3:36 pm , November 27, 2024
দুনিয়ার ধ্যান-ধারণা বাদ দিয়ে
চরমোনাইর শততম মাহফিল শুরু
বিশেষ প্রতিবেদক ॥ লাখো মুসুল্লীদের উপস্থিতিতে বুধবার দুপুরে উদ্বোধনী বয়ানের মধ্য দিয়ে চরমোনাইর তিন দিনব্যাপী বার্ষিক অগ্রহায়ণ এর মাহফিল শুরু হয়েছে। এবারের মাহফিল ছিলো একশতম। ১৯২৪ সালে চরমোনাইর ময়দানে ওয়াজ মাহফিলের সূচনা হয়েছিল। উদ্বোধনী বয়ানে চরমোনাই পীর আলহাজ্ব হযরত মাওলানা মুফতী সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম বলেন, চরমোনাই মাহফিল দুনিয়াবি উদ্দেশ্যে নয় বরং পথভোলা মানুষকে আল্লাহর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্যই এই মাহফিল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সুতরাং এখানে দুনিয়াবি কোনো উদ্দেশ্য সাধনের জন্য আসার প্রয়োজন নেই। যদি এমন কেউ এসে থাকেন তবে নিয়ত পরিবর্তন করে আত্মশুদ্ধির জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করুন। এ সময় তিনি পবিত্র কুরআন ও সহিহ বুখারীর হাদিস থেকে আল্লাহর আদেশ এবং রাসুলে করিম (সা:) এর বক্তব্য তুলে ধরেন। বুধবার সরেজমিনে বরিশাল সদর উপজেলার চরমোনাই ইউনিয়নের চরমোনাই মাদ্রাসা ঘুরে দেখা গেছে প্রায় লাখো মানুষের উপস্থিতিতে অন্যরকম এক শান্তির ছোঁয়া এখানের আকাশে বাতাসে। চারিদিকে মৃদুমন্দ আল্লাহহু আকবর ধ্বনি। বেলা দুটোয় জোহরের নামাজ আদায় শেষে চরমোনাই মাদরাসার মূল মাঠ ও ৩ নম্বর মাঠ নিয়ে দুটি মাঠে চারটি ব্যারিকেড তৈরি করে মাঝখানে হাঁটাচলার ও মূল মঞ্চে যাওয়ার পথ তৈরি করা হয়েছে। কানায় কানায় পরিপূর্ণ মাঠের সীমানা ছাড়িয়ে মুসল্লীদের ভীড় ছিল, মসজিদ ও সড়কের পাশের ফাঁকা জায়গাগুলোতেও। দেশের ৬৪ জেলা থেকেই এখানে মুসুল্লীরা এসে জড়ো হয়েছেন। নদী তীরবর্তী এলাকায় দাঁড়িয়ে ছিলো ১১টি বড় লঞ্চ। এছাড়াও সড়ক পথে বরিশাল থেকে চরকাউয়া হয়ে বাস ও মাইক্রোবাসে এসেছেন অসংখ্য মুসল্লী। বিভিন্ন ধরণের যানবাহন রাখার জন্য পৃথক ব্যবস্থা ছিলো। ওজু, গোসল ও খাবার পানির চমৎকার বন্দোবস্ত মুগ্ধ করে সাধারণ মুসল্লীদের। রয়েছে ১০০ শয্যার মাহফিল হাসপাতাল। অধ্যাপক ডাঃ মোহাম্মদ আক্কাস আলী এই হাসপাতালের পরিচালক। এখানে ১১ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অধীনে আরো ৪০ জন চিকিৎসকের সমন্বয়ে চিকিৎসা সেবা পরিচালিত হচ্ছে। ৬ টি এ্যাম্বুলেন্স ও একটি নৌ এ্যাম্বুলেন্স মাহফিল হাসপাতালে কার্যক্রমে নিয়োজিত রয়েছে। মাঠে অসুস্থ হয়ে পড়া রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে পৌঁছানোর জন্য নিযুক্ত রয়েছে বিশেষ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের নিয়মিত টহল চোখে