3:59 pm , December 3, 2024
জসিম জিয়া ॥ বরিশাল মহানগর বিএনপির আহবায়ক কমিটির বিরুদ্ধে এবার প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়েছেন দলের পদবঞ্চিত এবং অপসারণকৃত নেতারা। এ তালিকায় আছেন বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা মজিবর রহমান সরোয়ার অনুসারীরাও। এতদিন ভেতরে ভেতরে গ্রুপিং এর বিষয়টি সীমাবদ্ধ থাকলেও সোমবার ২ ডিসেম্বর তা প্রকাশ্যে এসেছে। এদিন নগরীতে আনন্দ মিছিল ও সমাবেশ করেছেন পদবঞ্চিত নেতাকর্মীরা। যাদের নেতৃত্বে ছিলেন মহানগর বিএনপির সাবেক সদস্য সচিব মীর জাহিদুল কবির জাহিদ। সামনে থাকা ব্যানারে লেখা ছিলো ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) বরিশাল’। একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান খালাস পাওয়ায় তার (জাহিদ) নেতৃত্বে দুপুর সাড়ে বারোটায় দলীয় কার্যালয় থেকে বের হওয়া মিছিলটি নগরীর প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে। মিছিলের সামনের সারিতে ছিলেন মহানগর বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহবায়ক আলতাফ মাহমুদ সিকদার, কেএম শহীদুল্লাহ, সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আকবর ও আনোয়ারুল হক তারিন।
বঞ্চিতদের নেতৃত্ব দেওয়া মীর জাহিদুল কবির বলছেন ‘ কমিটিতে থাকা না থাকার বিষয়না। আমরা রাজপথে ঐক্যবদ্ধভাবে ছিলাম, আছি এবং থাকবো। মহানগর বিএনপির ব্যানারের বাইরে হঠাৎ করে এ ধরণের কর্মসূচির কারণ কি জানতে চাইলে তিনি বলেন ‘মহানগর বিএনপির কমিটি হওয়ার পর থেকে আমাদেরকে কোনো সভায় ডাকা হয়নি।
জাহিদের এ ধরণের কর্মকান্ডকে ভালভাবে নেননি বর্তমান সদস্য সচিব জিয়া উদ্দীন সিকদার। তিনি সাবেক সদস্য সচিবকে উদ্দেশ্য করে বলেন, সরকার বিরোধী আন্দোলনে মাঠে না থাকার কারণে সদস্য সচিবের পদ থেকে অপসারণ করেছেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এখন কেউ যদি বিএনপির মুখপাত্র ছাড়া মিডিয়ায় বক্তব্য দেয় কিংবা নিজেকে হাইলাইট করতে চায় সেটা সম্পূর্ন শিষ্টাচার বহির্ভূত কাজ। মহানগর বিএনপির নেতৃত্বে যারা আছেন তাদের বাইরে কারো বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয় বলে দাবী করেন জিয়াউদ্দীন সিকদার।
দলীয় কার্যক্রম দেখে এটা স্পষ্ট যে মহানগর বিএনপি বর্তমানে তিনভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। আহবায়ক মনিরুজ্জামান ফারুক ও সদস্য সচিব জিয়া সিকদারের নেতৃত্বে একটি অংশ। অপরদিকে আফরোজা খানম নাসরিন তার অনুসারীদের নিয়ে নিজস্ব বলয় তৈরী করার চেষ্টা করছেন। এর বাইরে পদবঞ্চিতরা একাট্টা হয়ে মাঠে নেমেছেন। দলের মধ্যে এ বিভক্তি ভাল লক্ষণ নয় বলে মনে করছেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। ১৭ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটির নেতারা এভাবে দলাদলি করলে সাংগঠনিক তৎপরতা দুর্বল হবে। যার নেতীবাচক প্রভাব পড়বে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে।
