4:19 pm , December 22, 2024
রোগীর ভিড়ে হিমশিম ডাক্তার ও নার্স
আরিফ আহমেদ, বিশেষ প্রতিবেদক ॥ শুধুমাত্র চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দ না পাওয়া, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী সংকটের কারণে আটকে আছে বরিশালের দুটি সরকারি হাসপাতালের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন। আর এজন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের উদাসীনতাকেই দায়ী করেছেন বরিশালে কর্মরত বেশিরভাগ চিকিৎসক, নার্স ও হাসপাতাল প্রশাসন। তাদের মতে আনুষাঙ্গিক সাপোর্ট পুরোপুরি না পেলেও যা আছে তা নিয়েই এই দুটি হাসপাতাল এশিয়ার মধ্যে উল্লেখযোগ্য এবং বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ হাসপাতাল হতে পারতো। এজন্য লোকবল সংকট এবং জরুরী প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলোকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ চাইলেই পানি, ড্রেনেজ ব্যবস্থা, ভবন মেরামত করতে পারেনা। এগুলোর জন্য স্বাস্থ্য বিভাগের প্রকৌশল বিভাগে নোট দিতে হয়। সেখান থেকে আবার গণপূর্ত দপ্তরে তারপর ঠিকাদার হয়ে কাজটির সমাধান হতে হতে অনেক সময় চলে যায় বলে জানান কর্তৃপক্ষ। একই কারণে বরিশাল শের ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রধান ফটক বন্ধ থাকে, সদর হাসপাতালের ভিতরে অব্যবহৃত মালামালের জঞ্জাল জমে। আর দুটো হাসপাতালেই পরিচ্ছন্ন ও নিরাপত্তা কর্মীদের অভাবে সেবা কার্যক্রম ব্যাহত হয় বলে জানান শেবাচিম পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মশিউল মুনীর এবং সিভিল সার্জন ডাঃ মারিয়া হাসান।
সরেজমিনে বরিশাল সদর হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, সকাল হতে না হতেই দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা থেকে আগত মা-শিশু রোগী ছাড়াও ডায়রিয়া, কুকুর-বিড়ালের কামড়ে আহত রোগীদের উপচে পরা ভিড় এখানে। মাত্র পাঁচ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে চিকিৎসা সেবা চলে বেলা ২টা পর্যন্ত। বেশিরভাগ হতদরিদ্র শ্রেণির মানুষের এই ভিড় সামলাতে হিমশিম এখানকার চিকিৎসক ও নার্সরা। রোগীরাও এখানকার চিকিৎসা সেবা ও নার্সদের আচার-আচরণ নিয়ে বেশ খুশি। বলেন, খুবই চমৎকার এখানকার সেবার মান। এ নিয়ে আমাদের কোনো অভিযোগ নেই। এমনকি বিনামূল্যে ঔষধও পাচ্ছি এখানে। তবে টয়লেট বা ওয়াশরুম এবং আশেপাশের পরিবেশ খুবই নোংরা। হাসপাতালের ভিতর ও বাইরে মা ও শিশুদের বসার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। নিরাপত্তা ঝুঁকি রয়েছে। কুকুর দোতালায় ঘোরাঘুরি করছে।
এসময় স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ রেহানা ফেরদৌস এবং তানিয়া আফরোজ এর কাছে আসা অনেক মহিলা রোগী কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। ১০০ শয্যার এই হাসপাতালে দুটি মাত্র সার্জারী কেবিন, যা পর্যাপ্ত নয় বলে জানালেন ডাঃ রেহানা ফেরদৌস। তিনি বলেন, গড়ে প্রতিদিন ১০/১২ টি অপারেশন করতে হয় এখানে। গাইনী ছাড়াও নাক-কান গলাও রয়েছে। এই হাসপাতালের পারিপার্শ্বিক অবস্থার উন্নয়ন খুবই জরুরী। তাহলে এটি বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ হাসপাতাল হতে পারতো।