পড়ে মাহফিল মাঠের চারপাশে। মাহফিলকে ঘীরে অসংখ্য দোকানপাট ও বাণিজ্যিক পসরা সাজানো হয়েছে। ইসলামে এই বাণিজ্যকে হালাল করা হয়েছে উল্লেখ করে ঘুষখোর ও দুর্নীতিবাজ এর পরিণতি তুলে ধরেন চরমোনাই পীর রেজাউল করিম। এর আগে চরমোনাই পীর আরো বলেন, যারা চরমোনাইতে নতুন এসেছেন, তারা দুনিয়ার ধ্যান-খেয়াল বিদায় করে দিয়ে আখেরাতের খেয়াল-ধ্যান অন্তরে জায়গা দেন। দিল থেকে বড়ত্ব এবং আমিত্ব ভাব বের করে দিয়ে আল্লাহর কুদরতি পায়ে নিজেকে বিলীন করে দিতে হবে। সদা-সর্বদা আল্লাহর জিকিরের মাধ্যমে দিলকে তরতাজা রেখে আল্লাহর ওলী হয়ে চরমোনাই থেকে ফিরে যাবেন।
উদ্বোধনী বয়ান শেষে মাহফিলের নিয়ম-কানুন সম্পর্কে বিশদ বর্ণনা করেন সৈয়দ রেজাউল করিম।
জানা যায়, মাহফিল উপলক্ষে কয়েকদিন আগে থেকেই মুসল্লীদের আগমন শুরু হয়। লাখো মানুষের ভীড়ে মুখরিত হয়ে ওঠে চরমোনাই ইউনিয়ন। নদী তীরবর্তী এলাকা হওয়ার কারণে তাবুর ভেতরের আলোগুলোই দূর থেকে আলোকসজ্জার মতো মনে হয়। বাস্তবে একেবারেই সাদামাঠা। এই মাহফিল এলাকায় কোনোরকম আলোকসজ্জা বা সাজসজ্জা এখানে নেই। তাবুগুলোও অতিসাধারণ। বুধবার সকাল ৮টা থেকে মাহফিলে আগত মুসল্লীদের সহস্রাধিক হালকায় বিভক্ত করে হাতে-কলমে সালাত ও ইসলামের বুনিয়াদি বিষয়ে বাস্তব প্রশিক্ষণ দেয়া হয় বলে জানালেন চরমোনাই মাদ্রাসার একজন শিক্ষক। পাশে ছিলেন আরো কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবক বা কমান্ডার। দুটি মাঠে মাহফিলের শৃঙ্খলা রক্ষায় নিযুক্ত করা হয়েছে এই বিশাল স্বেচ্ছাসেবক ও কমা-ার বাহিনী। নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছে বাংলাদেশ মুজাহিদ কমিটির নিজস্ব নিরাপত্তা বাহিনীর স্পেশাল টিম।
সারাদেশ থেকে আগত মুসল্লীদের খাবারের জন্য উভয় মাঠের চারিদিকে সুপেয় নিরাপদ পানির ব্যবস্থাসহ রয়েছে সহস্রাধিক মানসম্মত টয়লেট, ওজু এবং গোসলের ব্যবস্থা। তিন দিনব্যাপী বিশাল এ মাহফিলের প্রথমদিনে বাংলাদেশ কুরআন শিক্ষা বোর্ডের উদ্যোগে প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয় দিন বৃহস্পতিবার সারাদেশ থেকে আগত ওলামায়ে কিরামদের নিয়ে ওলামা সম্মেলন ও শেষদিন শুক্রবার সকালে সারাদেশ থেকে আগত ছাত্র-জনতাকে নিয়ে ছাত্র গণজমায়েত অনুষ্ঠিত হবে বলে জানান চরমোনাই পীর। এসময় তিনি বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দেন।
মাহফিলকে ঘীরে আরো অনেকগুলো কর্মসূচি গ্রহণ করেছে ইসলামি যুব আন্দোলন। তারা এখানে আগত যুবক, শ্রমিকদের নিয়ে পৃথক মতবিনিময় সভার আয়োজন করে।
আগামীকাল ৩০ নভেম্বর শনিবার সকাল সাড়ে ৮টায় আখেরি বয়ানের মধ্য দিয়ে তিন দিনব্যাপী এই মাহফিলের সমাপ্তি হবে।