3:32 pm , November 21, 2024
ভ্যাকসিনের অনিয়মিত ও জটিল সরবরাহ প্রক্রিয়া ॥ সমস্যা প্রকটে
নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ বছরের ব্যবধানে বরিশাল জেলায় কয়েকগুন বেড়েছে কুকুর ও বিড়ালের কামড়ে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। গত বছর এই সময়ে বরিশাল সদর হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে ৩০ থেকে ৪০ জন জলাতঙ্কের রোগী ভ্যাকসিন নিতে আসলেও এখন সংখ্যাটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০০ থেকে ২৫০ জনে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের মতে কুকুরের প্রজনন মৌসুম শেষ হওয়ায় বাচ্চা প্রসবের আগের এই সময়টিতে স্বভাবগত কারনে কিছুটা আক্রমনাত্মক হয়ে ওঠে। বর্তমানে অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে পোষ্য বিড়ালের কামড় আক্রান্ত রোগির সংখ্যা। হঠাৎ করে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ভ্যাকসিন দিতে বেগ পেতে হচ্ছে সদর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে। অন্যদিকে চাহিদাঅনুযায়ী ভ্যাকসিনের যোগান না থাকা এবং স্থানীয়ভাবে সরবরাহ না থাকায় সমস্যা আরো প্রকট হয়ে উঠছে বলে জানিয়েছেন সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. মলয় কৃষ্ণ বড়াল। তিনি বলেন, দিন দিন বাড়তে থাকা আক্রান্তদের সেবা দিতে বেগ পেতে হচ্ছে। তাই সমস্যা সমাধানে কিছু উদ্যোগ গ্রহণের বিকল্প নেই।
সূত্র মতে, গত ১০দিনে শুধুমাত্র বরিশাল নগরীতে প্রায় অর্ধশত বিভিন্ন বয়সের পথচারি বে-ওয়ারিশ কুকুরের কামড়ে আহত হয়েছেন। বাসাবাড়ির পোষ্য বিড়ালের কামড় ও আঁচড়ে আক্রান্তের সংখ্যা আরও বেশি। স্বাভাবিকভাবে ভাদ্র-আশ্বিন মাসে কুকুর বিড়ালের প্রজনন মৌসুম। বর্তমানে চলমান কার্তিক-অগ্রাহায়ন মাসে বাচ্চা প্রসবের সময়। তাই সড়কের বে-ওয়ারিশ কুকুর বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।
এ কারণে পথচারিরা আক্রমের শিকার হচ্ছেন। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে পোষ্য বিড়ালের আক্রমন। সখের বসে বিড়াল প্রতিপালন বেশি হয়। এ কারণে আক্রমনও বেশিই এমনটাই বলছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। বর্তমানে দেশি বিদেশি বিভিন্ন জাতের বিড়াল পালন একটি ফ্যাসনে পরিনত হয়েছে। সুন্দর চেহারা বা বিদেশি জাতের বিড়াল প্রতিপালনের মাধ্যমে নিজের আলাদা একটি ভাবমূর্তি তৈরির জন্য বিশেষ করে বর্তমানে বিড়াল পুষছেন অনেকে। প্রতিপালনকারীরা বিড়াল নিয়ে বেশি ঘাটাঘাটি করার কারনে আক্রান্ত হচ্ছে বলে জানান সদর হাসপাতালের ভ্যাকসিন বুথে কর্মরতরা। এছাড়া সখের বশে দামি একটি বিড়াল কিনলেও তার স্বভাব বা আচরন বোঝার মত সঠিক জ্ঞান না থাকায় বরিশালে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে। হঠাৎ করে আক্রান্তদের সংখ্যা অস্বাভাবিক বৃদ্ধি জটিলতা সৃষ্টি করেছে ভ্যাকসিনেশন প্রক্রিয়ায়। প্রয়োজনের তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় এ সমস্যা জটিল আকার ধারণ করেছে। এ বিষয়ে বরিশাল সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. মলয় কৃষ্ণ বড়াল বলেন, কুকুর ও বিড়ালের কামড় বা গভীর আঁচড়ে যে ভ্যাকসিন নিতে হয় তার ডোজ তিনটি। শুন্য দিন (আক্রান্তের পর ভ্যাকসিন নেয়ার প্রথম দিন), তৃতীয় এবং সপ্তম দিনে এই কোর্স সম্পন্ন হয় সাধারনত। তবে ক্ষেত্র বিশেষে ৫ ডোজ টিকাও নিতে হতে পারে। প্রতিদিন পৃথক তিনটি ডোজের ভ্যাকসিন নিতে হাসপাতালের একটিমাত্র বুথে আসে আক্রান্ত বরিশাল নগরীসহ জেলার বাসিন্দারা। গত বছর এই সময়ে যেখানে প্রতিদিন তিন ডোজ মিলিয়ে ৩০ থেকে ৪০ জন আসতো এবছর সেই সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ২০০ থেকে ২৫০জন। প্রতিদিন প্রথম ডোজের ভ্যাকসিন নেয়ার জন্যই কমপক্ষে ৮০ জন আসে। নভেম্বর মাসের ১-১৫ তারিখ পর্যন্ত সদর হাসপাতালের বুথে আক্রান্ত হয়ে শুধুমাত্র প্রথম ডোজের ভ্যাকসিন নিয়েছে প্রায় ১ হাজার বাসিন্দা বলে জানান তিনি। তিন ডোজে সেই সংখ্যা দাঁড়ায় ৩ হাজারে। এ সকল রোগির ৯০ শতাংশই বিড়ালের কামড় বা আঁচড়ে আক্রান্ত হয়ে আসে। চলমান সময়ে কুকুরের কামড়ে আক্রান্তের সংখ্যাও বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। বছরের ব্যবধানে সংখ্যাটি কয়েকগুন বেড়ে যাওয়ায় হাসপতাল কর্তৃপক্ষকে সেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে বলে জানান আবাসিক মেডিকেল অফিসার। একটি বুথে এত লোক হওয়ায় বিভিন্ন সময় ভ্যাকসিন নিতে আসা আক্রান্তদের মধ্যে মারামারি পর্যন্ত হচ্ছে। অন্যদিকে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে ভ্যাকসিনের অনিয়মিত সরবরাহ ও ভ্যাকসিন আনার প্রক্রিয়ায় জটিলতার বিষয়টি। প্রতিমাসে ‘সিডিসি’ তে ভ্যাকসিনের চাহিদা দিতে হয়। এরপর তার সরবরাহ করে ‘সিএমএইচডি’। মোট চাহিদার ভ্যাকসিন একবারে কখনোই দেয়া হয়না। তবে এর চাইতেও বড় সমস্যা এই ভ্যাকসিন আনতে হয় মহাখালি গিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে। এ প্রক্রিয়ায় সময় ব্যয় হয় কমপক্ষে দুইদিন। একবারে না দেয়ায় চাহিদ ভ্যাকসিনের ডোজ আনতে মাসে দুইবার ঢাকা যেতে হয় হাসপাতালের কর্মচারীদের। সঠিক মানরক্ষা করে এই ভ্যাকসিনের পরিবহনের ব্যবস্থা করতে হয় বিধায় এটি একটি সময় সাপেক্ষ প্রক্রিয়া। একটি ডোজ শুরুর পর অবশ্যই তার সঠিক সময় মেনে চালিয়ে যেতে হয়। কিন্তু সঠিক সময় সরবরাহ না করতে পারায় আক্রান্তরা বাধ্য হয়ে বাইরে থেকে চড়ামূল্যে ভ্যাকসিন নিয়ে থাকেন।
যে কারনে ছুটির দিনে ভ্যাকসিনেশন চালু রেখেও পরিপূর্ন সুফল আসছে না। সদর হাসপাতাল বরিশাল জেলার অন্যতম প্রধান কেন্দ্র টিকা ও ভ্যাকসিনের জন্য। অন্য টিকাগুলো যেভাবে সিটি কর্পোরেশনের মাধ্যমে সরবরাহ হয়, এই ভ্যাকসিনগুলো যদি জেলা পর্যায়ে সববরাহের ব্যবস্থা করা হতো তবে জটিলতা অনেকাংশে কমে যেত বলে মন্তব্য করেন আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. মলয় কৃষ্ণ বড়াল। যে কোম্পানির ভ্যাকসিন ব্যবহার হয় তা যদি স্ব-স্ব কোম্পানির স্থানীয় ডিস্ট্রিবিউটর পয়েন্ট থেকে দেয়া হয় তাহলে কোন জটিলতা থাকে না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে বারবার আবেদন করে ভ্যাকসিন নিয়ে সমস্যর সমাধান মিলছে না। এই পরিস্থিতিতে সাধারন মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধির কোন বিকল্প নেই বলে মনে করেন তিনি। বাসাবাড়িতে পোষ্য প্রানিটিকে ভ্যাকসিন দিয়ে রাখলে তার কামড়ে কোন সমস্যা হয়না। এছাড়া প্রানি পোষার পূর্বে এর স্বভাব বা আচরন বুঝতে হবে। পথে চলাফেরার ক্ষেত্রে বছরের এই সময়টিতে বেওয়ারিশ কুকুর থেকে একটু বেশি সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
এ বিষয়ে বরিশালের সিভিল সার্জন ডা. মারিয়া হাসান বলেন, চাহিদা অনুযায়ী ভ্যাকসিন কখনোই পাওয়া যায়না। অধিদপ্তরে ৫ হাজার চাহিদা দিলে সরবরাহ হয় ২ হাজার। এছাড়া এই ভ্যাকসিন আনতে হয় বরিশাল থেকে ঢাকা গিয়ে। যে কারনে বাড়তে থাকা আক্রান্তদের চাপ সামলানো আরও কঠিন হয়ে পড়ছে দিন দিন। সমস্যা সমাধানে জেলা পর্যায়ে ভ্যাকসিন সরবরাহের জন্য একাধিকবার আবেদন করা হয়েছে। তবে কোন সুফল মেলেনি। যারা নীতিনির্ধারক তারা যদি সমস্যা সমাধানের সঠিক প্রক্রিয়ায় অনুমোদন না দেয় তা হলে করার কিছুই নেই।