3:15 pm , November 22, 2024
হেলাল উদ্দিন ॥ ২০১৯ সালের ১৮ই এপ্রিল দিবাগত রাতে নিজ ঘরে ঘুমন্ত অবস্থায় খুন হয়েছিলেন বরিশাল সদর উপজেলার চরমোনাইয়ের বাসিন্দা দলিল লেখক রেজাউল করিম রিয়াজ। ঘটনার ৫ বছর অতিবাহিত হলেও কোন কুল কিনারা হয়নি এই হত্যা মামলার। থানা পুলিশ,ডিবি ও সিআইডি মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ৪ টি সংস্থা মামলার তদন্ত করেছে। কিন্তু কোন সংস্থার তদন্ত রিপোর্টই আদালতের কাছে গ্রহণ যোগ্য হয়নি। ফলে এক সংস্থা থেকে অন্য সংস্থায় ঘুরপাক খাচ্ছে চাঞ্চল্যকর এই মামলাটি। মামলার এমন ভবিষ্যতহীন গন্তব্যে হতাশ মামলার বাদীপক্ষ। অন্যদিকে বরিশাল আদালতের বিশিষ্ট আইনজীবী আবুল কালাম আজাদ ইমন বলেছেন-রিয়াজ হত্যা মামলার তদন্তের যে গতি তাতে মনে হচ্ছে মামলাটি সাংবাদিক সাগর-রুনি হত্যাকান্ডের তদন্তের মত কচ্ছপ গতিতে চলছে। এটা প্রত্যাশিত নয়। তদন্ত সংস্থার উচিৎ আন্তরিকতার সাথে তদন্ত করে সঠিক রিপোর্ট আদালতের কাছে পেশ করা। না হলে আমরা একটি বাজে উদাহরণের সাক্ষী হবো। তিনি আরো বলেন, অনেক সময় চাঞ্চল্যকর কোন মামলার তদন্ত করতে গিয়ে তদন্তকারী সংস্থা পরিবর্তন হয়। এখানে বাদীরও ভূমিকা থাকে। সব সময় আদালদের কাছে শেষ তদন্তকারী সংস্থার রিপোর্টই গ্রহণযোগ্য হয়। অনেক সময় আদালত একাধিক তদন্তকারী সংস্থার তদন্ত রিপোর্ট সমজাতীয় হলে তাও গ্রহণ করে।
মামলাটি বর্তমানে বরিশাল পিবিআই তদন্ত করছে। তদন্তকারী কর্মকর্তা পরিদর্শক আল মামুন বলেন, আমি মাস তিনেক হলো তদন্তভার পেয়েছি। অগ্রগতি যে নেই তা বলবো না। তবে তদন্তের স্বার্থে কিছু বলা যাচ্ছে না। একটু বিলম্ব হলেও আমি একটি সঠিক তদন্ত রিপোর্ট দিতে চাই। যা আদালতসহ সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে।
এর আগে প্রায় বছর খানেক তদন্ত করে সিআইডি। সরকারের এই তদন্তকারী সংস্থাটি রিয়াজের স্ত্রীসহ ৫ জনকে অভিযুক্ত করে চলতি বছরের মে মাসে চার্জশীট আদালতে জমা দেয়। চার্জশীটে বলা হয়েছে ‘নিহত দলিল লেখক রেজাউল করিম রিয়াজের স্ত্রী আমিনা আক্তার লিজা আদালতে মিথ্যা জবানবন্দী প্রদান করে মামলার তদন্ত ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করেছে। যা দন্ড বিধি-২০১ ধারার অপরাধ করেছে। চার্জশীটে আরো উল্লেখ করা হয়েছে আমিনা আক্তার লিজার বিরুদ্ধে দন্ডবিধি আইনের ২০১ ধারার অপরাধ প্রাথমিকভাবে সত্য প্রমানিত হওয়ায় তার বিরুদ্ধে পেনাল কোডের ৪৫৭,৩৮০,৩০২,২০১,৪১১ এবং ৩৪ ধারায় ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য বিজ্ঞ আদালতে দাখিল করলাম’। হত্যাকান্ডের পর বাদীসহ সকলের সন্দেহ ছিলো খুনের সাথে স্ত্রী লিজা জড়িত। কিন্তু পূর্বের তদন্তকারী সংস্থা থানা পুলিশ ও ডিবি বিষয়টি বারবার ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। লিজাকে বাদ দিয়ে চার্জশীট দিয়েছে ওই দুটি তদন্তকারী সংস্থা। কিন্তু তদন্তকারী সংস্থা মামলার অন্যতম প্রধান আসামী স্ত্রী লিজার পরকীয়া প্রেমিক মাসুমকে চার্জশীটে অর্ন্তভূক্ত করেনি। যে কারনে এই রিপের্টে নারাজি দেন মামলার বাদী। এরপর তদন্তভার দেওয়া হয় পিবিআই এর উপর।
