মাদকের আখড়া বরিশালের নদী তীরবর্তী এলাকা বস্তির মধ্যে রয়েছে সিসি ক্যামেরার পাহারা মাদকের আখড়া বরিশালের নদী তীরবর্তী এলাকা বস্তির মধ্যে রয়েছে সিসি ক্যামেরার পাহারা - ajkerparibartan.com
মাদকের আখড়া বরিশালের নদী তীরবর্তী এলাকা বস্তির মধ্যে রয়েছে সিসি ক্যামেরার পাহারা

3:06 pm , December 1, 2024

বিশেষ প্রতিবেদক ॥  সদর উপজেলার লামছড়ি থেকে শুরু করে নগরীর ত্রিশ গোডাউন পর্যন্ত নদী তীরবর্তী এই ৭ কিলোমিটার বেড়িবাধজুড়ে গড়ে উঠেছে অসংখ্য অবৈধ দোকানপাট, ঘরবাড়ি ও বিভিন্ন স্থাপনা। আর এসব স্থাপনাকে ঘীরে জমজমাট হয়ে উঠেছে মাদকের বাণিজ্য। নদী তীরবর্তী কলোনী বা বস্তিগুলো রীতিমতো মাদকের আখড়া হিসেবে পরিচিত। এসব বস্তির মধ্যে নিরাপদ মাদক বাণিজ্য চালাতে বসানো হয়েছে সিসি ক্যামেরাও। অপরিচিত বা সন্দেহজনক কেউ কলোনির ভিতর প্রবেশ মাত্রই সিসি ক্যামেরায় দেখে নিয়ে সতর্ক হয়ে যায় মাদক ব্যবসায়ীরা। যে কারণে পুলিশ বা গোয়েন্দা সংস্থার অভিযানে মাদক উদ্ধার হলেও মাদক ব্যবসায়ী আটক হয় খুবই কম।
সরেজমিনে বরিশালের ভাটারখাল বস্তি ঘুরে দেখা গেছে সিসি ক্যামেরার এই রাজত্ব। জানা গেছে পলাশপুর, রসুলপুর ও কেডিসি সহ আশেপাশের বস্তিগুলোতে নির্দিষ্ট কয়েকটি পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এরকম সিসি ক্যামেরা বসানো হয়েছে প্রবেশপথে। ভাটারখাল বস্তির ভিতর যাতায়াতের জন্য ৭-৮টি সরু গলির প্রতিটি গলিতে রয়েছে একাধিক সিসি ক্যামেরা। এখানে সিসি ক্যামেরা কেন এমন  প্রশ্নের জবাবে বস্তির কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, দুটো বাড়ির নিরাপত্তার জন্য এই ক্যামেরা বসিয়েছেন বাড়ির মালিকরা।
৫৮ বর্গকিলোমিটার বরিশাল সিটি করপোরেশন এলাকায় প্রায় ২২টি বস্তি রয়েছে। এর প্রায় সবগুলো বস্তি গড়ে উঠেছে বরিশালের প্রাণের স্পন্দন কীর্তনখোলা নদী ঘীরে। নদী তীর ঘেঁষা শহরের অপরূপ সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে চরবাড়িয়া বেড়িবাধ থেকে নগরীর লঞ্চঘাট, মুক্তিযোদ্ধা পার্ক ও ত্রিশ গোডাউন এলাকায় মানুষের ভিড় ক্রমশ বাড়ছে। আর এই ভিড় যত বাড়ছে, ততই বাড়ছে মাদকের বিস্তার। সন্ধ্যার পরই এই এলাকাগুলোর চিত্র বদলে যায়। মাদকাসক্তদের আখড়ায় পরিণত হয় নদী তীরবর্তী এলাকা। গাঁজা ও অন্যান্য মাদকের গন্ধে ভারী হয়ে ওঠে এখানের আকাশ-বাতাস। ভদ্রলোক ও সভ্য সমাজের মানুষগুলো গাঁ বাঁচাতে এই এলাকা থেকে দ্রুত সটকে পড়েন।  ভীড় করেন নেশাখোর ও বখাটেরা।
