3:49 pm , November 29, 2024
বিশেষ প্রতিবেদক ॥ দূর বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট আরেকটি ঘূর্ণিঝড়ে ভর করে মেঘলা ও গুমোট আবহাওয়ায় বরিশাল কৃষি অঞ্চলের কৃষকদের কপালে দুশ্চিন্তার ভাজ ক্রমশ গভীর হচ্ছে। গত দুদিনের বিরুপ আবহাওয়ায় এ অঞ্চলের প্রায় ৮ লাখ হেক্টর জমিতে উঠতি আমন ধানে শীষকাটা লেদা পোকার আক্রমনের ঝুঁকি খুব বেশী বলে জানিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।
হেমন্তের শেষপ্রান্তে এসে মেঘনা অববাহিকা সহ পুরো বরিশাল অঞ্চলজুড়ে শেষরাত থেকে মাঝারী কুয়াশায় দিগন্ত ঢেকে গেলেও গত দুদিন ধরে মেঘলা আকাশ প্রায়ই সূর্যকে আড়াল করছে। শনিবার ঘূর্ণিঝড়টি ভারতের তামুলনাড়– উপকূল করতে পারে বলে আবহাওয়া অফিস থেকে জানানো হয়েছে। আরও দুদিন এ ধরনের পরিস্থিতি অব্যাহত থাকার কথাও বলছে আবহাওয়া দপ্তর। ফলে বরিশাল সহ উপকূল অঞ্চলজুড়ে অস্থায়ী দমকা হাওয়া সহ বজ্রবৃষ্টির সাথে তাপমাত্রার পারদ ওপরে ওঠার কথাও জানিয়েছে আবহাওয়া অফিস। শনিবার পর্যন্ত তাপমাত্রার পারদ স্বাভাবিকের ওপরে থাকার পরে রোববার থেকে তা আবার নি¤œমুখী হওয়ার সম্ভবনার কথা বলেছে আবহাওয়া বিভাগ ।
দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত গভীর নি¤œচাপটি বরিশালের পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে দেড় হাজার কিলোমিটার দূরে অবস্থান করলেও তার প্রভাবে এ অঞ্চলে বিরুপ আবহাওয়া পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন কৃষকরা। প্রায় ২৪ লাখ টন চাল উৎপাদনের লক্ষে ৮লাখ হেক্টরের আবাদকৃত প্রধান দানাদার খাদ্য ফসল আমনের পুরোটা এখনো মাঠে। এবার বিলম্বিত বৃষ্টিপাতের কারণে বরিশাল অঞ্চলে আমন এখন নরম দানার পর্যায়ে। ফলে কর্তণ শুরু হতে আরো কমপক্ষে ১৫দিন বাকি। স্থানীয় জাতের আমনের কর্তণ শুরু হবে আরো মাসখানেক বাদে। অথচ বৈরী আবহাওয়া বার বারই চোখ রাঙাচ্ছে।
এবার মূল বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির অকালে আউশের ক্ষতির সাথে আমন বীজতলা তৈরীও বিলম্বিত হয়েছে। অপরদিকে শরৎ ও হেমন্তের অকাল ভারী বর্ষণ আউশ উৎপদনে প্রায় ১ লাখ টন ঘাটতির সাথে আমনের রোপনকেও বাধাগ্রস্ত করে। আবহাওয়ার এ বৈপরিত্যে কৃষির সাথে জনস্বাস্থ্য ও প্রকৃতিতেও নানা বিরুপ প্রভাব অব্যাহত রয়েছে। আবহাওয়ার এ বিরুপ আচরনে বরিশাল অঞ্চলজুড়ে জ¦র সহ ঠান্ডাজনিত নানা সমস্যায় আক্রান্ত হচ্ছে শিশু ও বয়োবৃদ্ধ সহ নানা বয়সের মানুষ। চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারসহ সরকারি হাসপাতালগুলাতে এ ধরনের রোগীদের আগমন প্রতিদিনই বাড়ছে। অপরদিকে এবার বর্ষা মৌসুমজুড়ে বৃষ্টির চিরচেনা রুপের দেখা না মিললেও শরতের শেষপ্রান্ত থেকে হেমন্তের শেষভাগে অসময়ের অতিবর্ষণ কৃষিকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। অথচ দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু বরিশাল উপকূল থেকে বিদায় হয়েছে অক্টোবরের মধ্যভাগের পরেই। কিন্তু এর পরেও ঘূর্ণিঝড় দানায় ভর করে গত অক্টোবরে বরিশালে স্বাভাবিকের ৬২.