উল্লেখ্য স্ত্রীর পরকীয়ায় বাধা হওয়ার কারণে দলিল লেখক রিয়াজ কে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকান্ডে স্ত্রী আমিনা আক্তার লিজা (৩০) ও রিয়াজেরই সহযোগী মাসুমসহ আরও বেশ কয়েকজন অংশ নেয়। পুলিশ জানায়, মাসুম ও রিয়াজের স্ত্রী লিজার সঙ্গে হৃদয়ঘটিত সম্পর্ক ছিল। পুলিশের হাতে আটক লিজাও আদালতে এমনই স্বীকারোক্তি দিয়েছে। ২০১৯ সালের ১৮ এপ্রিল রাতে সদর উপজেলার চরমোনাই ইউনিয়নের বুখাইনগর রাজধর গ্রামের নিজ ঘরে খুন হন দলিল লেখক রেজাউল করিম রিয়াজ। পুলিশ জানায়, হত্যাকান্ডের পর রিয়াজের স্ত্রী আমিনা আক্তার লিজার আচরণ সন্দেহজনক হওয়ায় তাকে থানায় নিয়ে আসা হয়। ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদে জানাযায়, রিয়াজের দ্বিতীয় এবং লিজার তৃতীয় বিয়ে ছিল এটি। আগের দুই স্বামীর কাছ থেকে জমি এবং অর্থ হাতিয়ে লিজা তাদের তালাক দেয়। দ্বিতীয় স্বামীকে তালাক দিয়ে চারবছর আগে লিজা রিয়াজকে বিয়ে করে। চার বছরেও কোনো সন্তান না হওয়ায় তাদের সংসার জীবনে অশান্তি লেগেছিল। একপর্যায়ে তাকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে বেরিয়ে আসে এই হত্যাকান্ডে সব তথ্য। পুলিশ জানায়, হত্যাকান্ডের মাস তিনেক আগে রিয়াজের সহকারী মাসুমের সঙ্গে লিজার পরিচয় হয়। রিয়াজের কাছে দলিল লিখন কাজে প্রায়ই গ্রামের বাড়িতে যাওয়া-আসা করত মাসুম। এই যাওয়া-আসাকে কেন্দ্র করে একপর্যায়ে লিজার সঙ্গে মাসুমের প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হয়। কিন্তু এই সম্পর্কের বিষয়টি জেনে ফেলেন রিয়াজ। এ নিয়ে লিজাকে গালাগাল করেন রিয়াজ। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে লিজা পরকীয়া প্রেমিক মাসুমের সঙ্গে যুক্তি করে স্বামীকে হত্যার পাশাপাশি বরিশাল নগরীর পলাশপুরে রিয়াজের মালিকানাধীন ১৭ শতাংশ জমি আত্মসাতের পরিকল্পনা করে। সেই পরিকল্পনা অনুসারে ১৮ এপ্রিল ঘটনার রাতে লিজা দুধের সঙ্গে দুটি ঘুমের ট্যাবলেট মিশিয়ে স্বামীকে খাওয়ায়। এতে রিয়াজ অচেতন হয়ে পড়লে রাত আড়াইটার দিকে লিজা, মাসুম ও তাদের সহযোগী হালিম ওরফে হাইল্যা ধারালো অস্ত্র ও ছুরি দিয়ে গলাকেটে এবং কুপিয়ে তাকে হত্যা করে। পরে ডাকাতির নাটক সাজাতে লিজা ঘরের মাটির ভিটিতে সিঁধ কাটে। স্ত্রীর মুখে স্বামীকে হত্যার এই লোমহর্ষক বর্ণনা বরিশাল চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতকেও হতবাক করেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। সংশ্লিষ্ট আদালতের বিচারক ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও গ্রহণ করে। এই হত্যাকান্ডের ঘটনায় ১৯ এপ্রিল নিহতের ভাই মনিরুল ইসলাম রিপন বাদী হয়ে অজ্ঞাতদের আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেন। বাদী রিপন বলেন, কয়েক মাস পর পর তদন্তকারী সংস্থা পরিবর্তন হচ্ছে। এর ফলে আমি খুবই হতাশ। আদৌ ভাই হত্যার বিচার পাব কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। তিনি বলেন, ঘটনার ৫ বছর অতিক্রম হয়ে গেছে। একটি মামলার তদন্ত করার জন্য এটি যথেষ্ট সময়। কিন্তু হচ্ছেটা কি। আশা করছি বর্তমান তদন্তকারী সংস্থা পিবিআই সঠিক রিপোর্ট নিয়ে মামলার বিচার কাজ শুরু করতে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করবে। তিনি আরো বলেন, সম্প্রতি মামলার অন্যতম সাক্ষী ঘটনাস্থল থেকে ৫বার নির্বাচিত মেম্বর মনোয়ার হোসেন জুয়েল মৃত্যুবরন করেন। এটি মামলার জন্য বড় একটি ক্ষতি। এভাবে বিলম্ব হলে মামলার বিচার কাজ শেষ হবে না বলে মন্তব্য করেন তিনি।