রাইসুল ইসলাম আাসাদ, কামরুল ইসলাম মুরাদ, জাহিদ হাসান ছাড়াও বাংলাদেশ রেলওয়ের খুলনা অঞ্চলের অসংখ্য সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তা। এছাড়াও এই উৎসবের হাটে যুক্ত হয়েছেন সাবেক অতিরিক্ত সচিব মনিরুল ইসলাম আজাদ, বরিশালের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী তালুকদার ফিলিং স্টেশন এর মালিক হালিম তালুকদার, বাবু। সবমিলিয়ে প্রায় তিন শতাধিক স্বজন-পরিজন ও প্রতিবেশীদের নিয়ে এক বিশাল মিলনমেলা সাজানো হয়েছিল বরিশাল সদর উপজেলার চাঁদপুরা ইউনিয়নের তালুকদার হাট এলাকায়। এখানে তালুকদার বাড়িতে তাই বড় বড় ডেক ও রাধুনি ভাড়া করে চলছে এতো মানুষের খাবারের আয়োজন। ঢালাও বিছানা সাজানো হয়েছে মসজিদ, কাচারি ঘর ও বাড়ির ভিতরের ২১টি ছোট-বড় ঘরে। এই ২১টি ঘরের সব আত্মীয় স্বজন নিয়েই এই উৎসবের হাট বসিয়েছেন এই বাড়ির বর্তমান অধিকর্তা তালুকদার হাট স্কুল এন্ড কলেজ এর সাবেক অধ্যক্ষ ফরিদুল আলম জাহাঙ্গীর তালুকদার এবং বাদশা তালুকদার। এ বিষয়ে ফরিদুল আলম জাহাঙ্গীর তালুকদার বলেন, বড় ভাই প্রয়াত আনিস তালুকদারের সহধর্মিণী শারমিনের মায়ের উদ্যোগে এবং আমাদের ভাগ্নে জহির উদ্দিন স্বপন এর আন্তরিকতায় এই মিলনমেলা সম্ভব হয়েছে। এখানে বাড়ির চাচা, মামা, চাচাতো, মামাতো ভাই-বোন, তাদের ছেলে-মেয়েসহ আমাদের প্রতিবেশী সবাই সামিল হয়েছেন এই মিলনমেলায়। এমনকি এই উপলক্ষে বিদেশ থেকেও চলে এসেছেন কয়েকজন স্বজন। দেশের আনাচেকানাচে অবস্থান করা সবাই প্রতিবছর একবার হলো এভাবেই জড়ো হবার চেষ্টা করবো বলে জানান তিনি।
এসময় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব জহির উদ্দিন স্বপন বলেন, আমাদের নানাবাড়ি এটি। নানা-নানু ও প্রয়াত স্বজনদের কবর জিয়ারত এবং পাশাপাশি আত্মীয়স্বজন সকলের সাথে দেখা সাক্ষাৎ হওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে আমাদের এই জড়ো হওয়া।
এই উৎসবের হাটের সবচেয়ে প্রবীণ মানুষটি এখন বিছানায় শুয়ে আছেন। হাঁটাচলা করতে না পারলেও স্বজনদের পদচারণায় মুখরিত তার ঘর। শত বয়সের নজরুল তালুকদার বলেন, এভাবেই আমাদের আত্মীয়তার বন্ধন অটুট থাকুক সবসময়। এতে আল্লাহর রহমত বৃদ্ধি পাবে। এ বাড়ির মহিলাদের মধ্যে সবচেয়ে বয়স্ক এবং সকলের দাদী সম্পর্কের ৮০ উর্ধ্বে বৃদ্ধা চাঁন বড়ু মেয়ের বাড়িতে থাকায় তাকেও স্মরণ করলেন আগত অতিথিরা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়ের একজন সহযোদ্ধা তিনিসহ এই বাড়ির আরো অনেকে। যে গল্প ইতিমধ্যেই বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও গণমাধ্যমে উঠে এসেছে বহুবার।
আগত অতিথি ও বাড়ির স্থায়ী বাসিন্দা সকলের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এই বাড়ির মসজিদে জুম্মা আদায় শুরু হয়েছিল প্রায় ২০০ বছর আগে।বরিশালের ইতিহাস ঐতিহ্যের গর্বিত সাক্ষী এই তালুকদার বাড়িটির পূর্ব পরিচয় ছিলো আহঞ্জী বাড়ি নামে। কালু, ধলু ও লাল তিন ভাইয়ের বংশধর নিয়ে এই বাড়ির যাত্রা শুরু হয়েছিল সিলেটের হযরত শাহজালাল (রহঃ) এর আগমন সময়ে। পরবর্তীতে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ারের শাসনামলে এ অঞ্চলের মুসলিম বসতি আরো বৃদ্ধি পায়। হিন্দু জমিদার প্রফুল্ল নারায়ণ ঠাকুরের পূর্বপুরুষরা তখন এখানে রাজত্ব করতেন। সততা ও বিশ্বাসযোগ্যতার কারণে জমিদারের খাজাঞ্চি বা কোষাধ্যক্ষ হিসেবে আহঞ্জী বাড়ির উপর দায়িত্ব অর্পণ করেন। গজনীর সুলতান সুপেয় পানির জন্য এখানে একটি বড় দিঘি খনন করলে সেই দিঘির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বও দেয়া হয় এই বাড়ির বাসিন্দাদের। যার নাম গজনীর দীঘি। দেশভাগের পরবর্তী সময়ে জমিদারী প্রথা বাতিলের পর হিন্দু জমিদার প্রফুল্ল নারায়ণ ঠাকুর তার সম্পত্তি তিনটি ভাগ করে দুইটি ভাগ বিক্রি করে দেন এবং একাংশ দান করে যান বলে জানা গেছে। তার সম্পত্তি ক্রয় করে নেওয়ার পর থেকে এই বাড়ির নামও বদলে যেতে শুরু করে এবং তালুকদার উপাধি প্রাপ্তিতে বদলে যায় আহঞ্জী বাড়ির নামকরণ। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই বাড়িটি ছিলো এই অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের রক্ষাকবচ। ছয়জন বীর মুক্তিযোদ্ধা ঘুমিয়ে আছেন এই বাড়ির আনাচেকানাচে। তালুকদার বাড়ি শুধু নয়, তালুকদার হাট স্কুল এন্ড কলেজ, বাজার এবং বরিশাল শহরের উন্নয়নে এই বাড়ির অবদান অনস্বীকার্য।
যোহরের নামাজ আদায় শেষে পুরুষরা সবাই কবর জিয়ারতে অংশ নেন। এসময় আশেপাশের রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন বিএনপি নেতা জহির উদ্দিন স্বপন এর সাথে। দুপুরের খাবার শেষে জরুরী ফোনে ঢাকার পথে বিদায় নেন জহিরউদ্দিন স্বপন। মহিলাদের মধ্যে তখন জমজমাট আড্ডার নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন বিউটি ভাবী বা বড় ভাবী। শারমিন, স্বর্না, মুন্নি ছাড়াও বাড়ির মেয়েরা জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছিলেন, কেউ আবার তাদের সন্তানদের নিয়ে ঘুরছিলেন গ্রামের সড়কে। বাবা চাচা, মামমামি, নাতিপুতি সহ দাদারা মোট চার প্রজন্মের উৎসবের এই হাট জমজমাট ছিলো সন্ধ্যা পর্যন্ত।