দীর্ঘ ৮ বছর মহানগর বিএনপির নেতৃত্বে ছিলেন চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা মজিবর রহমান সরোয়ার। ২০২১ সালের ৩ নভেম্বর তাকে সরিয়ে মনিরুজ্জামান ফারুককে আহবায়ক, আলী হায়দার বাবুলকে ১ নম্বর যুগ্ম আহ্বায়ক ও মীর জাহিদুল কবিরকে সদস্য সচিব করে নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়। এরপর ২০২২ সালের ২২শে জানুয়ারি ৪১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ আহবায়ক কমিটি অনুমোদন দেয় কেন্দ্র। সেখানে আগের কমিটির ১৭১ সদস্যের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ নেতারা কেউ স্থান পাননি। সরোয়ার বিরোধীদের দিয়েই মূলত এ কমিটি গঠন করা হয়েছিল। ফলে শুরু থেকেই কমিটি নিয়ে বিতর্ক ও নানা রকমের দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয়। এর জেরে দলটির কর্মসূচিতে প্রায়ই নেতাদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিল ও নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ হতো। বিশেষ করে মজিবর রহমান সরোয়ারের অনুসারীদের এই কমিটিতে না রাখায় শুরু থেকেই তাঁদের বিরোধীতার মুখে পড়েছিলেন আহবায়ক কমিটির নেতারা। এক পর্যায়ে কমিটির লোকজন নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বে জড়ান। এতে করে বরিশাল বিএনপির রাজনীতি লেজেগোবরে অবস্থা হয়। অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোতেও চলছিলো একই অবস্থা। এমন পরিস্থিতিতে সদ্য বিদায়ী বছরের ১৩ জুন রাতে আহবায়ক কমিটি ভেঙ্গে ৭ জুলাই মনিরুজ্জামান ফারুককে আহবায়ক, জিয়া উদ্দীন সিকদারকে সদস্য সচিব এবং অফরোজা খানম নাসরিনকে ১ নম্বর যুগ্ম আহবায়ক করে নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়। কিন্তু এই কমিটি নিয়েও শুরু হয় নানা ধরণের বিতর্ক। আর এ বিতর্কে নতুন মাত্রা পায় ৭ অক্টোবর ৪২ সদস্যের পূর্নাঙ্গ আহবায়ক কমিটি ঘোষণার পর। কারণ যুগ্ম আহবায়ক হিসেবে যাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তারা অপেক্ষাকৃত জুনিয়র নেতা। অনেকে আবার ছিলেন দীর্ঘদিন ধরে নিষ্ক্রিয়। যদিও এমনটা মানতে নারাজ মহানগর বিএনপির আহবায়ক মনিরুজ্জামান ফারুক। তার দাবী ১ নম্বর যুগ্ম আহবায়ক আফরোজা খানম নাসরিনের নীচে অনেক সিনিয়র নেতা নামতে রাজী না হওয়ায় সমস্যাটা বেধেছে। কারণ নাসরীনের উপরে তো কাউকে যুগ্ম আহবায়ক করা সম্ভব না। নাসরিন ইস্যুতেই মূলত অনেকে কমিটিতে থাকার আগ্রহ প্রকাশ করেননি।