নগরীর বস্তিগুলোতে দেড় লাখের বেশি মানুষের বাস। যাদের বেশিরভাগ নি¤œ আয়ের। এই মানুষগুলো আবার রাজনৈতিক দলগুলোর ভোট ব্যাংক হিসেবে পরিচিত। যে কারণে এদের মধ্যে সরদার রয়েছে এবং ওই সরদারের রয়েছে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা। তবে শুধু যে নি¤œআয়ের লোকজনই এখানে বসবাস করেন তা নয়। স্প্রীডবোট, ইজিবাইক ও অটোরিকশা মালিক ছাড়াও অনেক ছোটখাটো ব্যবসায়ীরা থাকেন সেখানে। মাদকের আখড়া হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে কেডিসি বস্তি, ভাটারখাল, পলাশপুর, বঙ্গবন্ধু কলোনি, স্টেডিয়াম বস্তি ও কলাপট্টিসহ বেশ কয়েকটি বস্তি। কেডিসি বস্তির আশেপাশের চা দোকানে বসে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেই তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মহিলা কিংবা কিশোর এসে জানতে চায় – কিছু খুঁজছেন, কি লাগবে? আর সন্দেহ হলে তেড়চা প্রশ্ন, কেন এসেছেন? কি চাই? এই বস্তিতেই গত ৪ অক্টোবর যৌথ বাহিনীর অভিযানে একজন মাদক ব্যবসায়ীকে আটকের পর কোতোয়ালি মডেল থানায় হস্তান্তর করা হয়।
বরিশালের এই কীর্তনখোলা নদী তীর ঘেঁষা সুন্দর শান বাধানো পায়ে চলা পথ চরকাউয়া খেয়াঘাট থেকে চলে গেছে দক্ষিণ দিকে মুক্তিযোদ্ধা পার্ক হয়ে আরো দক্ষিণে কেডিসি পর্যন্ত। এরপর কিছুটা সংযোগহীন কাদামাটির পথ পেরোলেই চাঁদমারি খেয়াঘাট বটতলা ব্রীজ। ব্রীজের ওপারে ত্রিশ গোডাউন এলাকার মনোরম পরিবেশে নদীর সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে ছুটে আসেন দর্শনার্থীরা। এখানে ডিসিঘাট থেকে ভাটারখাল বস্তির সংযোগ সেতুটি দীর্ঘদিন ঝুকিপূর্ণ পড়ে আছে। নৌ-পুলিশ ও কোষ্টগার্ডের ঘাটি এই ভাঙা পুলের পাশেই। এই ভাঙা ব্রীজ ঠিক করে দেয়ার জন্য বহুবার আবেদন করেছেন কোষ্টগার্ড কর্তৃপক্ষ। আমলে নেয়নি সংশ্লিষ্ট প্রশাসন। কেননা এই ভাঙা ব্রীজেরও রয়েছে মাদক ব্যবসায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। একসাথে চার-পাঁচজন এ ব্রীজ পার হয়ে এ্যাটাক করতে পারবে না। আগাম সতর্ক থাকা যাবে বলেই এই ব্রীজ সংস্কার হয়না বলে জানালেন স্থানীয় ডিসিঘাট এলাকার ব্যবসায়ীরা। বহুকষ্টে পুলটি পার হলেই চোখে পড়ে হাঁস-মুরগির ঘরসহ দোকানপাট তৈরি করে আটকে রাখা হয়েছে পায়েচলা পথ। নদী তীরবর্তী বেড়িবাধ পুরোটাই এভাবে দখল নিয়েছে বস্তিবাসী। বেশিরভাগ দোকানেই কিন্তু বখাটে জটলা লেগেই আছে। বস্তি এলাকায় প্রবেশ করতে গেলেই লুকানো সিসি ক্যামেরায় ধরা পরবে প্রবেশকারী। এমনভাবে সিসি ক্যামেরা বসানো যা আগে থেকে জানা না থাকলে সাধারণ কারো চোখেই পড়বে না। চরকাউয়া খেয়াঘাট থেকে নদী তীরের তিনফুটের এই পায়েচলা পথের পাশে যেসব বস্তিঘর রয়েছে, এগুলোর বাসিন্দা মেয়েদের সাথে তরুণ ও যুবকদের সখ্যতা যেন বন্ধুর মতো। পথে যেতে যেতে হঠাৎ মশকরার ছলে হাত বাড়িয়ে দিয়ে টাকা ও মাদকের লেনদেন বেশ স্পষ্ট এখানে। কখনো কখনো পুলিশের সাদা পোশাকের ছুটোছুটিও চোখে পড়ে। দু/চারজনকে তারা হাতেনাতে আটকও করেন গাঁজার পোটলাসহ। তবে তা নিতান্তই আইওয়াশ বৈ আর কিছু নয়। ইয়াবাসহ আরো কতশত মাদকের বিচরণ আড়ালেই থেকে যায়। কারণ রাজনৈতিক প্রভাবিত এই আখড়া থেকে তাদেরকেও মাসোহারা দেয়ার অভিযোগ আশেপাশের ব্যবসায়ীদের।
সচেতন নাগরিক কাজী মিজানুর রহমান, মাহবুব খান, এমইউ রিপন বলেন, শহরের নদী তীর ঘেঁষা এই চমৎকার সৌন্দর্য্য বিনষ্ট হচ্ছে শুধুমাত্র সু-পরিকল্পনা ও যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে। মাদক ব্যবসাকে টিকিয়ে রাখতেই নদী পাড়ে কোনো উন্নয়ন হতে দেয়না রাজনৈতিক দলের নেতারাই।
একটু লক্ষ্য করে দেখবেন বিভিন্ন বস্তির নেতা যারা বিগত সময়ে আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ ছিলেন, তারা এখন কিন্তু বর্তমান রাজনৈতিক দলগুলোর ছত্রছায়ায় চলে আসতে শুরু করেছে।
লঞ্চঘাট থেকে ত্রিশ গোডাউন হয়ে কীর্তনখোলা ব্রিজ ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা পুরাতন দপদপিয়া ফেরীঘাট পর্যন্ত মাদকের বিস্তার এখন। বস্তিগুলোর মেয়েদের ব্যবহার করেই চলছে এখানে মাদকের বিচরণ। আসমা, সুমি, রেশমা, বেবি, লিলি, নীলা সহ অসংখ্য মহিলা মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে মাদকের  মামলা রয়েছে। এদের মধ্যে কেউ নদীভাঙ্গনের শিকার হয়েছেন আবার অনেকে  কাছাকাছি কোন গ্রাম থেকে এসে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের সহযোগিতায় আশ্রয় কিনেছেন এই নদীতীরের খাসজমিতে।
এদের ঘীরেই গড়ে উঠেছে শহরের মাদকের বড় নেটওয়ার্ক। ভয়াবহ মাদকের প্রভাব ক্রমশ ধ্বংস করে দিচ্ছে যুব সমাজের মেধা ও মননকে দাবী করে বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার শফিকুল ইসলাম বলেন, বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। যে কারণে সবার আগে মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা অব্যাহত রেখেছে মেট্রোপলিটন পুলিশ। এখানে গোয়েন্দা সংস্থা ও পুলিশ সদস্য কারো গাফলতির প্রমাণ পেলে তাদের কঠিন শাস্তির আওতায় আনা হবে।

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন    
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী মিরাজ মাহমুদ
 
বার্তা ও বানিজ্যিক কার্যালয়ঃ কুশলা হাউজ, ১৩৮ বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সড়ক,
সদর রোড (শহীদ মিনারের বিপরীতে), বরিশাল-৮২০০।
© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
Developed by NEXTZEN-IT