১% বেশী বৃষ্টি হয়েছে। হেমন্তের শেষ প্রান্তেও স্বাভাবিকের অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতে বরিশাল অঞ্চলজুড়ে এডিস মশাবাহী রোগ ডেঙ্গুর দাপট অব্যাহত রয়েছে। পুরো বছরজুড়ে যে পরিমান রোগী সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নিতে এসেছিলেন, শুধু অক্টোবরেই তার প্রায় সমান ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। চলতি নভেম্বরেও পুরো বরিশাল অঞ্চলজুড়ে ডেঙ্গুর দাপট প্রায় সমানতালেই অব্যাহত রয়েছে। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুতে ১৮ জনের মৃত্যু হলেও শুধু অক্টোবরেই মারা গেছেন আরো ১৭ জন। চলতি মাসেও আক্রান্তের সাথে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে।
হেমন্তের শেষভাগে শেষ রাতের কুয়াশার দাপট শীতের আগাম বার্তা দিলেও বেলা বাড়ার সাথে তাপমাত্রার পারদ স্বাভাবিকের ওপরে উঠে যাচ্ছে। আবহাওয়া বিভাগের মতে হেমন্তের মধ্যবর্তি অক্টোবরে বরিশালে দিনের সর্বোচ্চ স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৩১.৬ ডিগ্রী থাকার কথা। কিন্তু গতমাসে তা ৩৫-৩৬ ডিগ্রীতে উন্নীত হয়। আবার চলতি নভেম্বরে বরিশালের দিনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ২৯.৬ ডিগ্রীর স্থলে মাসের প্রথমদিনেই তা ছিল প্রায় ৩৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস। শুক্রবার দুপুরেও বরিশালে তাপমাত্রার পারদ ছিল স্বাভাবিকের প্রায় ২ ডিগ্রী ওপরে ৩১.২ ডিগ্রী সেলসিয়াস।
গত জানুয়ারী ও ফেব্রুয়ারী মাসে বরিশালে কোন বৃষ্টি হয়নি। কিন্তু মার্চে ৩০ ভাগ এবং এপ্রিলে ৮৬% কম বৃষ্টির পরে ঘূর্ণিঝড় রিমাল-এ ভর করে মে মাসে স্বাভাবিকের প্রায় ৫০ ভাগ বেশী বৃষ্টি হয়। কিন্তু জুন মাসে প্রায় ৬০ ভাগ এবং জুলাই মাসেও স্বাভাবিকের প্রায় ৩১ ভাগ কম বৃষ্টির প্রভাব পড়ে বরিশালের ফসলের মাঠে। আবার ভাদ্রের পূর্ণিমায় ভর করে লাগাতার প্রবল বর্ষণে আগষ্ট মাসে ৬২% বেশী বৃষ্টিপাতে উঠতি আউশ আরেক দফা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেপ্টেম্বর মাসেও স্বাভাবিকের প্রায় ৫২% বেশী বৃষ্টির পরে অক্টোবরে বরিশালে স্বাভাবিকের ৬২.১% বেশী বৃষ্টি হয়েছে। গত কয়েক বছর ধরেই ঘূর্ণিঝড়-প্লাবনের সাথে অস্বাভাবিক বজ্রপাত সহ অসময়ের অতিভারী বর্ষণের সম্মুখিন হচ্ছে পুরো বরিশাল সহ সংলগ্ন উপকূলীয় অঞ্চল। তবে প্রকৃতির এ বৈরী আচরনকে জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব বলতে চাচ্ছেন না আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা। একই মৌসুমে ঘন ঘন আবহাওয়ার পরিবর্তনকে জলবায়ুর ভারসাম্যহীনতা বলছেন অনেকে।