এদিকে আগামী ৬০ থেকে ৯০দিনের মধ্যে বরিশাল বিভাগের অধীন মহানগর ও সকল জেলা বিএনপির কার্যকরী কমিটি সম্মেলনের মাধ্যমে গঠনের নির্দেশনা দিয়ে কেন্দ্র থেকে চিঠি ইস্যু করা হয় গত ২৬শে নভেম্বর। দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী স্বাক্ষরিত পত্রে দ্রুত সময়ের মধ্যে সম্মেলন সম্পন্ন করার তাগিদ দেন। এ ধরণের নির্দেশনা পাওয়ার পর ৩০শে নভেম্বর সন্ধ্যায় দলীয় কার্যালয়ে সভা আহবান করে মহানগর বিএনপি। এতে আহবায়ক কমিটির সকল সদস্যদের উপস্থিত থাকার অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দেন সংগঠনের সদস্য সচিব জিয়াউদ্দীন সিকদার। উদ্দেশ্য ছিলো মহানগরীর ৩০ ওয়ার্ড কমিটি বিলুপ্ত করা। কিন্তু আহবায়ক, সদস্য সচিবসহ ১৭জন সদস্য সভায় উপস্থিত হলেও যুগ্ম আহবায়ক সহ ২৫জন অনুপস্থিত ছিলেন। ফলে কোরাম সংকটের কারণে সেটা সম্ভব হয়নি। এ প্রসঙ্গে আফরোজা খানম নাসরিন বলছেন ‘ সভার ব্যাপারে তাকে আগেভাগে জানানো হয়নি। কেবলমাত্র হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে এ সংক্রান্ত চিঠি দেন সদস্য সচিব। সেখানে সভার এজেন্ডা উল্লেখ ছিলোনা। কিন্তু সভা শুরুর পর যখন ওয়ার্ড কমিটি ভেঙ্গে দেওয়ার প্রসঙ্গ ওঠে তখন তিনি এর বিরোধীতা করেছেন।
এ ব্যাপারে মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব জিয়া উদ্দীন সিকদার বলেন, সভার তিনদিন আগে মহানগর বিএনপির হোয়াটসঅ্যাপ এবং ম্যাসেঞ্জার গ্রুপে এ সংক্রান্ত চিঠি পোষ্ট করার পাশাপাশি কমিটির সকল সদস্যদের সাথে আমি নিজে কথা বলে যথাসময়ে উপস্থিত থাকার অনুরোধ জানিয়েছিলাম।
মহানগর বিএনপির একাধিক যুগ্ম আহবায়ক ও সদস্য বলছেন আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সংগঠনের সদস্য সচিব জিয়া উদ্দীন সিকদারের সঙ্গে নাসরিনের বিরোধ রয়েছে। সম্মেলনের মাধ্যমে যে কমিটি হবে সেখানে জিয়া সিকদারের পাশপাশি আফরোজা খানমও সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী। মূলত ওয়ার্ড কমিটির নেতাদের ভোটেই নির্বাচিত হবেন সভাপতি-সম্পাদকরা। পূর্বের কমিটি ভেঙ্গে নতুন কমিটি গঠন হলে সেখানে সদস্য সচিবের পাল্লা ভারী হবে এমন আশঙ্কায় আছেন নাসরিন। তার ধারণা জিয়া সিকদার ব্যক্তি পছন্দের লোক দিয়ে আগামীতে ওয়ার্ড কমিটি গঠনের পরিকল্পনা করছেন। মূলত এসব চিন্তাভাবনা থেকেই বিরোধীতা করেছেন আফরোজা খানম নাসরিন।
নাসরিনের এমন ধারণা উড়িয়ে দিয়ে জিয়া সিকদার বলেন-কমিটিতে ব্যক্তি পছন্দকে গুরুত্ব দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশনা মোতাবেক সবচেয়ে ত্যাগী, দুর্দীনের কর্মীদের যথাযথ মূল্যায়নের মাধ্যমেই ওয়ার্ড কমিটি হবে। এরপর যথা নিয়মে সম্মেলনের মাধ্যমে গঠন হবে মহানগর বিএনপির কমিটি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে মহানগর বিএনপির এক যুগ্ম আহবায়ক বলেন ‘ নাসরিন সাধারণ সম্পাদক পদে লড়তে চান। কিন্তু তার বড় প্রতিদ্বন্দ্বী জিয়া। অপরদিকে মীর জাহিদও এ পদে প্রার্থী হবেন। বর্তমানে মহানগরী যে ৩০টি ওয়ার্ড কমিটি আছে তা মীর জাহিদের সময় গঠন করা। প্রসঙ্গত কারণে আগামীতে যে ওয়ার্ড কমিটি হবে সেখানে নিজস্ব বলয় তৈরীর চেষ্টা করবেন জিয়া সিকদার এমন ধারণা তৈরী হয়েছে নাসরিনসহ একাধিক যুগ্ম আহবায়কের মধ্যে। ফলে তারা চাইছেন না এই মুহূর্তে কমিটি ভেঙ্গে দেওয়া হোক।