3:11 pm , December 7, 2024
আরিফ আহমেদ, বিশেষ প্রতিবেদক ॥ বরিশাল মুক্ত দিবস আজ। ১৯৭১ সালের এই দিনে হানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত হয়েছিল বরিশাল। বীরপ্রতীক মহিউদ্দিন মানিক বলেন, রাজাকার আর আলবদর বাহিনী ছাড়া বাংলাদেশের প্রায় ৮০ ভাগ মানুষই আমাদের সহযোদ্ধা ছিলেন। এদেশের দেশপ্রেমিক প্রতিটি মানুষই আমাদের সহযোদ্ধা ছিলেন তখন। তাই আজ সেইসব আশ্রয়দাতা ও বিভিন্নভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যকারী মানুষের বা সহযোদ্ধাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।
বীরপ্রতীক মহিউদ্দিন মানিক জানান, ২৫ মার্চে রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃশংস হত্যাযজ্ঞের পরই মূলত মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। অপারেশন সার্চলাইটের ভয়ে পালিয়ে আসা মানুষরা প্রতিরোধ গড়ে তোলে ওদের বিরুদ্ধে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের আলোকে আমাদের প্রস্তুতি আগেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। বরিশালে তখন মুক্তিযোদ্ধারা তৎকালীন পুলিশ সুপার ফখরুল ইসলামের কাছ থেকে অস্ত্রাগারের চাবি নেন। তারা পুলিশের অস্ত্রাগার থেকে শ’খানেক রাইফেল, গোলবারুদ নিয়ে তৎকালীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম মঞ্জুর পেশকার বাড়িতে নিয়ে যান। ২৬ মার্চ ভোরে ৯ নম্বর সেক্টর কমান্ডার এমএ জলিলকে সাথে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা বরিশালের সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে দক্ষিণাঞ্চলের প্রথম স্বাধীন বাংলা সচিবালয় গঠন করেন। ২৬ মার্চ থেকে ২৫ এপ্রিল দীর্ঘ একমাস মুক্তিযোদ্ধারা এই স্থান থেকেই অনেক অভিযান পরিচালনা করেন।
বীরপ্রতীক মহিউদ্দিন মানিক আরো জানান, ২৫ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী সড়ক-আকাশ ও নৌপথ থেকে একযোগে বরিশাল আক্রমণ করে। বরিশালে ঢোকার মুখে চরবাড়িয়া ও গৌরনদীর কটকস্থলে তারা বাধা পান। প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল ওহাব খান ও তার সহযোদ্ধারা ওখানে প্রতিরোধ তৈরি করে। এতে ক্ষীপ্ত হয়ে পাকসেনারা চরবাড়িয়ায় গণহত্যা চালিয়ে অর্ধশতাধিক মানুষকে মেরে ফেলার পর পাকিস্তানি বাহিনী কীর্তনখোলা নদীর পাড়ে বরিশালের পানি উন্নয়ন বোর্ড অফিসে দক্ষিণাঞ্চলীয় হেড কোয়ার্টার গড়ে তোলেন। সেখানে বাংকার খুঁড়ে, ভারি অস্ত্রের সমাবেশ ঘটান তারা। প্রতিদিন বরিশাল, ঝালকাঠি, গৌরনদীসহ দূর-দূরান্ত থেকে নিরীহ মানুষদের ধরে এনে গুলি করে হত্যা করতো ওরা। লাশ ভাসিয়ে দিত পাশের খালে। ওয়াপদা সংলগ্ন খাল ও ব্রিজে মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে দুই থেকে তিন হাজার মানুষকে মেরে ফেলা হয়েছে বলে অনুমান করা হয়। ডিসেম্বরে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ তীব্র হলে পাক-হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা চিন্তিত হয়ে পড়ে। ৭ ডিসেম্বর রাত থেকে শহরে জারি করা হয় অনির্দিষ্টকালের সান্ধ্য আইন। ৮ ডিসেম্বর সকালে জেলা প্রশাসকের দপ্তরে এক বৈঠকে মিলিত হয় হানাদার বাহিনী। শহরে কারফিউ চলাকালে সকাল ১০টায় বৈঠক শেষ করে পাকিস্তানি বাহিনী বরিশাল ছেড়ে নৌপথে পালানোর উদ্যোগ নেয়। খবর পেয়ে ভারতীয় বিমানবাহিনী পলায়নরত পাকিস্তানি বাহিনীর গানবোট, স্টিমার ও লঞ্চ লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করে। আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের বড় একটি দল তখন বরিশাল ঘীরে ফেলে। এতে পাকিস্তানি বাহিনীর স্থানীয় প্রধান সহযোগী শাজাহান চৌধুরীসহ তাদের বহু দোসর নিহত হয়। ৮ ডিসেম্বর বরিশাল শত্রু মুক্ত হয়। ঐ দিন বাকেরগঞ্জেও তুমুল যুদ্ধ হয়েছে। আমরা জিয়াউদ্দিন, নাসের, জাফরসহ বেশকিছু মুক্তিযোদ্ধা বাকেরগঞ্জ দখলে নেই। পাকসেনাদের একটি বুলেট এসে আমার পায়ে গেঁথে যায়। আমি আহতাবস্থায় ওদের মোকাবেলা করি। স্বাধীন বরিশালে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন হয় ৮ ডিসেম্বর। পরবর্তীতে এই ইতিহাস পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারের একক কৃতিত্বের অংশ হয়ে যায়। অথচ শেখ পরিবারের একজন সদস্য এবং তাদের আত্মীয়স্বজন কোনো যুদ্ধে অংশ নেয়নি। স্বাধীন দেশে তারা শুধু সুবিধা গ্রহণ করেছে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাদের অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি আজ তাদের পতন ডেকে এনেছে বলে দাবী করেন মহিউদ্দিন মানিকের।