পুরো হাসপাতালের এই মুহূর্তে ১ নম্বর ভবনে মেডিকেল অফিসার, টিকিট ও প্যাথলজি, ২ নং ভবনে জরুরী বিভাগ ও কিশোরীদের টিকা, ৩ নম্বর ভবনে রয়েছে জলাতঙ্ক কেন্দ্র, মেডিসিন, গাইনী (পুরুষ ও মহিলা) এবং ৪ নম্বর অস্থায়ী ভবনে ডায়রিয়া বিভাগ সাজানো রয়েছে। এইসব ভবনকে একত্রিত করে ১২ তলা বিশিষ্ট বিশাল ও অত্যাধুনিক ভবন নির্মাণ কাজ চলছে। তবে এখানেও বরাদ্দ সংকটের কারণে আপাতত দ্বিতীয় তলা পর্যন্ত প্রস্তুত করা হবে বলে জানালেন সিভিল সার্জন ডাঃ মারিয়া হাসান।
এদিকে হাসপাতালে দীর্ঘ সময় অবস্থান ও রোগীদের সাথে কথা বলে জানা গেল প্যাথলজিক্যাল সাপোর্ট বলতে এখানে এখন শুধু ব্লাড, মল-মূত্র এবং ইসিজি ছাড়া আর কিছুই নেই। বিশুদ্ধ খাবার পানির ব্যবস্থাও ভেঙে পড়ে থাকতে দেখা গেছে। জরুরী অক্সিজেন সাপ্লাই সিস্টেম নিয়েও সমস্যা রয়েছে বলে জানালেন তারা। আর ১৯১ জন নার্স, ১২ জন পরিচ্ছন্ন কর্মী কাজ করছেন তিনটি ভাগে বিভক্ত হয়ে। নার্সদের অভিযোগ পরিচ্ছন্ন কর্মী সংকটের কারণে রোগীদের সেবা বিঘিœত হয়। তাছাড়া অনেক সময় প্রশাসনিক দপ্তরের কাজও তাদের করতে হয়। যেমন কেবিনের হিসাব নিকাশ, রোগীদের বিভিন্ন তালিকা, ঔষধপত্র আনা-নেওয়া এসব কাজে অনেকটা সময় ছোটাছুটি করতে হয়।
এ বিষয়ে হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডাঃ মলয় কৃষ্ণ বড়াল বলেন, দক্ষিণাঞ্চলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ডায়রিয়া ও জলাতঙ্ক চিকিৎসা কেন্দ্র এটি। শুধুমাত্র লোকবল সংকটের কারণেই আমরা পিছিয়ে রয়েছি। পাশাপাশি স্বাস্থ্য বিভাগের কাছ থেকে পর্যাপ্ত বরাদ্দ না পাওয়াও পিছিয়ে পড়ার কারণ।
৩ নং ভবনের গাইনী বিভাগের জেনারেল ওয়ার্ডে চিকিৎসা সেবা নেওয়া রোগীদের কয়েকজন বলেন, দিনদুপুরে কুকুর বিড়াল ঘুরে বেড়ায়। টয়লেট সহজে পরিষ্কার করা হয়না। পাঁচ টাকা নয়, আমরা এখানের টিকিট ২০ টাকা করার প্রস্তাব করছি। তারপরও এইসব সমস্যার সমাধান করে দেওয়া হোক। পরিচ্ছন্ন পরিবেশ রোগীদের জন্য সবচেয়ে জরুরী বলে জানান তারা।
বরিশাল সদর হাসপাতালে রয়েছেন গাইনী বিশেষজ্ঞ রেহানা ফেরদৌস, তানিয়া আফরোজ, আফিয়া রহমান সহ আরো অনেকে। ডায়রিয়া ও মেডিসিন বিভাগে রয়েছেন ডাঃ শেখ মিজানুর রহমান, মলয় কৃষ্ণ বড়াল, আশিকুর রহমান, রাকিবুল হাসান। প্রায় শতাধিক নার্স রয়েছেন এখানে। ৮০ শয্যা থেকে ১০০ শয্যায় উন্নিত হওয়ার পর এখানে রোগীদের ভিড় দিনকে দিন বাড়ছে বলে জানান ভারপ্রাপ্ত সেবা তত্ত্বাবধায়ক মমতাজ বেগম।
এই হাসপাতালের ভালোমন্দ দেখার দায়িত্বে নিয়োজিত বরিশালের সিভিল সার্জন ডাঃ মারিয়া হাসান বলেন, ১২ তলা ভবনের দ্বিতীয় তলা প্রস্তুত হলেই এই হাসপাতালের সমস্যার অর্ধেক সমাধান হয়ে যাবে। নির্মাণাধীন কাজের কারণেই আসলে এই মুহূর্তে হাসপাতালের চারপাশের পরিবেশ এমন মনে হচ্ছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও লোকবল সংকট সম্পর্কে মন্ত্রণালয়ে জানানো হয়েছে। আশাকরি ভবন সম্পূর্ণ হবার আগেই এ বিষয়ের সমাধান দেবেন কর্তৃপক্ষ।
একই পরিস্থিতি বরিশালের ইতিহাস ঐতিহ্যের গর্বিত অংশীদার শের ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও। তবে সেখানে চিকিৎসক ও সাধারণ মানুষের দাবীর মুখে সেনাবাহিনী থেকে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মশিউল মুনীরকে পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আর হাসপাতালের দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মশিউল মুনীর সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময় সভা করে বলেছেন, দক্ষিণাঞ্চলের শ্রেষ্ঠ হাসপাতাল হিসেবে এই হাসপাতালকে তৈরি করতে আমার পক্ষে সম্ভব সবকিছু আমি করবো। লোকবল সংকট এখানেও প্রকট বলে স্বীকার করেন পরিচালক।